মহানবী

মাহে রমজানে মহানবী সা. -র সঙ্গে একদিন

আতাউর রহমান খসরুঃ মহানবী (সা.) রমজানের জন্য অপেক্ষা করতেন। তিনি রমজান প্রাপ্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। রমজানের আগমনে খুশি হতেন, আনন্দ প্রকাশ করতেন এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে রমজানের সুসংবাদ দিতেন। তাঁদের রমজানের বিধি-বিধান শেখাতেন। রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসে অধিক পরিমাণে রোজা রাখতেন। আর রমজান শুরু হওয়ার পর তিনি ইবাদত-বন্দেগিতে পুরোপুরি ডুবে যেতেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) সাধারণত তাঁর পরিবারের সঙ্গে সাহরি করতেন। সাহাবিদের সঙ্গেও সাহরি খেতেন কখনো কখনো। সাহরির পর রোজার নিয়ত করতেন। সাহরিতে সামান্য খাবার খেতেন। কখনো শুধু কয়েকটি খেজুর খেয়ে রোজা রাখতেন, আবার কখনো অন্য কোনো খাবার খেতেন এবং পানি পান করতেন। সাধারণত তিনি সাহরি খেয়ে রোজা রাখতেন। আবার কখনো কখনো লাগাতার দু-তিন দিন কিছু না খেয়ে রোজা রাখতেন। তবে উম্মতকে তিনি ধারাবাহিক রোজা থেকে নিরুৎসাহ করেছেন।

সাহরির পর তিনি নামাজ পড়তেন। পঞ্চাশ আয়াত তিলাওয়াত করা যায় এই পরিমাণ সময় দীর্ঘ হতো তাঁর এই নামাজ। এরই মধ্যে ফজরের আজান হতো। আজানের পর তিনি কিরাত (কোরআন পাঠ) দীর্ঘ না করে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ পড়তেন এবং ফজরের নামাজের জন্য অপেক্ষা করতেন। হজরত বেলাল (রা.) রাসুলুল্লাহ-এর অনুমতিক্রমে ইকামত শুরু করলে তিনি ঘর থেকে বের হতেন এবং ফজরের নামাজের ইমামতি করতেন।

ফজরের নামাজের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করতেন তিনি। সূর্যোদয়ের পর থেকে ২০ মিনিট বা একটু বেশি সময় পর্যন্ত তিনি জিকির করতেন। অতঃপর দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। আবার কখনো নামাজের পর সাহাবাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। তাঁদের খোঁজখবর নিতেন। নামাজ পড়ে তিনি ঘরে ফিরতেন এবং ঘরোয়া কাজে স্ত্রী-পরিবারকে সাহায্য করতেন। তিনি নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করতেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া জোহরের আজান পর্যন্ত ঘরে থাকতেন। আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। নামাজের পর সাহাবাদের সঙ্গে বিভিন্ন দ্বিনি বিষয়ে আলোচনা করতেন। তাঁদের বিধি-বিধান শেখাতেন। এ সময় তিনি রাষ্ট্রীয় অনেক কার্যক্রমও সম্পন্ন করতেন। রাসুল (সা.) সাধারণত দিনে ঘুমাতেন না। তবে দুপুরে সামান্য সময় বিশ্রাম (কায়লুলাহ) করতেন এবং অন্যদেরও বিশ্রাম নিতে বলতেন। আসরের নামাজের আজান হলে তিনি আবার মসজিদে যেতেন এবং নামাজ আদায় করে ঘরে ফিরে আসতেন।

ঘরে ফিরে তিনি ইবাদতে লিপ্ত হতেন। মাগরিবের আগেই তিনি জিকির ও দোয়ায় মগ্ন হতেন। আজান হওয়ার পর তিনি স্ত্রীদের ইফতার হাজির করতে বলতেন। ইফতার করে তিনি মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে যেতেন। তিনি ভেজা ও তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। সেটা না পেলে শুকনো খেজুর খেতেন। আর কোনো খাবার না থাকলে পানি দিয়ে ইফতার করতেন। হজরত আনাস (রা.) এমনটিই বর্ণনা করেছেন।

মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে রাসুল (সা.) ঘরে ফিরতেন এবং ঘরেই সুন্নত নামাজ পড়তেন। নামাজ শেষে এশা পর্যন্ত তিনি পরিবারকে সময় দিতেন। এশার আজান হলে তিনি এশার পূর্বের সুন্নত নামাজ আদায় করে মসজিদে যেতেন। এশার নামাজের ইমামতি করতেন।

তিনি তিনবার সাহাবাদের সঙ্গে জামাতে তারাবির নামাজ আদায় করেন। কিন্তু যখন ভয় হয় আল্লাহ হয়তো তারাবির নামাজ ফরজ করে দেবেন, তখন থেকে তারাবি না পড়েই ঘরে ফিরতেন এবং সেখানেই নফল নামাজ পড়তেন। এসব নামাজে তিনি দীর্ঘ কিরাত পড়তেন। নামাজ শেষে ঘুমিয়ে পড়তেন। বিতরের নামাজ অবশিষ্ট রাখতেন। তবে হজরত আয়েশা (রা.) বিতরের নামাজ না পড়ে ঘুমাতে চাইলে তিনি নিষেধ করেন এবং বলেন, ‘নিশ্চয় আমার চোখ ঘুমায়, কিন্তু আমার হৃদয় ঘুমায় না। নিয়ম হলো, মানুষ যেন ঘুমের আগে বিতরের নামাজ আদায় করে নেয়।’

কখনো কখনো রাসুল (সা.) রমজানের রাতে স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করতেন এবং ফজরের আজান পর্যন্ত ঘুমাতেন, যেন উম্মত ভুল ধারণাবশত নিজেদের ওপর কঠোরতা আরোপ না করে।

রমজানে রাসুল (সা.) অধিক পরিমাণ কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদ) করতেন। কখনো কখনো তাঁর পরিবারের নারী ও শিশুরা তাতে অংশ নিত। এ ছাড়া তিনি অধিক পরিমাণ তিলাওয়াত, নামাজ আদায়, আল্লাহর জিকির ও দান করতেন।

জীবনের শেষ ভাগে তিনি রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তবে মৃত্যুর বছর আল্লাহর রাসুল (সা.) ২০ দিন ইতিকাফ করেন। রমজানের শেষ দশকে রাসুলুল্লাহ (সা.) লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করতেন। সাহাবাদেরও এই সময় লাইলাতুল কদর অনুসন্ধানের নির্দেশ দিতেন। এ সময় তাঁর পরিবারকে রাত্রি জাগরণ করতে বলতেন। রমজানের শেষ দশকে রাসুলুল্লাহ (সা.) অধিক পরিমাণ দোয়া করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল!

আমি যদি লাইলাতুল কদরের সন্ধান পাই, কী দোয়া করব? তিনি বলেন, তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন কারিম, তুহিব্বুল আফওয়া ফা‘ফু আন্নি’ (হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি দয়ালু, ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। সুতরাং আমাকে আপনি ক্ষমা করুন। আল্লাহ তাআলা আমাদের রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে যথাযথ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন: