মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য বৃক্ষ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বৈষয়িক প্রয়োজনে তাই বৃক্ষরোপণ করা একান্ত দরকার। যে কোনো ফল ও ফসল উৎপন্ন হলে তা মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। এমনকি ওই ফল বা ফসল যদি উৎপাদনকারী বা প্রকৃত মালিক নাও পায়, কেউ যদি চুরি করে নিয়ে যায় তাতেও সমাজের কারও না কারও প্রয়োজন পূর্ণ হয়। অর্থাৎ ওই ফল বা ফসল সর্বাবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে মূল্যবান। ইসলাম এ বিষয়ে মানুষকে সান্তনা প্রদান করেছে।
সমগ্র জগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোনো কিছুকে বৃথা সৃষ্টি করেননি। জগতের সব সৃষ্টি আল্লাহর উদ্দেশ্য সাধনে সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে আল্লাহ অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন।
আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীতে সবকিছুর সঠিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছি।’ (সূরা হিজর: ১৯)। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে বৃক্ষ এক অনন্য সৃষ্টি। এর রয়েছে বহুমুখী গুরুত্ব বা তাৎপর্য। এখানে উল্লেখ্য, আল্লাহ মানুষকে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠতর মর্যাদা প্রদান করেছেন।
জগৎ সংসারের সবকিছু তিনি কোনো না কোনোভাবে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। বৃক্ষ বা তৃণ মানুষের কল্যাণের জন্য আবশ্যক। আল্লাহ নিজে এর গুরুত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।
যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘যিনি সুষম বিকাশ সাধন করেন ও নির্দেশ করেন এবং যিনি তৃণ উৎপন্ন করেন।’ (সূরা আলা : ৩-৪)। আল্লাহ এখানে প্রকৃতির ভারসাম্যের কথা উল্লেখ করেছেন।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলিম কোনো ফলের গাছ লাগায় বা বাগান করে অথবা খেতে কোনো শস্যের বীজ বপন করে, তা থেকে কোনো মানুষ বা পশুপাখি যদি খায়, এমনকি যদি চোরে চুরি করে নিয়ে যায়; তবে ওই বৃক্ষের মালিক, বাগানওয়ালা বা খেতওয়ালা সদকার সওয়াব পাবে।’
এ ভারসাম্য জগতের জন্য আবশ্যক। আমরা জানি মানুষ ও বৃক্ষের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে এক গভীর সম্পর্ক, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। বিশেষ করে মানুষ ও উদ্ভিদ পরস্পরের দেহোপযোগী সামগ্রীর জন্য একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে (শ্বাস-প্রশ্বাসের সময়) এবং অক্সিজেন গ্রহণ করে। অন্যদিকে উদ্ভিদ অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে।
পৃথিবীতে বৃক্ষের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকলে একসময় মানুষের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হবে। এমনকি এটি মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। উদ্ভিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এ আশঙ্কায় উদ্ভিদ নিধনকে ভয়াবহ ক্ষতিকর বলে তুলে ধরেন এবং বৃক্ষরোপণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
পবিত্র কোরআনের উপরোক্ত উক্তিতে আমরা এ ভারসাম্যের দিকনির্দেশনা লাভ করি। আল্লাহ আরও বলেছেন ‘সূর্য ও চন্দ্র আবর্তন করে নির্ধারিত কক্ষপথে, তৃণলতা ও বৃক্ষ মেনে চলে তাঁর বিধান। তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন ভারসাম্য।’ (সূরা রহমান : ৫-৭)। বৃক্ষ ও উদ্ভিদ আল্লাহর সৃষ্টির বৈচিত্র্য প্রকাশক। আল্লাহ সুনিপুণ স্রষ্টা, তিনি সৃষ্টি করেছেন বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ।
আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি প্রচুর বারি বর্ষণ করি, অতঃপর আমি ভূমিকে প্রকৃষ্টরূপে বিদারিত করি এবং তাতে উৎপন্ন করি শস্য, দ্রাক্ষা, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর এবং বহু বৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যান।’ (সূরা আবাসা : ২৫-৩০)। আল্লাহর কী নৈপুণ্য! একই মাটি, একই পানিতে আমরা ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদ জন্মাতে দেখি, যাতে ভিন্ন ভিন্ন ফুল ও ফল ধরে। এসব মানুষের কল্যাণের জন্য।
আল্লাহর কোনো সৃষ্টিকে অমর্যাদা করা উচিত নয়। প্রয়োজন হলো তাকে যথার্থভাবে কাজে লাগানো। বৃক্ষের পরিকল্পিত উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপর মানুষের বহু কল্যাণ বা উপকার নিহিত রয়েছে। তাই ইসলাম বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করে।
নবী করিম (সা.) বৃক্ষরোপণের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যদি জানো আগামীকাল কেয়ামত, তবু আজ যদি হাতে কোনো বীজ বা চারাগাছ থাকে, তা বপন কর।
পরিবেশের স্বাভাবিক প্রয়োজন এবং সভ্যতার বিকাশের জন্য বৃক্ষরোপণ অত্যন্ত জরুরি। রাসুল (সা.) মক্কা বিজয়ের পর তাই নির্দেশ দিয়েছিলেন, নারীদের নির্যাতন কর না এবং বৃক্ষরোপণ কর।’ রাসুল (সা.) নিজে বৃক্ষরোপণ করে মানুষকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহী করে তুলেছেন। বৃক্ষরোপণকে তিনি ইবাদতের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রতিটি বৃক্ষ এবং তার অসংখ্য পাতা প্রতিনিয়ত আল্লাহর তসবি পাঠ করে।
অতএব বেশি নেকি হাসিল করার জন্য বেশি করে বৃক্ষরোপণ কর। বস্তুত জগতের সব সৃষ্টি আল্লাহর নিয়ম মেনে চলে এবং তাঁর মহিমা কীর্তন করে। এসবের মধ্য থেকে আল্লাহ মানুষকে এক ধরনের শিক্ষা দিতে চেয়েছেন।
আল্লাহ এসবের উদাহরণ দিয়ে পবিত্র কোরআনে বলেছেন, মানুষ কি তাঁর আদেশ মানবে না? আল্লাহর সৃষ্টি বৃক্ষ আল্লাহর নিয়ম মেনে চলে এবং আল্লাহর তসবি পাঠ করে। বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে ওই তসবি পাঠের অংশীদার হওয়া যায়। উপরোক্ত হাদিসে রাসুলে করিম (সা.) সে ইঙ্গিত প্রদান করেছেন।