মেলানি পার্কিন্স, আজ টেক-জগতের অন্যতম প্রভাবশালী নারী সিইও। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিতান্তই খেলার ছলে তৈরি করেছিলেন একটি সফটওয়্যার, যা পরবর্তীতে ক্যানভা নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে। গ্রাফিক্স ডিজাইন প্ল্যাটফর্মটির ওয়েবসাইটে এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মেলানি পার্কিন্স তুলে ধরেছেন সেই শুরুর দিনগুলোর গল্প। নিচে সেই নির্বাচিত অংশের অনুবাদ তুলে ধরা হলো:
সাল ২০০৮। আমি তখন পার্থের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় পড়ি। পাশাপাশি একটা ডিজাইন প্রোগ্রামে ক্লাস নিতাম।
ক্লাস নিতে গিয়ে আমি ডিজাইন সফটওয়্যারের টুলগুলোর জটিলতা ও অগোছালো ভাব লক্ষ্য করলাম। সবকিছুই ছিল ডেস্কটপ-নির্ভর এবং কাজ করতে প্রচুর সময় লাগত। অথচ তখন মানুষ ফেসবুক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ফেসবুকের সরলতাই এর দ্রুত জনপ্রিয়তার কারণ ছিল। অন্যদিকে, ডিজাইনের বিভিন্ন টুল শিখতে তখনও বছরব্যাপী প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হতো। আমার চাওয়া ছিল এমন একটি ডিজাইন সফটওয়্যার, যা হবে সহজ, অনলাইন-ভিত্তিক এবং যেখানে একাধিক ব্যক্তি একসাথে কাজ করতে পারবে।
যদিও ব্যবসা, বিপণন ও সফটওয়্যার উন্নয়নে আমার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা তখন প্রায় শূন্যের কোঠায় ছিল। এত বড় বড় কোম্পানিকে টেক্কা দেওয়ার ভাবনা সেই পরিস্থিতিতে নিতান্তই অযৌক্তিক মনে হচ্ছিল।
তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার এই ধারণাটি আমি বিভিন্ন স্কুলের বার্ষিকীতে কাজে লাগাব। যাতে অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের ডিজাইনের কাজগুলো সহজে করতে পারেন। আমার মা-ও একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন। স্কুলের বার্ষিকী তৈরি করতে গিয়ে তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে দেখেছি।
বয়ফ্রেন্ড ক্লিফ (ওব্রেখট)-কে ব্যবসায়িক অংশীদার এবং মায়ের ঘরটিকে অফিস বানিয়ে আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করলাম। প্রথম সফটওয়্যারটি তৈরির জন্য আমরা ঋণ নিলাম। সে সময় পার্থের প্রায় সকল সফটওয়্যার কোম্পানির কাছেই গিয়েছিলাম। তাদের অধিকাংশই হয় বলেছিল এটি একটি অসম্ভব প্রকল্প, নয়তো এর জন্য অস্বাভাবিক অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন।
শেষ পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়। গ্রেগ মিশেল পরিচালিত কোম্পানিটির নাম ছিল ইনডেপথ (বর্তমান নাম সিরেনা)।
আমরা আমাদের সফটওয়্যারের নাম দিয়েছিলাম ‘ফিউশন বুকস’। প্রথম সংস্করণটি যখন জীবন্ত হলো, তখন মনে হচ্ছিল যেন জাদু। তখন আমি আর ক্লিফ দুজনেই ছিলাম শিক্ষার্থী। সামান্য রোজগারের জন্য খণ্ডকালীন চাকরি করতাম। সকাল, সন্ধ্যা এবং ছুটির দিনে যখনই সময় পেতাম, আমরা আমাদের সফটওয়্যার নিয়েই পড়ে থাকতাম।
প্রথম গ্রাহক আমরা পাই ২০০৮ সালের মার্চ মাসে। কী এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি! এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। তাই অস্ট্রেলিয়ার অন্য প্রান্ত থেকে যখন একজন যোগাযোগ করল, আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম।
সে লিখেছিল—‘হ্যালো, আমার স্কুলের জন্য যদি ২০০ বার্ষিকী (সর্বোচ্চ ২৫০) করতে চাই, কেমন খরচ পড়বে? আশা করছি দ্রুতই তোমাদের উত্তর পাব।’
১০০ ডলারের একটি চেক পাঠিয়ে সে অর্ডারটি নিশ্চিতও করে ফেলল। আমাদের তখন আনন্দে আত্মহারা হওয়ার মতো অবস্থা। চেকটা ভাঙাব, না বাঁধিয়ে রাখব, আমরা বুঝতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চেকটা ভাঙাতেই হলো; কারণ, সেই টাকাটা আমাদের প্রয়োজন ছিল।
আমি আর ক্লিফ টুকটাক যা আয় করতাম, তার পুরোটাই সফটওয়্যারের বিপণনের পেছনে খরচ হয়ে যাচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্কুলে আমরা সরাসরি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। চিঠি ভাঁজ করা থেকে শুরু করে খামে ভরা এবং টিকিট লাগানোর মতো কাজগুলোতে পরিবারের সদস্যরাও সাহায্য করেছিলেন। গায়ে খেটে সবকিছু করতে হয়েছে। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়েই আমরা শিখেছি, কীভাবে এমন একটি পণ্য তৈরি করতে হয়, যার জন্য গ্রাহক অর্থ খরচ করতে রাজি হবে।
গ্রাহক খুঁজে বের করার জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছি। এমনকি একটি শিক্ষা মেলায় অংশ নিতে সিডনিতেও গিয়েছিলাম। সেখানে অংশগ্রহণকারীর চেয়ে প্রদর্শকের (এক্সহিবিটর) সংখ্যা বেশি ছিল। সুতরাং সেই চেষ্টাটি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল।
কোম্পানিতে আমরা প্রথম যাকে নিয়োগ দিই, তিনি ছিলেন একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। স্কুলবার্ষিকীর মৌসুমে, অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে কাজের চাপ খুব বেড়ে যেত। দিন রাত ২৪ ঘণ্টা বার্ষিকী ছাপানোর কাজ চলত। প্রতি বছর আমরা আমাদের সফটওয়্যারটিকে একেবারে গোড়া থেকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করতাম। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছিল, আমরাও ফিউশনকে তত সহজ এবং উন্নত করার চেষ্টা করছিলাম। যা আয় হতো, তার সবই এই উন্নয়নের কাজে ব্যয় হয়ে যেত। তবে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে কাজের জন্য সরকার আমাদের কিছু কর মওকুফ করেছিল, যা আমাদের জন্য খুবই সহায়ক ছিল। ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া ২০ হাজার ডলারের ঋণও ছিল একটি বড় পাওয়া।
পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, এই ঠেকে ঠেকে শেখা সময়টার জন্য আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। যদি ব্যবসার অলিগলিগুলো না চিনতাম, যদি গ্রাহকের চাহিদাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা না সাজাতাম, তাহলে ক্যানভা আজকের অবস্থানে কোনো দিন পৌঁছতে পারত না।