কদম রসুল মসজিদ
কদম রসুল মসজিদ, মুর্শিদাবাদ, ভারত

কদম রসুল: প্রিয় নবীর স্মৃতিচিহ্ন

বিশ্বনবী মহানবী মুহাম্মদ (সা.) অতিমানব নন। বরং তিনি মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হন এবং ৬৩ বছরের বর্ণাঢ্য যাপিত জীবন শেষে মহাপ্রভুর ডাকে সাড়া দেন। প্রিয় নবী (সা.)-এর স্মৃতিধন্য পবিত্র চিহ্নসমূহ আজও সংরক্ষিত আছে, যা তাঁর চলমান মুজিজা এবং বিশ্ববাসীর জন্য একেকটি করুণা নির্ঝরিণী। পবিত্র কোরআন, হাদিসশাস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়াসহ আনুমানিক ১০ সহস্রাধিক মুজিজা প্রিয় নবী (সা.)-এর পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন এবং তাঁর জীবনের প্রতীক।

প্রিয় নবী (সা.)-এর পবিত্র সিলমোহর, লাঠি, কবরের মাটি, পাগড়ি, তরবারি, সিন্দুক, চুল ইত্যাদি দর্শনে আজও নবিপ্রেমিক মাত্রই অন্তর উদ্বেলিত হয়। এ ছাড়া ‘কদম রসুল’ বা ইট-পাথরের টুকরা ইত্যাদিতে প্রিয় নবী (সা.)-এর কয়েকটি পদচিহ্ন আজও সংরক্ষিত আছে। যদিও এগুলোর শুদ্ধতা, সততা নিয়ে লোকবিশ্বাসে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। হতে পারে, ‘কদম রসুল’ ব্যাপারটি এমনই এক ভক্তিবাদী অস্তিত্ব।

কদম রসুল বলতে প্রিয় নবী (সা.)-এর পবিত্র পদচিহ্নসংবলিত পাথরখণ্ড বোঝায়। নবিপ্রেমীদের বিশ্বাস প্রিয় নবী (সা.)-এর পবিত্র পদস্পর্শে পাথর নরম হয়ে তাঁর পদচিহ্ন ধারণ করে নিত। অত্যন্ত সযত্ন প্রয়াসে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কদম রসুল সংরক্ষিত হয়েছে। প্রাচীন কালে হাজি সাহেবান মক্কা থেকে এ ধরনের পাথর সংগ্রহ করে মসজিদের ভেতর বা আলাদা সৌধে সংরক্ষণ করতেন। এগুলোই কদম মোবারক, কদম শরিফ, কদম রসুল ইত্যাদি নামে পরিচিত।

বাইতুল মুকাদ্দাস বা ‘ডোম অব দ্য রক’-এ পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত কদম রসুল আছে। বিশ্বাস করা প্রিয় নবী (সা.) মিরাজে যাওয়ার সময় যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে বোরাকে আরোহণ করেছিলেন, তাতে তাঁর পবিত্র পায়ের ছাপ তৈরি হয় এবং তখন থেকেই ওই পবিত্র পাথরটি জেরুজালেমে সংরক্ষিত।

ধারণা করা এমনই আরো কিছু পদচিহ্ন দামেস্কের মসজিদে আকদামে আছে এবং সেখানে মুসা (আ.)-এর পবিত্র পদচিহ্ন আছে বলে মনে করা হয়। অনুরূপভাবে মিসরের কায়রো, তুরস্কের ইস্তাম্বুল ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কদম রসুলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে কদম রসুলের সংখ্যা ১৪টি। যেমন—দিল্লি, উত্তর প্রদেশের বাহরাইচ, গুজরাট, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গের গৌড়, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি।

প্রাচীনতম কদম রসুল কমপ্লেক্সটি গৌড়ে অবস্থিত। ১৫৩০-১৫৩১ খ্রি. সুলতান নুসরত শাহ এটি তৈরি করেন। কথিত আছে বিশিষ্ট সুফি সাধক জালালউদ্দিন তাবরিজির ইবাদতখানা থেকে এই কদম রসুল সংগ্রহ করা হয়। মুর্শিদাবাদের কদম রসুল কমপ্লেক্সটি একটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদসংলগ্ন স্থানে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। এখানে আট খণ্ডের বিশাল শিলালিপি পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে শীতলক্ষ্যাতীরবর্তী নারায়ণগঞ্জের নবীগঞ্জে অবস্থিত কদম রসুল। মির্জা নাথনের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়িব’ গ্রন্থের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আফগান সিপাহসালার মাসুম খান কাবুলি এক আরব বণিকের কাছ থেকে প্রিয় নবী (সা.)-এর পবিত্র পদচিহ্নসংবলিত পাথরটি সংগ্রহ করেন। ১৭৭৭-১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার জমিদার গোলাম নবী কদম রসুল সংক্ষণের জন্য নারায়ণগঞ্জে এক গম্বুজবিশিষ্ট সৌধ নির্মাণ করেন। সৌধের সামনে বারান্দা, মধ্যের কক্ষে একটি ধাতব পাত্রে গোলাপজলে ডোবানো আছে পবিত্র পাথরটি। পাথরের গায়ে ২৪১০ সেন্টিমিটার জুড়ে আছে পায়ের ছাপ।

মুঘল প্রশাসক ইয়াসিন খান ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে আরেকটি কদম রসুল নির্মাণ করেন। এর কেন্দ্রে একটি মসজিদ এবং দুই দিকে দুটি কক্ষ। এর একটিতে কদম রসুল অন্যটিতে বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর পদচিহ্ন। এই কদম রসুল কমপ্লেক্সে মসজিদ, মাদরাসা, কবরখানা ইত্যাদি আছে। এটি কদম মোবারক হিসেবে সুপরিচিত। এ ছাড়া চন্দনাইশের বগিচাহাটে আরেকটি কদম রসুল আছে।

আসলে কদম রসুল নবিপ্রেমের ভক্তিময় প্রকাশমাত্র, যুগ যুগ ধরে এর অস্তিত্ব টিকে আছে পরম শ্রদ্ধায়। কদম রসুল যেন পাথর পূজা, তথা শিরক ও অতিভক্তির কারণ না হয়—এদিকে খেয়াল রাখা খুবই জরুরি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ কাপাসিয়া, গাজীপুর

শেয়ার করুন: