জাকাতের কাপড় কতটা মানসম্মত হয়?

ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের একটি হলো জাকাত, যা ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলোর অন্যতম। জাকাত শব্দের অর্থ পবিত্র করা, পরিশুদ্ধ করা বা প্রবৃদ্ধি দান করা। শরীয়তের ভাষায়, সুনির্ধারিত সম্পদ সুনির্ধারিত শর্তে তার হকদারকে অর্পণ করা।

এককথায় কোনো মুসলমান আল্লাহ নির্ধারিত (নিসাব) পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে এবং তা এক বছর পর্যন্ত তার কাছে থাকলে তার নির্ধারিত পরিমাণ অংশ হকদারের কাছে পৌঁছে দেয়াকে জাকাত বলা হয়।

ন্যূনতম যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে জাকাত আদায় ফরজ হয় তাকে ইসলামি পরিভাষায় ‘নিসাব ’ বা ‘নেসাব’ বলে। কোরআন শরিফে আল্লাহ তা’আলা যখনই নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন,পাশাপাশি অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাকাত আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন,‘নামাজ কায়েম কর এবং জাকাত আদায় কর’।

জাকাত সম্পর্কে সূরা আল বাকারার ২৬৭নং আয়াতে বলা হয়েছে-তোমরা নিজেরা যে পবিত্র ধনসম্পদ উপার্জন করছ এবং জমি থেকে যে ফসল আমি তোমাদের দান করেছি-এসব কিছু থেকে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর।

কোন কোন সম্পদের জাকাত দিতে হয়:

যেসব সম্পদের জাকাত দিতে হয়,সেগুলো হলো-

১. নগদ টাকা-পয়সা,ব্যাংক ব্যালেন্স,বন্ড ও অন্যান্য ফাইন্যানশিয়াল ইন্সট্রুমেন্টস

২. সোনা-রুপা;অর্নামেন্ট,বার যাই হোক;তা নিত্যব্যবহার্য হলেও।

৩. ব্যবসার সম্পদ।

৪। জীবজন্তু

৫। কৃষিজ উৎপাদন ও

৬। খনিজ সম্পদ।

স্বর্ণ সাড়ে সাত ভরি বা সাড়ে সাত তোলা, রুপা সাড়ে বায়ান্ন তোলা অথবা এর তৈরি গয়না থাকলে জাকাত দিতে হয়। এর কোনো একটি অথবা উভয়টির মূল্য পরিমাণ অন্য কোনো সম্পদ থাকলেও তার মূলের আড়াই শতাংশ হারে জাকাত দিতে হবে।

জাকাত প্রদানের খাতগুলো সবাইকেই জাকাত দেয়া যাবে না। যাদের দেয়া যাবে,তারা হলেন- সূরা তওবার ৬০নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘জাকাত তো এসব ব্যক্তির জন্য যারা অভাবগ্রস্ত, নিতান্ত নিঃস্ব, যাদের অন্তরসমূহকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়, ক্রীতদাস মুক্তির ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে,আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহপাক সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।’

জাকাত পরিশোধের জন্য কোনো নির্ধারিত সময় নেই। বছরে একবার দিতে হয়। তবে আমাদের দেশে বহুকাল থেকে প্রতি বছর ঈদুল ফিতরের আগে জাকাত দেয়ার রীতি চলে আসছে। ধনীদের কেউ নগদ টাকা আবার কেউ কেউ গরিবের মাঝে পোশাক বিতরণ করে থাকেন।

আমাদের দেশে জাকাত হিসেবে বস্ত্রকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রশ্ন রয়েছে পোশাকের মান নিয়ে। বেশির ভাগ জাকাতদাতা সবচেয়ে কম দামের পোশাকটি জাকাতের জন্য কেনা হয়। সাধারণত সর্বদা মানুষ যে পোশাক পরিধান করে তার তুলনায় কত দামে জাকাতের পোশাক কেনা হয়।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব মার্কেটগুলোতে জাকাতের পোশাকের জন্য আলাদা করে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। বড় করে লেখা থাকে ‘এখানে জাকাতের কাপড় পাওয়া যায়’। জাকাতের পোশাক হিসেবে দেয়া হয় শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, পাঞ্জাবি, জায়নামাজ, গেঞ্জি, মেয়েদের থ্রিপিসসহ আরও অনেক রকমের পোশাক।

আমাদের দেশের মেয়েরা যেসব শাড়ি পড়ে সেগুলো সাধারণত ১২ হাত লম্বা হয়ে থাকে। আর জাকাতের জন্য যেসব শাড়ি দেয়া সেগুলো ১০ হাত বা তার চেয়ে কম হয়ে থাকে।

গত বছর বা তারও আগে জাকাতের কাপড় পাওয়া কয়েকজন মহিলার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিম্নমানের এই কাপড়গুলো একবার ধোয়ার পর তা আরও খাটো হয়ে যায়। অনেক সময় রং পরিবর্তন হয়ে যায়।

সেই কাপড় পড়ে কেউ কেউ নানা কাজ করেন আবার অনেকে রাস্তায় ভিক্ষা করেন। তখন এই আঁটসাঁট কাপড়টি কি তাকে সুরক্ষা দিতে পারে? সব জাকাতদাতাদের একবার ভেবে দেখা উচিত সওয়াবের আশায় একজন নারীকে যে কাপড় দান করা হলো তা কতটুকু কাজে লাগবে?

ঢাকার বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ জাকাতের কাপড় ১৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যারা জাকাতের জন্য নিম্নমানের কাপড় কিনছেন তারা একবার ভেতে দেখবেন, আপনি নিজে কি এই কাপড় আপনার পরিবারের কাউকে উপহার দিতে পারবেন?

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, নিম্নমানের কাপড়ের চেয়ে ভালো মানের কাপড়ের দামে খুব বেশি তফাত নয়। একই অবস্থা লুঙ্গি, পাঞ্জাবিসহ অন্যসব বস্ত্রের বেলায়ও।

একজন গরিব মানুষ ঈদ উপলক্ষে একটি বস্ত্র পাওয়ার আশায় ধনীদের দ্বারস্থ হন। কত কাকুতি করে বলেন ‘সব সময় জাকাত দেন আমারে এবারেও একটা কাপড় দিয়েন’ কেউ কেউ বলেন ‘স্যার গতবার পাই নাই এবার কিন্তু দেবেন’।

এরপর যেদিন দেয়া হয় সেদিন আবার সকাল থেকে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ে বেলা শেষে একটি বস্ত্র জুটে,কারো হয়তো জুটে না। আবার কত জন পদদলিত হয়ে পর পারে পাড়ি জমান। ১৯৮৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে শিশুসহ প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২৮৫ জনের মতো।

২০১৫ সালে ময়মনসিংহে ২৭ জন প্রাণ হারিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে চট্টগ্রামে পদদলিত হয়ে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সেই বস্ত্রটি যদি ভালো মানের না হয় তবে কি লাভ এই লোক দেখানো দান করে? আসুন সবাই মিলে ভালো মানের বস্ত্রের জাকাত প্রদান করি; নিম্নমানের নয়।

শেয়ার করুন: