সিলেটি নাগরি লিপির উইকিপিডিয়া: বিস্মৃত লিপির নবজাগরণের হাতছানি?

বৃহত্তর সিলেট, করিমগঞ্জ, আসাম, ত্রিপুরা এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের এক সময়ের পরিচিত লিপি ছিল নাগরি। এই লিপিতে রচিত হতো পুঁথি, সাহিত্য, এমনকি ধর্মগ্রন্থও।

ভাষা ও লোকসংস্কৃতি গবেষক আশরাফুল করিমের মতে, সিলেটি নাগরি পৃথিবীর একমাত্র ভাষা, যার নিজস্ব লিপি থাকা সত্ত্বেও আজ তা প্রায় বিস্মৃত।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও নাগরি লিপি গবেষক আশরাফুলের ভাষ্য, এককালে এই লিপি নবীন-প্রবীণ নির্বিশেষে সকলের চর্চায় ছিল, বিশেষত সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক।

কিন্তু কালের স্রোতে নাগরি লিপি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। সাহিত্যচর্চা তো নেই-ই, লেখার পাতা থেকেও মুছে যাওয়ার উপক্রম। অথচ একসময় এই লিপি স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল, জনজীবনের সাথে ছিল অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

তবে মাতৃভাষার প্রতি মানুষের টান চিরন্তন। সেই টানেই কেউ কেউ আগলে রাখেন নিজের ভাষাকে, বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর চেষ্টা চালান।

সেই চেষ্টারই ফসল— নবনির্মিত সিলেটি নাগরি ভাষার উইকিপিডিয়া।

২০২৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের অনুমোদনক্রমে এই উইকিপিডিয়া উন্মুক্ত করা হয় সর্বসাধারণের জন্য। দীর্ঘ নয়-দশ বছরের প্রচেষ্টার ফল এটি। ২০১৪ সালে প্রথম প্রস্তাবনা জমা দেওয়ার পর ইনকিউবেটর পৃষ্ঠায় দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে, অবশেষে সিলেটি ভাষাভাষীরা তাদের নিজস্ব ভাষায় উইকিপিডিয়া ব্যবহারের সুযোগ পেলেন।

গবেষক আশরাফুল করিম মনে করেন, নাগরি লিপিতে লেখা এই সংস্করণটি সিলেটি ভাষার প্রচার ও সমৃদ্ধির পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

পঞ্চদশ শতকে নাগরি লিপির বিকাশ শুরু হয়ে বৃহত্তর সিলেট, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, আসাম ও ত্রিপুরার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমতে থাকে। এমনকি বর্তমান প্রজন্মের প্রবীণরাও এই লিপি সম্পর্কে তেমন অবগত নন।

তাই প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই লিপিকে নতুন জীবন দেওয়ার এক উজ্জ্বল প্রয়াস এই উইকিপিডিয়া। একটা সময় এই লিপিতে দুই শতাধিক বই রচিত হয়েছিল— পুঁথি সাহিত্য থেকে শুরু করে গান ও নানা সাহিত্যকর্ম।

গৃহস্থালি অনুষঙ্গের সাথে বর্ণমালার মেলবন্ধন

আশরাফুল করিম জানান, শাহজালাল (রহ.)-এর সিলেটে আগমন এই লিপির উৎপত্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। হিন্দু-অধ্যুষিত সিলেটে তিনি যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন ভাষার একটি barrier তৈরি হয়। স্থানীয় হিন্দুরা আরবি-ফারসি মিশ্রিত বাংলা পছন্দ করতেন না, আর মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী মনে করতেন— কারণ তাতে সংস্কৃত শব্দের আধিক্য ছিল।

তখন শাহজালালের ৩৬০ সঙ্গীর মধ্যে ভাষাজ্ঞানী কয়েকজন একটি নতুন লিপি তৈরির দায়িত্ব পান, যা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের বোধগম্য হবে এবং প্রচারের কাজে সহায়ক হবে। এই লিপি এতটাই সহজ ছিল যে, মাত্র দেড়-দু'দিনে শেখা যেত। আর বর্ণমালাগুলো মানুষের পরিচিত গৃহস্থালি সরঞ্জামের সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়েছিল।

তবে কিছু গবেষকের মতে, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে আফগান উপনিবেশের সময়, আবার কারো মতে ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে এই লিপির উদ্ভব।

সহজ ও স্বতন্ত্র এক ভাষা

আশরাফুল করিম আরও বলেন, বাংলা লিপিতে প্রায় দু'শোর বেশি যুক্তব্যঞ্জন একটি বড় সমস্যা ছিল। নাগরি লিপিতে সেটি মাত্র ১৬টি। দীর্ঘ ঈ-কারের পরিবর্তে এখানে শুধু হ্রস্ব ই-কার ব্যবহার করা হতো— সম্ভবত লিপিকারদের উদ্দেশ্য ছিল ভাষাকে আরও সহজ করা। তিনি মনে করেন, নাগরি কোনো উপভাষা নয়, বরং বাংলা থেকে স্বতন্ত্র একটি ভাষা, যা প্রায় পাঁচ থেকে সাতশ বছর ধরে প্রচলিত ছিল। কারো কারো মতে, এর চর্চা ১৫০০ থেকে ১৮০০ সাল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে সিলেটের বন্দরবাজারে নাগরি লিপির একটি প্রেস ছিল, আরেকটি ছিল কলকাতায়। যুদ্ধের সময় সিলেটের প্রেসটি ধ্বংস হয়ে গেলে, এর পুনরুজ্জীবন ঘটেনি। তখনো সন্ধ্যায় উঠোনে বসে মানুষ লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখার পুঁথিপাঠ শুনত— সেইসব কাহিনিও নাগরি লিপিতে লেখা হয়েছিল, যদিও অনেক পুঁথি এখনো অনাবিষ্কৃত।

উইকিপিডিয়া: পুনর্জাগরণের নবদিগন্ত?

ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে নাগরি লিপির যাত্রা শুরু হলেও, পরবর্তীতে এতে প্রেমের কাহিনি ও পুরাণকথাও স্থান পায়। একসময় মানুষ আগ্রহভরে এই লিপির পুঁথিপাঠ শ্রবণ করত। গবেষক আশরাফুল করিম মনে করেন, নতুন চালু হওয়া উইকিপিডিয়া সেই আগ্রহ পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে উইকিপিডিয়ার মতো প্ল্যাটফর্ম নাগরি লিপিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন করে পরিচিত করতে পারে। এর মাধ্যমে নতুন লেখক সৃষ্টি হবে, রচিত হবে নতুন সাহিত্য। ইতিমধ্যেই অনেক তরুণ এই লিপিতে সাহিত্যচর্চায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন, পাশাপাশি প্রবীণরাও চান এই ঐতিহ্যবাহী লিপি তাদের চর্চায় ফিরে আসুক।

আশরাফুল করিম সিলেটি নাগরি উইকিপিডিয়া চালুর বেশ কিছু সুবিধার কথা উল্লেখ করেন— ভাষার সংরক্ষণ, নতুন প্রজন্মের শেখা ও ব্যবহারের সুযোগ, সিলেটি সংস্কৃতির তথ্য সংরক্ষণ ও প্রচার, স্থানীয় গবেষকদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন এবং প্রবীণ ভাষাভাষীদের জন্য ইন্টারনেটে তথ্য সহজলভ্য করা। এটি ভাষাবিদ ও শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করবে এবং ভাষার আধুনিকীকরণেও সহায়ক হবে বলে তিনি মনে করেন।

দুই তরুণের হাতে নাগরি লিপির নিজস্ব কীবোর্ড:

এই যাত্রায় সাব্বির আহমদ শাওন ও নুরুল ইসলামের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায় এক দশক আগে তাদের উদ্যোগে নাগরি লিপি নিজস্ব কীবোর্ড লাভ করে। ২০২৪ সালে তারা 'সিলোটি.অ্যাপ' নামে আরও একটি অ্যাপ তৈরি করেন। মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির এই দুই শিক্ষার্থী ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদে এই উদ্ভাবন করেন। তাদের তৈরি 'Syloti Nagri Keyboard' গুগল প্লে স্টোরে অ্যান্ড্রয়েড কীবোর্ড হিসেবে স্থান পায়। তারা নিজেরাও প্রথমে এই লিপি সম্পর্কে তেমন জানতেন না, কীবোর্ড তৈরির আগে তারা এটি নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ২০১৭ সালে এটি উন্মুক্ত করেন। বর্তমানে কীবোর্ডটিতে ইংরেজি, নাগরি ও বাংলা-টু-নাগরি লে-আউট রয়েছে এবং ভবিষ্যতে বাংলা ও ফোনেটিক লে-আউট যুক্ত করার পরিকল্পনা আছে।

নাগরি কীবোর্ড এবং সিলোটি.অ্যাপ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাব্বির বলেন, কীবোর্ড তৈরির পর তারা ভালো সাড়া পেয়েছেন। বর্তমানে সিলোটি.অ্যাপ-এর ১০-১৫ হাজার এবং কীবোর্ডের ৫০ হাজারের বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছেন। উইকিপিডিয়া হওয়ার খবরে তারা অত্যন্ত আনন্দিত।

গবেষক আশরাফুল করিমের মতো সাব্বিরও মনে করেন, উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে নাগরি লিপির পুনর্জাগরণ সম্ভব। এর মাধ্যমে মানুষ এই লিপি সম্পর্কে জানতে পারবে এবং তাদের দেওয়া তথ্য উইকিপিডিয়াকে সমৃদ্ধ করবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জ্ঞানের ভাণ্ডার তৈরি করবে। হারিয়ে যাওয়া পুঁথিগুলোও হয়তো এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে ফিরে আসবে।

শেয়ার করুন: