কৃতজ্ঞতা আপনার হে নবী ইউসুফ!

পবিত্র কোরআনের ১২ নং সূরায় নবী ইউসুফ (আ.)-এর কাহিনী ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর কাহিনী শুধুমাত্র ওই সূরায় উল্লিখিত হয়েছে। সমগ্র কোরআনে কোথাও এর পুনরাবৃত্তি করা হয় নি। এটা একমাত্র ইউসুফ (আ.) সম্পর্কিত কাহিনীর বৈশিষ্ট্য। এছাড়া অন্যসব নবীর কাহিনী ও ঘটনাবলী সমগ্র কোরআনে প্রাসঙ্গিকভাবে খণ্ড খণ্ডভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বার বার উল্লেখ করা হয়েছে।

বস্তুত সূরা ইউসুফে রয়েছে মানবজাতির জন্য মহা মূল্যবান কতগুলো উপদেশ, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার উপকরণ। তাফসিরবিদ আলেম ও লেখকগণ সেগুলো আমাদের জন্য সহজভাবে উপস্থাপন করে দিয়েছেন। এজন্য এসব শিক্ষার মূলকেন্দ্র নবী ইউসুফ (আ.)-এর কৃতজ্ঞতা আদায় আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই আলোকেই কিছু পয়েন্ট এখানে তুলে ধরা হলো।

১. কৃতজ্ঞতা আপনার হে নবী ইউসুফ! আপনার ঘটনা থেকে আমরা শিখতে পারলাম যে, কিছু মানুষ আমাদেরকে ঘৃণা ও বিদ্বেষ করে আমাদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী দেখে, আমাদের দোষত্রুটির কারণে নয়। ওরা (আপনার ভাইয়েরা) আপনার প্রতি হিংসা করেছিল; কেননা আপনি ছিলেন সুন্দর ও ভদ্র, তাদের মতো নয়। মানুষ ওইসব লোককে দেখতে চায় না যারা তাদের ত্রুটি স্মরণ করিয়ে দেয়।

২. শিখতে পারলাম যে, আঘাত কখনও এমন দিক থেকেও আসতে পারে; যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আপনি যেখানে বাঘের আক্রমণ থেকে নিরাপদ ছিলেন, সেখানে নিজের ভাইদের ষড়যন্ত্র থেকে নিরাপদ ছিলেন না!

৩. শিখতে পারলাম যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের যেসব কল্যাণ দান করেছেন, সবগুলো প্রত্যেকের নিকট বর্ণনা করা উচিত নয়। কেননা কিছু মানুষের দৃষ্টি সংকীর্ণ, কিছু মানুষের হৃদয় সংকীর্ণ; ওরা নিজেদের কাছে যা আছে- এসবের তুলনায় পরের কাছে যা আছে- সেসবের প্রতি বেশি তাকায়।

৪. শিখতে পারলাম যে, অপরাধীরা কখনও হিতাকাঙ্ক্ষীর পোশাক পরে নেয়। বিতাড়িত ইবলিস আদিপুরুষ নবী আদম (আ.)কে বলেছিল, 'আমি কি তোমাকে বলে দিব অনন্তকাল জীবিত থাকার বৃক্ষের কথা এবং অবিনশ্বর রাজত্বের কথা?' (সূরা ত্বোয়া-হা: ১২০) আর আপনার ভাইয়েরা আপনার বাবাকে বলেছিল, 'আমরা তো তার হিতাকাঙ্ক্ষী।' ( সূরা ইউসুফ: ১১) এবং 'আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণ করব।' (সূরা ইউসুফ: ১২)

৫. কিছু অনিষ্ট আরও কিছু অনিষ্টের তুলনায় হালকা হয়ে থাকে। সততা বিবেচনায় মানুষ যেভাবে কয়েকপ্রকার, তেমনি মন্দতার দিক দিয়ে মানুষ সমান নয়। আপনাকে আপনার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে কম খারাপ ভাইটি এই বলে রক্ষা করেছিল যে, 'তোমরা ইউসুফকে হত্যা করো না।'

৬. শিখতে পারলাম যে, আমরা নিজেই যেন বিপজ্জনক বিষয়গুলো প্রকাশ না করি, যাতে মানুষ এগুলোর অজুহাত দেখিয়ে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে। আপনার বাবা যেখানে বলেছিলেন, 'আমি আশঙ্কা করি যে, ব্যাঘ্র তাঁকে খেয়ে ফেলবে।' (সূরা ইউসুফ: ১৩) সেখানে তাঁকে আপনার ভাইয়েরা বলে দিল যে, আপনাকে বাঘ খেয়ে ফেলেছে।

৭. শিখতে পারলাম যে, এমন কোনো পূর্ণাঙ্গ অপরাধ পাওয়া যাবে না, যেখানে অপরাধী ঘটনার সবগুলো খুঁটিনাটি বিষয় বলে দিতে পারবে এবং কোনো কিছু ছুটবে না। আপনার ভাইয়েরা আপনার জামা ছিঁড়ে ফেলতে ভুলে গিয়েছিল। এ কেমন বাঘ! একটি শিশুকে জ্যান্ত খেয়ে ফেলল আর শিশুর জামা একেবারে ঠিক থাকল?

৮. শিখতে পারলাম যে, ভালো ও মন্দ বস্তুর মাঝে নয়, বরং বস্তুর ব্যবহার পদ্ধতির মাঝে। আপনার জামা একবার হয়েছিল মিছা রক্তের মাধ্যম, আরেকবার হয়েছিল স্বচ্ছতা প্রমাণের মাধ্যম, শেষবার হয়েছিল রোগনিরাময়ের মাধ্যম।

৯. শিখতে পারলাম যে, এ দুনিয়া আসল কল্যাণের জায়গা নয়। কতইনা মন্দ এই দুনিয়া, যেখানে আপনার মতো ব্যক্তিকে মাত্র কিছু দিরহামের বিনিময় বেচাকেনা করা হলো!

১০. শিখতে পারলাম, স্কুল, মাদরাসা, কলেজ, ভার্সিটি তথা বিদ্যালয়গুলো একটি মাধ্যম মাত্র। প্রকৃত শিক্ষক হলেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। 'এবং এ জন্যে যে তাকে বাক্যাদির পূর্ণ মর্ম অনুধাবনের পদ্ধতি বিষয়ে শিক্ষা দেই।' (সূরা ইউসুফ: ২১) 'তখন তাকে প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি দান করলাম।' (সূরা ইউসুফ: ২২) আর আল্লাহ তায়ালা তাকওয়ার ভিত্তিতে জ্ঞান দান করেন। 'আল্লাহকে ভয় কর তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দেন।' (সূরা আল বাকারাহ: ২৮২) বিষয়টি মূলত বুদ্ধি ও বিবেকের নয়, বরং হৃদয় ও আত্মার।

১১. কৃতজ্ঞতা আপনার হে নবী ইউসুফ! আপনার কাহিনী থেকে আমরা শিখতে পারলাম যে, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ধোঁকা দেয় না, স্বাধীন ব্যক্তি অনুগ্রহের বিনিময়ে মন্দাচরণ করে না এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি যে কূপ থেকে পানি পান করে; কখনও সেই কূপে থুতু নিক্ষেপ করে না। আপনি কতইনা সুন্দর বলেছেন, 'আল্লাহ রক্ষা করুন; তোমার স্বামী আমার মালিক। তিনি আমাকে সযত্নে থাকতে দিয়েছেন।' (সূরা ইউসুফ: ২৩)

১২. শিখতে পারলাম যে, প্রকৃত আমানত হলো খেয়ানত করতে সক্ষম হয়েও নিজেকে বিরত রাখা এবং প্রকৃত চারিত্রিক নিষ্কলুষতা হলো ব্যভিচারের সামর্থ্য ও সুযোগ পাওয়ার পরও নিজেকে সংযম রাখা। আপনার ক্ষেত্রেও এমন সুযোগ এসেছিল, কিন্তু আপনার মতো মহান ব্যক্তি কখনও খেয়ানত কিংবা ব্যভিচার করতে পারেন না।

১৩. শিখতে পারলাম যে, সুরক্ষিত সেই; যাকে আল্লাহ রক্ষা করেন এবং বিভ্রান্ত সেই; যাকে আল্লাহ সমূহ খায়েশের জন্য মুক্ত ছেড়ে দেন। যে স্বাচ্ছন্দ্যের অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে থাকে, বিপদের সময় আল্লাহ তার সঙ্গে থাকেন।

১৪. তেমনি আমরা শিখতে পারলাম যে, সারা পৃথিবী একত্রিত হয়ে আমি যা চাই না; তা করতে আমাকে বাধ্য করতে পারবে না। সুতরাং অবস্থা, প্রেক্ষাপট ও পারিপার্শ্বিকতার অজুহাত দেখানোর কোনো মানে নেই। জুলাইখা ছিল আপনার মালিক, সে আপনার জন্য দরজাগুলো বন্ধ করে দিল, আপনাকে তার প্রতি আকর্ষিত করতে চাইল, রূপ-লাবণ, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব এবং আকর্ষণ সবই তার মাঝে ছিল- কিন্তু আপনি প্রতিরোধ করলেন, কেননা আমি তা কখনও চান নি।

১৫. শিখতে পারলাম যে, আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বিষয় প্রকাশ করে দিতে চান, সমগ্র মানবজাতি মিলেও তা গোপন রাখতে পারবে না।

১৬. কৃতজ্ঞতা আপনার হে নবী ইউসুফ! আপনার কাহিনী থেকে আমরা শিখতে পারলাম যে, জেলখানায় অনেক জুলুম করা হয়, মানুষ কখনও অপরাধে জড়িত না হওয়ার অপরাধে কারাগারে যেতে হয় এবং মানবসমাজে জুলুমের উপস্থিতি অনেক প্রাচীন।

১৭. শিখতে পারলাম যে, ঈমানের মিষ্টতা জীবনের তিক্ততার ওপর বিজয়ী। আপনার ঈমানের শক্তি ও মিষ্টতা কারাগারের অন্ধকার ও তিক্ততার সময় আপনাকে সান্ত্বনা জুগিয়েছে।

১৮. শিখতে পারলাম যে, সবখানে দাওয়াতের সুযোগ বিদ্যমান। রাজপ্রসাদে কৃতদাস থেকেও আপনি আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দিয়েছেন, কারাগারে বন্দী থেকেও আপনি আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দিয়েছেন এবং রাজসিংহাসনে বসে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও আপনি আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দিয়েছেন।

১৯. শিখতে পারলাম যে, স্থান কখনও মূল ধাতুকে পরিবর্তন করতে পারে না। কারাগারে থাকাবস্থায় আপনাকে বলা হলো 'আমরা আপনাকে সৎকর্মশীল দেখতে পাচ্ছি।' (সূরা ইউসুফ: ৩৬) তারপর রাজসিংহাসনে বসার পর আপনার ভাইয়েরা ক্ষমা চাইল, কেননা তারা আপনাকে 'সৎকর্মশীল' দেখতে পেয়েছিল।

২০. কৃতজ্ঞতা আপনার হে নবী ইউসুফ! আপনার কাহিনী থেকে আমরা শিখতে পারলাম যে, সব অনিষ্টের মূল হলো হিংসা। বস্তুত হিংসাই হলো প্রথম পাপ; যার দ্বারা আকাশে আল্লাহর অবাধ্যতা করা হয়েছে। ইবলিস আদম (আ.)কে সিজদ করল না; হিংসার কারণেই। হিংসাই হলো প্রথম পাপ; যারা জমিনে আল্লাহর অবাধ্যতা করা হয়েছে। কাবিল তার ভাই হাবিলকে হিংসার কারণেই হত্যা করেছিল। আর আপনাকে কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল একই হিংসার কারণে।

২১. শিখতে পারলাম যে, কখনও দুর্যোগ দেখা দেয় সুষ্ঠু পরিচালনার অভাবে, সম্পদের অভাবে নয়। আপনি যখন মিসরবাসীকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ থেকে উদ্ধার করেছিলেন, তখন তাদের জন্য আপনি নতুন কোনো সম্পদ সরবরাহ করেন নি। বরং নিত্যনতুন বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে পুরনো সম্পদকেই কাজে লাগিয়েছিলেন।

২২. শিখতে পারলাম যে, ভালোবাসার একটা ঘ্রাণ থাকে, যা একমাত্র প্রেমিকরাই অনুধাবন করতে পারে। সেজন্য আপনার জামা বাবা ইয়াকুব (আ.)-এর নিকট পৌঁছার আগেই তিনি এর ঘ্রাণ পেয়েছিলেন।

২৩. কৃতজ্ঞতা আপনার হে নবী ইউসুফ! আপনার কাহিনী থেকে আমরা শিখতে পারলাম যে, দুঃখ ও মর্মবেদনার কথা একমাত্র আল্লাহর নিকটই পেশ করতে হবে। কেননা মানুষ হয়তো আমাকে ভালোবাসে আর না হয় ঘৃণা করে। যদি ভালোবাসে তবে আমার চিন্তায় সে ব্যথিত হবে এবং ঘৃণা করলে আমার বিপদে সে আনন্দ পাবে। অথচ উভয়ই আমার কষ্ট লাঘবের কোনো ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং আমার দুঃখের কথা শুধুমাত্র তাঁকেই বলব; যিনি সব ক্ষমতার মালিক।

শেয়ার করুন: