দেলোয়ার হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
আইসিটি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, এবং ডেটা সেন্টার ইত্যাদিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ দেশের তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে একের পর এক কাজ করে যাচ্ছে তারমধ্যে ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ একটি।
এ প্রকল্পে আউটসোর্সিং ট্রেনিং এর মাধ্যমে নিজেকে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন প্রশিক্ষণার্থীরা। এ প্রকল্পের শর্তে প্রতিটি কোর্সে ৩০% নারী বাধ্যতামূলক করা হলেও আশানুরুপ সাড়া পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রণালয়ের দাবি লার্নিং এন্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে সারা দেশের তরুণ ও তরুণীদের আইটি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশে ৬৪টি জেলা ও ৪৯২টি উপজেলায় ‘লার্নিং এন্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে’র কার্যক্রম সফলতার সাথে শেষ হতে চলেছে।
কিন্তু বাস্তবে কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সরাসরি ক্লাস দেশের কিছু অঞ্চলে চালু হলেও পরবর্তীতে সেটি কিছু সময় অনলাইনে চালু রাখা হয়। এতে করে প্রশিক্ষণার্থীদের বড় অংশ প্রযুক্তি স্বল্পতা ও গ্রামের ধীরগতির ইন্টারনেট জটিলতায় ঝরে পড়ে।
আইসিটি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে বর্তমান প্রজেক্টের আওতায় ৪০ হাজার তরুণ-তরুণীকে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে, এই সল্প সময়ের প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণার্থীরা এই করোনা মহামারীর ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে ঘরে বসে আয় করেছে ২৭ লাখ মার্কিন ডলার, যা আউটসোর্সিং ইন্ডাস্ট্রিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।প্রতি ব্যাচে অবশ্যই ৩০% নারীদেরকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যাতে তারা কোন ক্রমেই পিছিয়ে না থাকে।
গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট এবং ডিজিটাল মার্কেটিং বিষয়ে ৫০ দিন বা ২০০ ঘন্টার এই প্রশিক্ষণে তরুণদের পাশাপাশি তরুনীদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ প্রদান শেষে মেন্টরিং ক্লাসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদেরকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উপায় হাতে কলমে শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণার্থীরা প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময় থেকেই আয় করতে শুরু করেছেন। ফলে আত্মবিশ্বাসের সাথে সাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তারা।
মাঠ পর্যায়ে ঢাকার কয়েকটি লটে প্রশিক্ষণ ও পকল্প সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে যানা যায় বর্তমানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আছে। প্রশিক্ষণার্থীদের একটি ফেসবুক ভিত্তিক গ্রুপে সরব থাকলেও তাদের সাথে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও প্রশিক্ষকদের কেউ যোগাযোগ রাখছে না। যদিও প্রকল্পের শর্তে ট্রেনিং পরবর্তী মেন্টরিংয়ের কথা বলা আছে। যা প্রকল্পের টেন্ডার পাওয়া ট্রেনিং বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেখভাল করার কথা।
এ বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কেউই প্রতিবেদকের সাথে নাম প্রকাশে কথা বলতে রাজি হননি। এ বিষয়ে তাদের মন্তব্য হলো মন্ত্রণালয়ে তাদের প্রকল্পের বিল আটকে আছে। গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ হলে বিল পেতে বিড়ম্বনা বাড়বে।
এদিকে প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিটি ব্যাচের সেরা ২ জন করে ৪ হাজার প্রশিক্ষণার্থীকে একটি করে ল্যাপটপ পুরস্কার দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কাউকেই সেই পুরস্কার দেয়া হয়নি। এ নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে একাধিক প্রশিক্ষণার্থীকে ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা গেছে।
সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ২০১৪ সাল থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (ওআইআই) এর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনলাইন শ্রমের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে। দেশের প্রায় ৬,৫০,০০০ নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে প্রায় ৫০০০০০ সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার নিয়মিত কাজ করছেন। মন্ত্রণালয়ের একাধিক প্রচারণায় দাবি করা হলেও বেসরকারি খাতের জরিপ বলছে ভিন্ন কথা।
আইসিটি মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশের সকল ফ্রিল্যান্সাররা বছরে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করছেন। লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে’র সফল বাস্তবায়নে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ বিষয়ে টেলি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব) আহবায়ক মো. মুর্শিদুল হক বলেন, ‘দেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে এক হাজার ৪১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৮.৭ শতাংশ বেশি হলেও বাংলাদেশের মত একটি জনবহুল ও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। ২০২১ সাল নাগাদ দেশের আইসিটি খাতের আয় ১০০ কোটি ডলার থেকে ৫০০ কোটি ডলারে উত্তীর্ণ করার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জন সম্ভব হয়েছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
তিনি বলেন, সারাবিশ্ব প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। নতুন পরাশক্তি হিসেবে চীনের আবির্ভার হয়েছে প্রযুক্তিতে চীনের বৈপ্লবিক উত্থানের ফলে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার পাশাপাশি ভিয়েতনামও এখন পোশাকখাতের পাশাপাশি প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদন ও রফতানিতে ব্যাপক উন্নতি করেছে। বাংলাদেশ সরকারও চেষ্টা করছে দেশকে প্রযুক্তি খাতে এগিয়ে নিতে। তবে এক্ষেত্রে সাফল্য পেতে আমাদেরকে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে দ্রুতগতিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এক্ষেত্রে টি-ক্যাব ৫ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে। সেগুলো হলো প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বিশেষ বরাদ্দ প্রদান। লার্নি অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষিত তরুণদের জন্য আরও বড় পরিসরে প্রশিক্ষণের নতুন প্রকল্প নেওয়া জরুরি। সারাদেশে নির্মাণাধীন হাইটেক পার্কগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে স্থাপন করে প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে দেশি-বিদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আকৃষ্ট করা এবং দেশে প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদন ও রফতানিতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ফ্রিল্যান্সিংকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ফ্রিল্যান্সারদের বিভিন্ন সমস্যা দূর করা এবং দেশে পেপাল চালু করা। কেননা ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়ার বায়াররা তাদের পেমেন্টের জন্য পেপাল ব্যবহার করতে বেশি পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের পেপাল একাউন্ট না থাকায় অন্যদেশের ফ্রিল্যান্সাররা বেশি সুবিধা পান।
গত বছর থেকে করোনা মহামারিতে লকডাউনের ফলে সারাদেশে অনেকটাই স্থবিরতা নেমে আসে। যদিও এক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছুটা সুফল পাওয়া গিয়েছে। তাই সারাদেশে শক্তিশালী মোবাইল নেটওয়ার্ক ও সহজলভ্য ইন্টারনেট সেবা ছড়িয়ে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচারবিভাগসহ দেশের সবখাতকে আরও প্রযুক্তিবান্ধব করতে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।