মাহে রমযান

মাহে রমযানঃ ফযীলত ও করণীয়

মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়াঃ মাহে রমযান বছরের বাকি এগার মাস অপেক্ষা অধিক মর্যাদাশীল ও বরকতপূর্ণ মাস। এ মাসের বিশেষত্ব অনেক। ১. এ মাসেই মানুষ ও জিন জাতির মুক্তির সনদ পুরো কুরআন মাজীদ একত্রে লাওহে মাহফূয থেকে প্রথম আসমানে বাইতুল ইযযতে অবতীর্ণ হয় এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট সর্বপ্রথম এ মাসেই ওহী অবতীর্ণ হয়।

কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ... রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৫

২. এ মাসে রহমতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। হাদীস শরীফে এসেছে- إِذَا كَانَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الرّحْمَةِ. রমযান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৭৯/২

৩. অন্য এক হাদীসে এ মাসের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে- إِذَا دَخَلَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الجَنّةِ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنّمَ، وَسُلْسِلَتِ الشّيَاطِينُ. যখন রমযান মাসের শুভাগমন হয়, জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২৭৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৭৯/১

৪. এ মাস জাহান্নাম থেকে নাজাত লাভের মাস। সুতরাং বেশি বেশি ইবাদত ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে মুক্তির পরওয়ানা লাভ করার এটিই সুবর্ণ সুযোগ। হাদীস শরীফে এসেছে-
إِنّ لِلهِ عِنْدَ كُلِّ فِطْرٍ عُتَقَاءَ. আল্লাহ তাআলা প্রত্যহ ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। -মুসনাদে আহমদ হাদীস ২২২০২

৫. ব্যবসায়ী মহলের একটি বিশেষ মৌসুম থাকে, যখন তাদের ব্যবসা হয় খুব জমজমাট ও লাভজনক। সে মৌসুমে বছরের অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আয় হয়। আখেরাতের ব্যবসায়ীদের জন্য আখেরাতের সওদা করার উত্তম মৌসুম হল এই রমযান মাস। কেননা এ মাসে প্রতিটি আমলের ছওয়াব অনেক গুণ বেশি লাভ হয়।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- عُمْرَةٌ فِي رَمَضَانَ تَعْدِلُ حَجّةً. রমযানের ওমরা হজ্ব সমতুল্য। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৯৩৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৯৮৬ অন্য এক বর্ণনায় (যা সনদের দিক থেকে দুর্বল) এসেছে- مَنْ تَقَرّبَ فِيهِ بِخَصْلَةٍ مِنَ الْخَيْرِ كَانَ كَمَنْ أَدّى فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ، وَمَنْ أَدّى فَرِيضَةً فِيهِ كَانَ كَمَنْ أَدّى سَبْعِينَ فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ.

রমযান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরয আদায় করল। আর যে এ মাসে একটি ফরয আদায় করল সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায় করল। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/৩০৫-৩০৬

অর্থাৎ এ মাসে নফল আদায় করলে অন্য মাসের ফরযের ন্যায় ছওয়াব হয়। আর এ মাসের এক ফরযে অন্য মাসের ৭০ ফরযের সমান ছওয়াব হয়। এ তো হল রোযা ছাড়া এ মাসের অন্যান্য আমলের ছওয়াব। আর রোযার ছওয়াব সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা নিজেই ইরশাদ করেন- إِنّ الصّوْمَ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ. নিশ্চয় রোযা আমার জন্য, আর এর প্রতিদান স্বয়ং আমিই দিব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১/১৬৫

এ ছওয়াবের পরিমাণ যে কত তা একমাত্র তিনিই জানেন। এ প্রসঙ্গে ‘রোযার ফযীলত’ শিরোনামে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। রমযান মাস রহমত, বরকত, মাগফিরাত, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভের মাস। তাই এ মাস পেয়েও যে ব্যক্তি স্বীয় গুনাহ মাফ করাতে পারল না তার জন্য স্বয়ং জিবরাঈল আ. বদদুআ করেছেন এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাহমাতুল্লিল আলামীন হয়েও আমীন বলে সমর্থন জানিয়েছেন। হাদীস শরীফে এসেছে-

أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ رَقَى الْمِنْبَرَ فَقَالَ: آمِينَ، آمِينَ، آمِينَ، قِيلَ لَهُ: يَا رَسُولَ اللهِ، مَا كُنْتَ تَصْنَعُ هَذَا؟ فَقَالَ: قَالَ لِي جِبْرِيلُ: رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ أَدْرَكَ أَبَوَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا لَمْ يُدْخِلْهُ الْجَنّةَ، قُلْتُ: آمِينَ. ثُمّ قَالَ: رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ لَمْ يُغْفَرْ لَهُ، فَقُلْتُ: آمِينَ. ثُمّ قَالَ: رَغِمَ أَنْفُ امْرِئٍ ذُكِرْتَ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ، فَقُلْتُ: آمِينَ.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে উঠে আমীন, আমীন, আমীন বললেন। তাঁকে বলা হল, হে রাসূল! আপনি তো এরূপ করতেন না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জিবরাঈল আমাকে বললেন, ঐ ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেয়েও (তাদের খেদমত করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। তখন আমি বললাম, আমীন।

অতপর তিনি বললেন, ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে রমযান পেয়েও নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না। আমি বললাম, আমীন। জিবরাঈল আবার বললেন, ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যার নিকট আমার নাম আলোচিত হল অথচ সে আমার উপর দরূদ পড়ল না। আমি বললাম, আমীন। -আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৬৪৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯০৮ আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে রমযানের হক আদায় করার তওফীক দান করুন এবং নবীজীর অভিসম্পাৎ থেকে রক্ষা করুন। আমীন!

রমযানের করণীয় রোযা : রমযান মাসে রোযা রাখা ফরয। এটা এ মাসের বিশেষ আমল। সকল আদব রক্ষা করে পুরো মাস রোযা রাখা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য। তারাবীহ : রমযানের রাতের বিশেষ আমল হল কিয়ামে রমযান তথা বিশ রাকাত তারাবীহ। এ মাসের অফুরন্ত রহমত ও মাগফিরাত লাভ করার জন্য এবং

প্রতিশ্রুত ছওয়াব ও পুরস্কার পাওয়ার জন্য তারাবী নামাযের ভ‚মিকা অনেক। দান করা : দান-সদকা সর্বাবস্থাতেই উৎকৃষ্ট আমল, কিন্তু রমযানে এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। হাদীস শরীফে এসেছে- كَانَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَجْوَدَ النّاسِ بِالخَيْرِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন। রমযান মাসে তাঁর দানের হস্ত আরো প্রসারিত হত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০২

কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত : এ মাস কুরআন অবতরণের মাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীল আ.-এর সাথে রমযানের প্রত্যেক রাতে কুরআন মাজীদ দাওর করতেন। হাদীস শরীফে এসেছে- وَكَانَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السّلاَمُ يَلْقَاهُ كُلّ لَيْلَةٍ فِي رَمَضَانَ، حَتّى يَنْسَلِخَ، يَعْرِضُ عَلَيْهِ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ القُرْآنَ.

হযরত জিবরীল আ. রমযানের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন মাজীদ শোনাতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০২

অতএব আমাদের প্রত্যেকের উচিত রমযানে অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করা। অন্তত একবার হলেও কুরআন মাজীদ খতম করা। সালাফে সালেহীনের জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁরা এবং পরিবারের সদস্যগণ প্রত্যেকে রমযানে বহুবার কুরআন মাজীদ খতম করতেন।

নফল ইবাদত : এ মাসে শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে। এই সুযোগে অধিক পরিমাণে নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করা যায়। এ মাসে যে কোনো ইবাদত নিয়মিত করতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না এবং পরবর্তীতে তা সহজেই অভ্যাসে পরিণত হয়। সুতরাং যিকির-আযকারের সঙ্গে অধিক পরিমাণে নফল নামায আদায় করা উচিত। অন্তত বিভিন্ন সময়ের নফল নামাযগুলো আদায় করা যেমন- ইশরাক, চাশত, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি।

আফসোসের বিষয় এই যে, রমযানে সাহরীতে উঠলেই দু-চার রাকাত তাহাজ্জুদ নামায সহজেই পড়া যায়। বছরের অন্য দিনের মতো কষ্ট করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অমনোযোগী হওয়ার ফলে কিংবা সাহরীতে অতি ভোজনের কারণে তাহাজ্জুদ আদায়ের সুযোগ হয়ে ওঠে না।

দুআ করা : এ মাস রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের মাস। তাই বেশি বেশি আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হয়ে কান্না-কাটি করে দুআ করা একান্ত কাম্য। মাগফিরাত কামনা করা : যে ব্যক্তি রমযান পেয়েও স্বীয় গুনাহসমূহ ক্ষমা করাতে পারল না তার উপর জিবরীল আ. ও দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। তাই জীবনের কৃত গুনাহের কথা স্মরণ করে বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করা এবং আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমা মঞ্জুর করিয়ে নেওয়ার এটিই উত্তম সময়। বিশেষ করে ইফতার ও তাহাজ্জুদের সময় আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমা চাওয়া এবং দুআ করা উচিত।

ইতিকাফ: শেষ দশকের মাসনূন ই‘তিকাফ অত্যন্ত ফযীলতের আমল। হাদীস শরীফে এসেছে- أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭১; সহীহ বুখারী, হাদীস ২০৩৩

শবে কদর অন্বেষণ: ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করে সহস্র রজনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও উত্তম রাত-লাইলাতুল কদর তালাশ করা কর্তব্য। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ فِیْ لَیْلَةِ الْقَدْرِ، وَ مَاۤ اَدْرٰىكَ مَا لَیْلَةُ الْقَدْرِ، لَیْلَةُ الْقَدْرِ خَیْرٌ مِّنْ اَلْفِ شَهْرٍ، تَنَزَّلُ الْمَلٰٓىِٕكَةُ وَ الرُّوْحُ فِیْهَا بِاِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ اَمْرٍ، سَلٰمٌ، هِیَ حَتّٰی مَطْلَعِ الْفَجْرِ۠.

নিঃসন্দেহে কদরের রাতে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি। আর আপনি কি জানেন শবে কদর কী? শবে কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ রাতে ফেরেশতা ও রূহুল কুদ্স (জিবরাঈল আ.) তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক মঙ্গলময় বস্তু নিয়ে (পৃথিবীতে) অবতরণ করে। (এ রাতের) আগাগোড়া শান্তি, যা ফজর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। -সূরা কদর

রোযার হাকীকতঃ ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের মধ্যে ঈমান, নামায ও যাকাতের পরই রোযার স্থান। হাদীস শরীফে এসেছে- بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسَةٍ، عَلَى أَنْ يُوَحّدَ اللهُ، وَإِقَامِ الصَلَاةِ، وَإِيتَاءِ الزّكَاةِ، وَصِيَامِ رَمَضَانَ، وَالْحَجِّ.

পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত : আল্লাহ তাআলাকে এক বলে স্বীকার করা, নামায কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমযানের রোযা রাখা ও হজ্ব পালন করা। -সহীহ মুসলিম ১/৩২ সুতরাং রমযানের পূর্ণ মাস রোযা রাখা ফরয। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ. হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর (রমযানের) রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের উপর ফরয করা হয়েছিল। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৩

শরয়ী ওযর ছাড়া যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত একটি রোযাও পরিত্যাগ করে সে নিকৃষ্ট পাপী। দ্বীনের মৌলিক ফরয লংঘনকারী এবং ঈমান ও ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারীরূপে পরিগণিত হবে। আর এ কারণে সে রোযার যে মঙ্গল ও বরকত থেকে বঞ্চিত হবে কস্মিণকালেও তার ক্ষতিপূরণ করতে পারবে না। এমনকি এ রোযার কাযা করে নিলেও তা ফিরে পাবে না। হাদীস শরীফে এসেছে- مَنْ أَفْطَرَ يَوْمًا مِنْ رَمَضَانَ مِنْ غَيْرِ رُخْصَةٍ وَلَا مَرَضٍ، لَمْ يَقْضِ عَنْهُ صَوْمُ الدّهْرِ كُلِّهِ وَإِنْ صَامَهُ.

যে ব্যক্তি কোনো ওযর বা অসুস্থতা ব্যতিরেকে রমযানের একটি রোযা পরিত্যাগ করবে সে যদি ঐ রোযার পরিবর্তে আজীবন রোযা রাখে তবুও ঐ এক রোযার ক্ষতিপূরণ হবে না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭২৩

অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় এই যে, আমাদের সমাজে অনেক সবল-সুঠাম দেহের অধিকারী ব্যক্তিও অকারণে, সামান্য ছুতায় অসুস্থ হওয়ার অমূলক আশংকায় রোযা পরিত্যাগ করে। এতে তারা আখেরাতের কত বড় ক্ষতি নিজের উপর টেনে নিচ্ছে তা একটু ভেবেও দেখে না।

রোযার অর্থ : রোযা একটি ফারসী শব্দ। এর আরবী হল ‘ছওম’। ছওম এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় ‘জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন মুসলমানের উপর সুবহে সাদিক তথা দিনের একেবারে শুরু ভাগ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোযাভঙ্গকারী অন্যান্য কার্যাদি থেকে বিরত থাকার নামই হল ‘সওম’ বা ‘রোযা’।’

রোযার ইতিবৃত্তঃ রোযা এমন একটি ইবাদত, যা বাহ্যত কষ্টকর হলেও তার প্রচলন ছিল সর্বকালে। হযরত আদম আ.-এর যুগ থেকে শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবীর উম্মতের উপরই তা ফরয ছিল। -রূহুল মাআনী ২/৫৬

অবশ্য পূর্ব যুগে রোযার ধরন ছিল বিভিন্ন প্রকৃতির। রোযা রাখার পদ্ধতির ভিন্নতা ছাড়াও ফরয রোযার সংখ্যাও বিভিন্ন রকম ছিল। প্রাথমিক অবস্থায় উম্মতে মুহাম্মদীর উপরও কেবলমাত্র আশুরার রোযা ফরয ছিল। রমযানের রোযার ফরয বিধান আসার পর আশুরার রোযা ফরয হওয়ার হুকুম রহিত হয়ে যায়। -মাআরিফুস সুনান ৫/৩২৩ উল্লেখ্য, রোযা ফরয হয় হিজরতের দেড় বছর পর, ১০ শাবানে। রোযা ফরয হওয়ার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোট ৯টি রমযান পেয়েছিলেন।

রোযার হেকমতঃ রোযার হেকমত তথা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে একটি কথা ভালোভাবে জানা থাকা দরকার। তা এই যে, মহিয়ান গরিয়ান আল্লাহ তাআলা হলেন মহান স্রষ্টা ও মহা মুনিব আর মানুষ হল তাঁর ক্ষুদ্র সৃষ্টি ও দাস। এ সম্পর্কের দাবি হল, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রতিপালক যে কোনো নির্দেশ দিবেন, মানুষ সর্বদা প্রস্তুত থাকবে তা পালনের জন্য।

ঐ নির্দেশের হেকমত (তাৎপর্য) তার বুঝে আসুক বা না আসুক। সুতরাং মহান আল্লাহ তাআলা যেসব ইবাদতের নির্দেশ দিবেন, সেগুলোর কোনো কারণ বা তাৎপর্য জানা না থাকলেও তৎক্ষণাৎ নতশিরে তা মেনে নেওয়াই হচ্ছে বান্দার দায়িত্ব।

বলাবাহুল্য, শরীয়ত নির্দেশিত কোনো ইবাদতই তাৎপর্যহীন বা যুক্তিবিরোধী নয়। তবে সব কিছুর যুক্তি বা হেকমতই যে বান্দার জানা থাকবে বা বান্দার জ্ঞান-বুদ্ধি তাকে স্পর্শ করতে পারবে এমনটি ভাবা ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ তাআলা বান্দাকে অতি সামান্য জ্ঞানই দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- وَ مَاۤ اُوْتِیْتُمْ مِّنَ الْعِلْمِ اِلَّا قَلِیْلًا. তোমাদেরকে অতি সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৮৫

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশসমূহে কত হেকমত, কত কারণ এবং কত উদ্দেশ্যই থাকতে পারে, বান্দার কত কল্যাণই তাতে নিহিত থাকতে পারে। অসীম জ্ঞানের অধিকারী সে সত্তার নির্দেশসমূহ তাৎপর্য সসীম জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কীভাবে বুঝতে পারবে! তবুও ইসলামী পণ্ডিতগণ বিভিন্ন ইবাদতের বিভিন্ন ধরনের হেকমত বর্ণনা করেছেন। রোযার ব্যাপারেও বিভিন্ন হেকমতের কথা তাঁরা বলেছেন।

যদিও শরীয়তের নির্দেশ মান্য করা এ সকল হেকমত বুঝে আসার সাথে সম্পর্কিত নয় তথাপি সম্মানিত পাঠকমণ্ডলীর কৌতুহল নিবারণের উদ্দেশ্যে নিম্নে রোযার দু-একটি হেকমত সম্পর্কেও আলোকপাত করা হল।

‘আল্লাহ তাআলা মানুষের স্বভাবে যে ফেরেশতা সুলভ বৈশিষ্ট্য চরিত্র গচ্ছিত রেখেছেন, তার উন্নতি ও উৎকর্ষসাধন এবং নফস ও প্রবৃত্তির দমন ও নিবৃত্তির অন্যতম মাধ্যম হল রোযা। কানা‘আত, আত্মশুদ্ধি, সবর-শোকর, তাকওয়ার মতো বৈশিষ্ট্যগুলোর উন্নতি ও বিকাশে রোযার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উপরন্তু রোযার মাধ্যমে মানুষ উদার ও প্রবৃত্তিরথ জৈবিক তাড়না হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে ঊর্ধ্বজগৎ তথা আপন স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগসূত্র স্থাপনে সক্ষম হয়।

তাছাড়া নিরেট চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য বছরের কিছু দিন অবশ্যই পানাহার বর্জন করা উচিত। এটি স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী। তাই হিন্দু-খ্রিস্টান সকল ধর্মেই রোযার মতো উপবাস করার প্রচলন রয়েছে। (যদিও ইসলামের রোযার সাথে সেসব উপবাসের পদ্ধতিগত কোনো মিলই নেই)। (আরকানে আরবাআ : ২৬৪)

রোযার ফযীলতঃ প্রত্যেক নেক আমলের বিভিন্ন ফযীলত ও ছওয়াব রয়েছে, যা দ্বারা মহান রাব্বুল আলামীন আমলকারীকে পুরস্কৃত করবেন, কিন্তু রোযার বিষয়টি একেবারেই স্বতন্ত্র। কারণ রোযার বহুবিধ প্রতিদান ছাড়াও এ বিষয়ে একটি অতুলনীয় ঘোষণা রয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- كُلّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ، الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعمِائَة ضِعْفٍ، قَالَ اللهُ عَزّ وَجَلّ: إِلّا الصّوْمَ، فَإِنّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ.

মানুষের প্রত্যেকটি আমল বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। একটি নেকী (ছওয়াব) ১০ গুণ থেকে (ক্ষেত্র বিশেষে) ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : কিন্তু রোযার ব্যাপারটি ভিন্ন। কারণ রোযা আমার জন্য। সুতরাং তার প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১/১৬৪; সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৪

এ হাদীসে দু’টি বিষয় প্রণিধানযোগ্য: ১. রোযা ছাড়া অন্যান্য সব আমলের ছওয়াব বৃদ্ধির ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। তা হল ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত। এটি সাধারণ নিয়ম। আল্লাহ তাআলা চাইলে বিশেষ ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশিও প্রদান করতে পারেন। তবে সাধারণত সব আমলের ছওয়াব এ নীতির মাধ্যমেই নির্ণিত হয়। কিন্তু রোযার বিষয়টি স্বতন্ত্র। কারণ এর ছওয়াবের নির্ধারিত কোনো সীমারেখা নেই; বরং আল্লাহ তাআলা নিজে এর ছওয়াব প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। এর পরিমাণ যে কত হবে তা একমাত্র তিনিই জানেন।

রোযার এত বড় ফযীলতের একটি বাহ্যিক কারণ এও হতে পারে যে, রোযা ধৈর্য্যরে ফলস্বরূপ। আর ধৈর্যধারণকারীদের জন্য আল্লাহ তাআলার সুসংবাদ হল- اِنَّمَا یُوَفَّی الصّٰبِرُوْنَ اَجْرَهُمْ بِغَیْرِ حِسَابٍ. ধৈর্য ধারণকারীগণই অগণিত সওয়াবের অধিকারী হবে। -সূরা যুমার (৩৯) : ১০

২. সকল ইবাদত আল্লাহর জন্য। রোযার বহুবিধ বিশেষত্বের কারণে শুধু তাকেই নিজের জন্য খাস করে নিয়েছেন এবং বলেছেন- ‘রোযা তো আমারই জন্য’। তাই রোযার প্রতিদান তিনি নিজেই দান করবেন এবং বে-হিসাব দান করবেন বলে তিনি রোযাদারকে সুসংবাদ দান করেছেন। -লাতায়িফ ১৬৮-১৭০ হাদীস শরীফে রোযাদারের জন্য বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার ও প্রতিদানের কথা বিবৃত হয়েছে। সেগুলোর কয়েকটি নিম্নে তুলে ধরছি : ১. রোযা কিয়ামতের দিবসে সুপারিশ করবে হাদীস শরীফে এসেছে- الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَقُولُ الصِّيَامُ: أَيْ رَبِّ، مَنَعْتُهُ الطّعَامَ وَالشّهَوَاتِ بِالنّهَارِ، فَشَفِّعْنِي فِيهِ، وَيَقُولُ الْقُرْآنُ: مَنَعْتُهُ النّوْمَ بِاللّيْلِ، فَشَفِّعْنِي فِيهِ ، قَالَ: فَيُشَفّعَانِ.

রোযা ও কুরআন মাজীদ কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে পূর্ণ বিরত রেখেছি। তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। কাজেই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতপর তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৬২৬; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১৪৬৭২; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/৫১৯

২. রোযা জাহান্নামের আগুনের ঢাল ও দুর্গঃ হাদীস শরীফে এসেছে- الصِّيَامُ جُنّةٌ، وَحِصْنٌ حَصِينٌ مِنَ النّارِ. রোযা জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের জন্য একটি ঢাল এবং দুর্গ। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯২২৫

৩. রোযাদার জান্নাতের রাইয়ান নামক শাহী তোরণ দিয়ে প্রবেশ করবে এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- إِنّ فِي الجَنّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرّيّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصّائِمُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ. জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি শাহী তোরণ আছে, যা দিয়ে একমাত্র রোযাদারগণই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ সে তোরণ দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (আর যে ব্যক্তি সে রাইয়ান গেট দিয়ে প্রবেশ করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না।) -সহীহ বুখারী ১/২৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫২

৪. রোযাদারের জীবনের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবেঃ হাদীস শরীফে এসেছে- مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ. যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাস সহকারে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমযানের রোযা রাখে, আল্লাহ পাক তার জীবনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০১

৫. রোযাদারের দুআ কবুল হয়ঃ হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে- ثَلَاثَةٌ لَا تُرَدّ دَعْوَتُهُمُ: الصّائِمُ حَتّى يفطر، والإمام العادل، ودعوة المظلوم. তিন ব্যক্তির দুআ ফেরত দেওয়া হয় না : রোযাদার ব্যক্তির দুআ; ইফতার পর্যন্ত, ন্যায়পরায়ণ শাসকের দুআ ও মযলুমের দুআ। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৪২৮

৬. রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দঃ হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে- لِلصّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ. রোযাদার ব্যক্তির আনন্দ উপভোগের দুটি বিশেষ মুহূর্ত রয়েছে। একটি ইফতারের সময়, অপরটি স্বীয় প্রভূর সাথে সাক্ষাতের সময়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১/১৬৪; সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৪

৭. রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও সুঘ্রাণযুক্তঃ রোযার কারণে মুখে যে দুর্গন্ধ হয় আল্লাহ তাআলা তারও মূল্যায়ন করেছেন কল্পনাতীতভাবে। অনাহারের কারণে সৃষ্ট দুর্গন্ধ তাঁর কাছে মিশকের চেয়েও অধিক সুঘ্রাণযুক্ত বলে জানিয়েছেন আর ধন্য করেছেন তাঁর প্রেমে মত্ত রোযাদারদের।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- لَخلُوفُ فَمِ الصّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ. নিশ্চয় রোযাদারে মুখের (পানাহার বর্জনজনিত) গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধি অপেক্ষা উত্তম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৪

এখানে উল্লেখ্য যে, বর্ণিত হাদীসে দুর্গন্ধ দ্বারা ঐ গন্ধকেই বুঝানো হয়েছে, যা পানাহার বর্জনের কারণে পেটের ভিতর থেকে উত্থিত হয়। দাঁত ও মুখ অপরিষ্কার রাখার কারণে যে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয় তা এখানে উদ্দেশ্য নয়। তাই রোযাদার ব্যক্তি অবশ্যই তার দাঁত ও মুখ পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে সচেতন থাকবে।

রোযার আদবঃ প্রথমে ‘আদব’ সম্পর্কে কিছু মৌলিক কথা পেশ করছি। ‘আদব’ অর্থ উৎকৃষ্ট রীতিনীতি, উত্তম পদ্ধতি ইত্যাদি। ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল কাজ-কর্ম, লেনদেন, সামাজিকতা, আচার-ব্যবহার এবং মন ও মানসের পরিশুদ্ধি ইত্যাদি সকল বিষয়ে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা যে রীতি ও নীতি নিজে অবলম্বন করেছেন এবং উম্মতকে তা অনুসরণ করতে বলেছেন তারই নাম হল আদব।

ইসলামে আদবের (তা যে কোনো বিভাগেরই হোক না কেন) স্থান অনেক ঊর্ধ্বে। এগুলো কোনো অনর্থক বা অতিরিক্ত জিনিসের মতো নয়; বরং তা ইসলামের যাবতীয় হুকুম-আহকামের মৌলিক উদ্দেশ্যেরই অন্তর্ভুক্ত।

ইবাদত সংক্রান্ত আদাবসমূহ এজন্যও যত্নের সাথে পালনীয় যে, বিশেষত প্রত্যেক ইবাদতের ফযীলত, বরকত ও ফলাফল তখনই যথাযথভাবে পাওয়া যাবে যখন সে ইবাদতের যাবতীয় আদবের প্রতি যত্নবান হয়ে তা আদায় করা হবে। আজ ঈমানী দুর্বলতার কারণে আদব শব্দটি শুনতেই একটি নেতিবাচক অর্থের দিকে কারো কারো মন ধাবিত হয়। তা এই যে, আদব মানেই তা ছেড়ে দেওয়া জায়েয। এটা ছাড়াও কাজ হয়ে যাবে। এসবের তেমন গুরুত্ব নেই ইত্যাদি। অথচ ঈমানের দাবি তো এই ছিল যে, আদব শব্দ শুনতেই তার ইতিবাচক দিকটি মনে জাগ্রত হওয়া। অর্থাৎ এটা করা উত্তম এবং এর এই এই উপকার রয়েছে।

আর এর দ্বারা ইবাদত সুন্দর হয় এবং কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে ইত্যাদি। এখানে একথাটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, যে কাজকে আদব বলা হবে তা সর্বদাই মুস্তাহাব পর্যায়ের আমল হবে- এটা অপরিহার্য নয়। অর্থাৎ ‘আদব’ শিরোনামে উল্লেখিত হলেই তা করা ও না করার স্বাধীনতা রয়েছে ধরে নেয়া ভুল। বরং কোনো কোনো সময় এমন বিষয়কেও আদব বলা হয়, যা ফরয কিংবা ওয়াজিব, এমনকি এর চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রোযার আদবসমূহের মধ্যে একটি আদব হল গীবত না করা।

এখন যদি এই ধারণা করা হয় যে, গীবত পরিহার করা যেহেতু ‘আদব’ বলে উল্লেখ করা হল তাহলে এটা একটা অনুত্তম কাজ। তবে নিঃসন্দেহে তা ভুল হবে। কেননা, গীবত সব সময়ের জন্যই হারাম এবং কবীরা গুনাহ। রমযানের মতো পূত-পবিত্র মাসে এবং রোযার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে তা জায়েয হবে কীভাবে? এ সময়ে তো এ থেকে বেঁচে থাকা পূর্বের তুলনায় আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। কাজেই আদব শব্দ শুনলেই বিষয়টিকে মুস্তাহাব মনে করে নেয়া নিতান্তই ভুল।

এছাড়া কিছু আদব এমন রয়েছে, যা ফিকহী হুকুম অনুযায়ী তো মুস্তাহাব পর্যায়ের বটে, কিন্তু তার সুফল ও উপকারিতা লক্ষ্য করলে একজন মুমিন কখনো তা অগ্রাহ্য করতে পারে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় নামাযের খুশু-খুযুকেই (একাগ্রতা)। এটাকে নামাযের ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুআক্কাদা কোনোটির সাথেই গণনা করা হয় না। অথচ একাগ্রতা বা খুশু-খুযুই হল নামাযের রূহ তথা প্রাণ। এটির অনুপস্থিতিতে যদিও নামাযের ফরয আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু আল্লাহ তাআলার দরবারে একটি মাকবুল আমল হিসাবে গৃহীত হওয়া এবং নামাযের বিশেষ সুফল ও উপকার লাভ করা খুশু-খুযুর উপরই নির্ভরশীল। এটা শরীয়তের অনেক বড় অনুগ্রহ যে, নামাযের ফরয থেকে নিষ্কৃতি পাওয়াকে এর সঙ্গে শর্তযুক্ত করে দেয়নি। অন্যথায় আমাদের মতো দুর্বল ঈমান ও অস্থির চিত্ত লোকদের জন্য তা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যেত। কিন্তু তাই বলে খুশু-খুযুর প্রতি উদাসীনতার পরিচয় দেওয়া আদৌ সমীচীন হবে না।

সারকথা এই যে, ইসলামের আদবসমূহের ব্যাপারে একজন মুমিনের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই ইতিবাচক হওয়া উচিত। যাতে তা অবলম্বন করার সৌভাগ্য হয় এবং ইবাদতের সুফলসমূহ অর্জিত হয়। আদব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত জরুরি ভূমিকাটির পর মূল বিষয় অর্থাৎ রোযার আদব সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রোযার ব্যাপারে যেসমস্ত ফযীলত, বরকত ও পুরস্কারের ওয়াদা রয়েছে, তা পেতে হলে এবং কাক্সিক্ষত লক্ষ্য তথা আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য্য, তাকওয়া ও খোদাভীতি অর্জন করতে হলে শুধু পানাহার ও স্ত্রীসম্ভোগ ত্যাগ করাই যথেষ্ট নয়। কারণ, এগুলো হচ্ছে রোযার দেহ-কাঠামো। আর তার রূহ হল তার আদবসমূহ। তাই রোযার আদবসমূহের ব্যাপারে যত্নবান না হলে রোযার উপরোক্ত ফযীলত ও বরকতসমূহ অর্জিত হবে না।

রোযার আদবসমূহঃ ১) দৃষ্টিকে সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে হেফাযত করা। যেমন বেগানা মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকে, টিভি-সিনেমা দেখা থেকে বিরত থাকা। ২) যবানের হেফাযত। অর্থাৎ মিথ্যা, গীবত-পরনিন্দা, অশ্লীল কথাবার্তা ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে দূরে থাকা। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে- مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزّورِ وَالعَمَلَ بِهِ، فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ.

যে ব্যক্তি রোযা অবস্থায় মিথ্যাচারিতা ও মন্দ কাজ করা পরিত্যাগ করেনি তার পানাহার পরিত্যাগের কোনোই গুরুত্ব আল্লাহর কাছে নেই। আল্লাহ তাআলা তার পানাহার ত্যাগ করার কোনোই পরোয়া করেন না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৩ অন্য এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ.

রোযা অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন কোনো অশ্লীল কিংবা মন্দ কথা না বলে। যেন কোনো প্রকার শোরগোল, হট্টগোলে লিপ্ত না হয়। যদি অন্য কেউ তাকে গালিগালাজ করে কিংবা মারধোর করে তবে সে যেন (তদ্রƒপ আচরণ বা গালির প্রতিউত্তরে গালি না দিয়ে) শুধু এতটুকু জানিয়ে দেয় যে, আমি রোযাদার। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৪

এতে প্রতীয়মান হয় যে, রোযা অবস্থায় মারধর ঝগড়াঝাটি তো দূরের কথা, শোরগোল করাও রোযার আদব পরিপন্থী। অতএব যবানকে এসব থেকে বিরত রেখে সর্বদা যিকির-আযকার ও কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে তরতাজা রাখবে। অন্তত চুপ থাকলেও রোযার বরকত বিনষ্ট হওয়া থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

৩) কানকে সর্বপ্রকার গুনাহের কাজ থেকে হেফাযত করা। যেমন গানবাদ্য, গীবত, পরনিন্দা ও অশ্লীল কথাবার্তা শোনা থেকে দূরে থাকা। ৪) এছাড়া অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হাত ও পা ইত্যাদিকে গুনাহ ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা।

৫) সাহরী ও ইফতারে হারাম আহার পরিহার করা। ইমাম গাজ্জালী রাহ. বলেন, যে ব্যক্তি সারাদিন রোযা রেখে হারাম মাল দ্বারা ইফতার করল, সে যেন একটি অট্টালিকা নির্মাণ করল এবং একটি শহর ধুলিস্যাত করে দিল।

৬) রোযা অবস্থায় আল্লাহ তাআলার আযমত ও বড়ত্বের কথা এবং তাঁর হুকুম আহকাম বেশি বেশি স্মরণ রাখা। রোযাদারের অন্তরে এ চিন্তা জাগরুক থাকা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা হাযির নাযির আছেন। আমি তাঁর হুকুমে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পানাহার ত্যাগ করেছি। তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমাকে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকতে হবে।

এভাবে এক মাস রোযা রাখা সম্ভব হলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাকওয়া ও সংযমের মহামূল্য সম্পদ দান করবেন, যার মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন প্রভূত কল্যাণের দ্বার উন্মুক্ত হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন- আমীন।

শেয়ার করুন: