পিল

আসছে পিল, সাধারণ সর্দি-জ্বরের মতো সারবে করোনা

কোভিড চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কিছুটা নির্ভরযোগ্য অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ হিসেবে রেমডিসিভির ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে কিছু দেশ। তবে শুধু গুরুতর ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে এটি ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে।

এবার সংক্রমণের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর সাধারণ ফ্লুয়ের মতো ওষুধ খেয়ে কোভিড সারানোর সাফল্য অর্জন করতে যাচ্ছে মানুষ। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের প্রথমের দিকেই বাজারে আসবে করোনা প্রতিরোধী পিল। সেটি হলে, সাধারণ ভাইরাস জ্বরের মতো করোনার ওষুধও বাজারে কিনতে পাওয়া যাবে।

গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে বসবাসকারী গুরুতর কোভিড আক্রান্ত চল্লিশোর্ধ্ব এক দম্পতিকে বিশেষ একটি ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। কোভিড ধরা পড়ার পরপরই তাঁদের বাড়ির নিকটবর্তী ফ্রেড হাচ ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নিতে সম্মত হয়েছিলেন তাঁরা। সেখানেই তাঁদের দেওয়া হয় বিশেষ পিল। দিনে দুবার করে চারটি পিল খেতে বলা হয়েছে তাঁদের। অবশ্য তাঁদের বলা হয়নি এটি সত্যি ওষুধ নাকি প্লাসিবো ছিল। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের শরীরে কোভিডের লক্ষণগুলো মৃদু হতে শুরু করে এবং দ্রুতই তাঁরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।

মহামারিতে বিপর্যস্ত পৃথিবীর জন্য এই দম্পতির নাম হয়তো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁরা আশা দেখালেন যে, সাধারণ ওষুধের মতো মাত্র কয়েকদিন নিয়মিত ওষুধ সেবনেই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতা সম্ভব।

এ ব্যাপারে নর্থ ক্যারোলাইনা-চ্যাপেল হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট টিমোথি শেহান মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যম সিএনএনকে বলেন, ওরাল অ্যান্টিভাইরাল গ্রহণের মাধ্যমে কেবল রোগীর উপসর্গগুলোরই দ্রুত উপশম সম্ভব নয়, তাঁর পরিবারের অন্যদেরও তাঁর কাছ থেকে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। সিয়াটলে নতুন অ্যান্টিভাইরাল থেরাপিতে সহায়তা করেছেন টিমোথি।

হেপাটাইটিস সি এবং এইচআইভি/এইডসসহ অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণের জন্য বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরাল এরই মধ্যে বেশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত একটি হলো তামিফ্লু। ইনফ্লুয়েঞ্জার সময়কালকে কমিয়ে আনা এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে এই ওষুধ।

মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে ভাইরাল সংক্রমণের চিকিৎসা ও প্রতিরোধের জন্য তৈরি ওষুধগুলো ভিন্নভাবে কাজ করে। কিন্তু সবগুলোই এমনভাবে তৈরি করা সম্ভব যে, তারা সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। রিসেপটরগুলোকে ব্লক করে দিতে পারে যাতে ভাইরাস নতুন করে সুস্থ কোষে প্রবেশ করতে না পারে। অথবা শরীরে সক্রিয় ভাইরাসের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে।

কোভিডের জন্য কমপক্ষে তিনটি প্রতিশ্রুতিশীল অ্যান্টিভাইরাল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে। আসছে শীতের পরপরই এই ওষুধগুলো বাজারে আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অ্যালার্জি এবং সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের এইডস বিভাগের পরিচালক কার্ল ডাইফেনবাখ এমনটিই আশা করছেন। তিনি এই অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ তৈরির তত্ত্বাবধান করছেন।

‘মলনুপিরাভির’ নামের এমন একটি ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ নিয়ে কাজ করছে মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা মেরেক। রিজব্যাক বায়ো থেরাপিউটিক্স নামের একটি সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে ওই ওষুধ তৈরি হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে চলছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। জাপানেও ট্রায়াল চালানো হচ্ছে। অক্টোবরের মধ্যেই ট্রায়ালের চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সিয়াটলে ওই দম্পতিকে এই ওষুধটিই দেওয়া হয়েছিল।

এই দৌড়ে রয়েছে কোভিড টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারও। তারা দুই ধরনের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে নেওয়া এবং মুখে খাওয়ার দুটি ওষুধই সার্স প্রতিরোধে ২০০২ সালে ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই ওষুধকেই এবার কোভিড রোগীদের চিকিৎসাতেও ব্যবহার করতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছে ফাইজার।

তবে ফাইজার বলছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই, এমন রোগীদের ক্ষেত্রেই কেবল এটি ব্যবহারের উপযোগী হবে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই এ ওষুধের ট্রায়ালের ফলাফল জানা যাবে। ফলাফল সন্তোষজনক হলে আগামী বছরের গোড়ার দিকেই এটির ব্যবহার শুরু হবে।

তৃতীয় অ্যান্টিভাইরালটি নিয়ে কাজ করছে মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রোশে ফার্মাসিউটিক্যালস এবং অ্যাটিয়া ফার্মাসিউটিক্যালস। এদিকে জাপানি সংস্থা শিওঙ্গি গত জুলাই থেকেই শুরু করেছে কোভিড পিলের প্রথম দফার ট্রায়াল। তবে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তাদের ওষুধ বাজারে আসতে আসতে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ।

সবগুলো ওষুধই মূলত মানব কোষে ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরির ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে। মলনুপিরভিরের ক্ষেত্রে, যে এনজাইমটি ভাইরাসের জেনেটিক উপাদানের অনুলিপি তৈরি করে সেটিকে বহু ভুল করতে বাধ্য করা হয়, এতে ভাইরাসের পুনরুৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রোগীর শরীরে ভাইরাল লোড (ভাইরাসের সংখ্যা) হ্রাস পায়, সংক্রমণের সময়কে সংক্ষিপ্ত হয় এবং যেসব বিপজ্জনক প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া মৃত্যু ঘটানোর মতো গুরুতর অসুস্থতা তৈরি করে সেটি প্রতিরোধ করে এই ওষুধ।

ইঁদুরের শরীরে প্রাথমিক ট্রায়ালে দেখা গেছে, মলনুপিরভির সার্স-কোভ-২ (নভেল করোনাভাইরাস) দ্বারা সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। এটি আবিষ্কৃত হয় এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে রিজব্যাক এবং মার্ক বিষয়টি লুফে নেয়।

গত বসন্তে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ২০২ জন অংশ নেন। দেখা গেছে, মলনুপিরভির দ্রুত সংক্রামক ভাইরাসের মাত্রা হ্রাস করে। মার্কের প্রধান নির্বাহী রবার্ট ডেভিস চলতি মাসে বলেন, আগামী সপ্তাহে বৃহত্তর পরিসরে তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের ফলাফল তাঁরা পাবেন বলে আশা করছেন। চলতি বছরের শেষ নাগাদ খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) কাছ থেকে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আর ফাইজার ১ সেপ্টেম্বর একসঙ্গে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করেছে। আর অ্যাটিয়ার কর্মকর্তারা আশা করছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের ফলাফল হাতে পাবেন। অর্থাৎ আশাই করা যায়, খুব শিগগিরই করোনা প্রতিরোধী মুখে খাওয়ার ওষুধ বাজারে আসছে। এর অর্থ হলো করোনা চিকিৎসায় মানুষ মাত্র পাঁচ থেকে ১০ দিনের একটি কোর্স পূর্ণ করলেই মোটামুটি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন।

মহামারির শুরুর দিকে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া না হলেও যুক্তরাষ্ট্রে এখন এ নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত জুনে বাইডেন প্রশানসন প্রায় ১৭ লাখ ডলার মূল্যের ১২ মিলিয়ন কোর্স মলনুপিরভিরের পিল কেনার ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে অ্যান্টিভাইরাল প্রোগ্রামে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করারও ঘোষণা দেওয়া হয়।

ওষুধগুলো নিঃসন্দেহে কার্যকর প্রমাণিত হলে কোভিড মহামারি মোকাবিলায় অবিশ্বাস্য অগ্রগিত হবে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। সারা বিশ্বে এখন ব্যাপকভাবে টিকা কার্যক্রম চলছে। কিন্তু এটি অত্যন্ত সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে বুস্টার ডোজ দেওয়ার কথা উঠছে। এতোকিছুর পরও সম্পূর্ণ সুরক্ষার নিশ্চয়তা মিলছে না। অনেক দেশেই নতুন করে নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়ছে। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিভাইরাল পিল অনেকের মনে স্বস্তি দিতে পারে। গুরুতর অসুস্থতা থেকে রক্ষার পাশাপাশি সংক্রমণ বিস্তারও ব্যাপক ভাবে কমাতে পারবে এই ওষুধ।

শেয়ার করুন: