নাপা শাক

নাপা শাক

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে নাপা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় শাক। এলাকা ও ভাষা ভেদে এই শাক নাপাশাক, নাফাশাক, লাফাশাক প্রভৃতি নামে পরিচিত। রংপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম প্রভৃতি জেলায় নাপাশাকের চাষ করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি নাপাশাকের চাষ হয় রংপুরের তারাগঞ্জ ও নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলায়। তারাগঞ্জে এ বছর প্রায় ৩৫ হেক্টর জমিতে নাপাশাকের আবাদ হয়েছে। বর্তমানে নাটোর জেলাতেও নাপা শাকের চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। নাটোর সদর উপজেলার হাজরা নাটোর গ্রামে দুই বছর ধরে নাপাশাকের চাষ হচ্ছে। রংপুরের স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে নাপাশাক নিয়ে অনেক প্রবাদ চালু আছে। অনেকের ধারণা নাপাশাকের ঝোল দিয়ে ভাত বেশি টানে। অর্থাৎ এ অঞ্চলে অন্য যে কোনো শাকের চেয়ে নাপাশাকের কদর বেশি। এ শাক যেমন অন্য শাকের চেয়ে মোলায়েম, তেমনি হালকা ঘ্রাণযুক্ত ও সুস্বাদু।

নাপা শাক

নাপা শাক হল মালভা গণের, মালভেসি পরিবারের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ যার পাতা ও গাছের কচি ডগা শাক বা পাতা সবজি হিসাবে খাওয়া হয়। এ শাক লাফা শাক নামেও পরিচিত।

ইংরেজি নাম: Malva parviflora

চা পাতা ও ফুল

বর্ণনাঃ

নাপাশাক একটি দ্রুতবর্ধনশীল গুল্ম প্রকৃতির গাছ। গাছ ১ থেকে ১.৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছের কাণ্ড ও পাতা বেশ নরম। পাতার আকৃতি অনেকটা তুলা বা ঢেঁড়স পাতার মতো, করতলাকার, তিন থেকে পাঁচটি গভীর খাঁজযুক্ত, উপরের চেয়ে নিচের পিঠ অপেক্ষাকৃত বেশি রোমশ। কাণ্ড গোলাকার ও মসৃণ। কাণ্ড থেকে বিপরীতমুখীভাবে পাতা গজায়। ফুল ছোট, মাইকের চোঙের মতো, সাদা বা হালকা বেগুনি রঙের। পাতার কক্ষে গুচ্ছাকারে ফুল ফোটে। বীজ দ্বারা বংশবিস্তার ঘটে। গাছ এক বর্ষজীবী। তবে জমিতে রেখে দিলে পরের বছরও মুড়ি গাছের গোড়া থেকে নতুন গাছ জন্মে।

বিস্তার

নাপাশাকের উৎপত্তি পূর্ব এশিয়ায়, সম্ভবত চীনে। চীনে এ ফসলটি আবাদীকরণের পর প্রায় ২৫০০ বছর ধরে চাষ হয়ে আসছে। চীনে এ ফসলটি বেশ ভালোভাবেই জন্মে। বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, পাকিস্তান, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, কোরিয়া, ইথিওপিয়াসহ অনেক দেশেই নাপাশাকের চাষ হচ্ছে।

খাদ্য হিসেবেঃ

আমাদের দেশে নাপা শুধু শাক হিসেবেই খাওয়া হয়। কিন্তু কিছু কিছু দেশ আছে যেখানে এর পাতা দিয়ে চা বানিয়ে খাওয়া হয়। নাপাশাকের পাতা ও বীজ কাঁচা এবং রান্না করে খাওয়া যায়। কাঁচা পাতা কুচি কুচি করে কেটে সালাদের সাথে যোগ করা যায়। বীজ থেকে বাদামের মতো ঘ্রাণ পাওয়া যায়। বীজ ভেজেও কেউ কেউ খায়। তবে আমাদের দেশে নাপাশাকের কচি কাণ্ড ও পাতাশাক হিসেবে খাওয়া হয়। শাক ভাজি বা ঝোল রেঁধে খাওয়া হয়। নাপাশাক দিয়ে উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী প্যালকা বা শোলকা রান্না করা হয়। নাপাশাকের সাথে খাবার সোডা দিয়ে প্যালকা রান্না করা হয়। এতে শাকের পাতা ও ডাঁটা গলে খুব নরম হয়ে ঝোলের সাথে মিশে যায়।

ভেষজ হিসেবে ব্যবহারঃ

ত্বকের ব্যথা-ফোলা কমাতে, শ্বাসজনিত রোগ ও পেটের পীড়া নিরাময়ে নাপাশাক ব্যবহার করা হয়।

এর পাতা দিয়ে চা বানিয়ে খাওয়া হতো শুষ্ক কাশি নিরাময়ের জন্য।

এর পাতায় ঢেঁড়সের পাতার মতো এক ধরনের পিচ্ছিল পদার্থ আছে। ত্বকের বিভিন্ন অসুখে এর পাতা বেটে মাখা হতো।

পায়ুতন্ত্রের যে কোনো গড়বড়, ডায়রিয়া ও ঘন ঘন তেষ্টা পাওয়া দূর করতে নাপাশাকে খাওয়া হতো।

হুপিং কাশির জন্য এর শিকড়ের রস খাওয়ানো হতো। এর পাতা ও কান্ডের হজমকারক শক্তি আছে। যেসব নারীরা বেশি বয়সে সন্তান নেয়, গর্ভাবস্থায় তাদের জন্য পরিমাণ মতো নাপাশাক খাওয়া উপকারী।

নাপার বীজে আছে পলিস্যাকারাইড, যা রক্তের শ্বেতকণিকা গঠনকে উদ্দীপিত করে।

ক্যানসার কোষ গঠন প্রতিহত করতেও নাপাশাক ও বীজর বিভিন্ন উপাদান ভূমিকা রাখতে পারে।

পার্শপ্রতিক্রিয়াঃ

তবে নাপাশাকের একটি পার্শ¦ প্রতিক্রিয়ার কথাও জানা গেছে। যদি নাইট্রোজেন জাতীয় সার যেমন ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে নাপাশাক চাষ করা হয় তাহলে পাতায় নাইট্রেট জমা হয় ও নাইট্রেটের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই পাতা শাক হিসেবে খেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। তবে শুধু জৈবসার দিয়ে চাষ করা নাপাশাকের গুণাগুণের কোনো তুলনা নেই, সেক্ষেত্রে এরূপ কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ভয় থাকে না। নাপার গাছ ও বীজ থেকে হলুদ, সবুজ ও ঘিয়া রঙ তৈরি করা যায়।

ফসল সংগ্রহঃ

বীজ বপনের প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর থেকে নাপাশাক তোলা শুরু করা যায়। গাছ ছোট অবস্থায় কচি ডগাসহ পাতা তোলা হয়। গাছ একটু বড় হলে শুধু পাতা তোলা হয় বা ছোট ছোট ডাল কেটে শাক সংগ্রহ করা হয়। এতে গোড়া থেকে আবার নতুন পাতা বের হয় ও পরে সেসব পাতাও শাক হিসেবে খাওয়া যায়। এভাবে ৩ থেকে ৪ দফায় এক মৌসুমে শাক তোলা যায়। হাফাশাক গাছের গোড়া রেখে সম্পূর্ণ গাছ কেটে ডালপালাসহ শাক সংগ্রহ করলেও তার গোড়া থেকে আবার নতুন ডালপালা বের হয়। মার্চ মাস পর্যন্ত শাক তোলা চলতে থাকে। ফেব্রæয়ারি-মার্চ মাসে নাপাশাকের গাছে ফুল আসে ও এপ্রিলে ফল পাকে। নাপাশাকের ফুল স্ব-পরাগী তবে পোকা দ্বারাও এর পরাগায়ন ঘটে। মার্চ-এপ্রিলে বীজ শুকিয়ে এলে তা সংগ্রহ করা হয়। একটি ফলে প্রায় ১০ থেকে ১৫টি বীজদানা পাওয়া যায়। সেসব বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে কাচের বোতলে বা বয়মে মুখ ভালোভাবে আটকে রেখে দিলে বীজ ভালো থাকে। পরের মৌসুমে সেসব বীজ দিয়ে আবার চাষ করা যায়। ফুল আসার পর শাকের স্বাদ কমে আসে ও তোলার অনুপযুক্ত হতে থাকে।

শেয়ার করুন: