হারুন হাবীব: উনিশ শতকে ব্রিটিশ এবং বিশ শতকে রুশরা আফগানিস্তান দখল করার চেষ্টা নিয়েছিল। কিন্তু সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে তারা ব্যর্থ হয়েছে। একুশ শতকে ২০ বছর যুদ্ধ চালিয়েও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে আমেরিকার নেতৃত্বে ৩৬ জাতির সেনাবাহিনী ঘরে ফিরে গেছে। আফগানদের জঙ্গি দেশপ্রেম ও অমিত যুদ্ধকৌশল নিশ্চয়ই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু বহু যুগ আগে দেশটির মাটিতে ধর্মীয় উগ্রতার যে বীজ রোপিত হয়েছিল, নারীদের যেভাবে পদপিষ্ট করা হয়েছিল, আফগানিস্তান কি তা থেকে বাইরে বেরোতে পেরেছে? নাকি সেই বিষবৃক্ষ আগের চেয়েও বেড়েছে?
আল-কায়েদা ও তালেবান খেদাবার দম্ভ নিয়ে জর্জ বুশের আমেরিকা ঢুকেছিল আফগানিস্তানে। কিন্তু পরিণতি লজ্জাজনক ব্যর্থতা, ফলে বেছে নিতে হয়েছে অসম্মানজনক পৃষ্ঠ প্রদর্শন। সরকারি বাহিনীর পরাভূত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা দেশ কিংবা কাবুল ছেড়েছে এবং প্রায় বিনা যুদ্ধে তালেবান দেশ দখল করার সাফল্য লাভ করেছে। বিজয়ী তালেবান এখন সরকার গঠনে ব্যস্ত। উদ্বিগ্ন আফগানরা দেশ থেকে বিদেশের মাটিতে পালাবার পথ খুঁজছে। কাবুল এয়ারপোর্টের চেহারার দিকে বোঝা যায় সেই দেশত্যাগ কতটা হৃদয়বিদারক।
এই তালেবানি বিজয় একদিকে বড় সামরিক সক্ষমতার দৃষ্টান্ত, অন্যদিকে বড় সামাজিক সংকটেরও কারণ। কারণ এ বিজয়ে ভয়ংকরভাবে কাঁপছে আফগান নারীরা। প্রায় শত বছর আগে সর্বশ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর অসামান্য ভ্রমণকাহিনি ‘দেশে-বিদেশে’র কথা স্মরণ করতে হয়। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র স্নেহধন্য আলী সাহেব বাদশাহ আমানুল্লাহ খানের আমন্ত্রণে কাবুলে যান ১৯২৭ সালে শিক্ষকতা করতে। আমানুল্লাহ ছিলেন অধুনিক চিন্তার মানুষ, আফগান নারীদের তিনি নতুন জীবন দিতে চেয়েছিলেন। মেয়েদের জন্য স্কুল-কলেজ বানিয়েছিলেন, বিদেশ থেকে শিক্ষক এনেছিলেন, এমনকি পর্দাপ্রথা তুলে দিয়েছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ করেই দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে উদ্ভব ঘটল ‘বাচ্চায়ে সাকাও’ নামের এক ধর্মান্ধ উগ্রপন্থী নেতার, যাকে নির্দ্বিধায় দস্যুও বলা যায়। তারই নেতৃত্বে আমানুল্লাহবিরোধী আন্দোলন পরিচালিত হলো। নারীদের স্বাধীনতা দেওয়ায় বাদশাহকে ‘কাফির’ বলে ফতোয়া জারি করা হলো। এরপর ‘বাচ্চায়ে সাকাও’-এর বাহিনী বাদশাহর বিরুদ্ধে বড় অভিযান পরিচালিত করল। একের পর এক অঞ্চল দখল করে তারা কাবুলে ঢুকল। এমনকি বাদশাহর সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ লড়াই করতে অস্বীকার জানাল। দস্যুদের ঠেকাতে সরকারি অস্ত্রাগার থেকে বাদশাহ জনগণকে যে অস্ত্রশস্ত্র দিলেন সেগুলো থেকেও একটি গুলিও কেউ ছুড়ল না। ফলে ‘বাচ্চায়ে সাকাও’-এর বাহিনী বিনা প্রতিরোধে কাবুল দখল করল। আমানুল্লাহকে ইতালিতে আশ্রয় নিতে হলো।
এরপর মহা আনন্দে ‘বাচ্চায়ে সাকাও’-এর দল চালাতে থাকল নির্বিচার লুণ্ঠন ও নারী নিগ্রহ। হাজার হাজার মানুষ প্রাণভয়ে কাবুল ছেড়ে পালাল। আফগান নারীরা মুক্তির আলোকচ্ছটা যে দেখেছিল, তা মিলিয়ে গেল। আবারও চালু হলো কট্টর পর্দাপ্রথা। তুলে দেওয়া হলো মেয়েদের স্কুল-কলেজ। বন্দি করা হলো তাদের হেরেমে।
আজ ২০২১ সাল। প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। এবারকার তালেবানি বিজয়ের পর কাবুল এয়ারপোর্টে মানবতার যে সকরুণ দৃশ্য, তা দেখে যথার্থই অনুমান করা যায় ১৯২৯ সালে ‘বাচ্চায়ে সাকাও’-এর বিজয়ের পর কী ঘটেছিল। এরপর প্রায় লাগাতার রক্তপাত গেছে আফগানিস্তানের ওপর দিয়ে, নিপীড়ক ভূস্বামী ও যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একসময় কমিউনিস্টরা ক্ষমতা নিয়েছে। এসেছেন উচ্চশিক্ষিত ড. নাজিবুল্লাহ ও ড. বারবাক কারমাল। এসেছে সাবেক সোভিয়েত দখলদারি। কিন্তু অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
এরপর অবশ্য দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটেছে। সোভিয়েতকে ব্যর্থ করতে আমেরিকা ও পাকিস্তান যৌথভাবে তালেবান তৈরি করেছে। সোভিয়েতকে আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছে। তালেবান ক্ষমতা দখল করেছে। নাজিবুল্লাহর খণ্ডবিখণ্ড শরীর কাবুলের সড়কে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বারবাক কারমাল দেশান্তরিত হয়েছেন।
এর পরও ধারাবাহিক অস্থিরতা। ২০০১ সালে আসে আমেরিকা বা বহুজাতিক বাহিনী। একের পর এক সরকার আসে-যায়, কিন্তু দেশটির ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না। সম্প্রতি এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। কিন্তু সেই আশরাফ গনিকেও দেশ ছাড়তে হয়েছে।
অস্বীকারের উপায় নেই, বহুজাতিক দখলদারির পর তালেবানের সামরিক বিজয় নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু সে বিজয় নতুন আরেক অনিশ্চয়তার পথ তৈরি করেছে, শুধু আফগানিস্তানে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে। গুরুত্বপূর্ণ পানশির থেকে আহম্মদ শাহ মাসুদের অনুসারীরা তালেবানবিরোধী প্রতিরোধ শুরু করলেও সে প্রতিরোধ কতটা স্থায়িত্ব লাভ করবে বলা মুশকিল। বলা বাহুল্য, বহু গোত্র ও বহু স্বার্থপিষ্ট আফগানিস্তানে একক আধিপত্য বহাল রাখতে তালেবানকে বহুবিধ প্রতিবন্ধক পেরোতে হবে।
এদিকে কাবুল, কান্দাহারসহ বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত বহু বিদেশি মিশন তাদের কূটনীতিকসহ লোকজন সরিয়ে নিয়েছে। তাজিকিস্তান ও দোহার সহযোগিতায় কয়েক শত ভারতীয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও শিক্ষক প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন। বহু দেশের বহুসংখ্যক মানুষ আটকা পড়েছে তালেবান অধিকৃত আফগানিস্তানে, এরা কখন-কিভাবে ফিরবে সে নিশ্চয়তা নেই। অন্যদিকে কাবুল এয়ারপোর্টে চলছে মানবতার সকরুণ অধ্যায়। বিদেশগামী বিমানগুলোতে চেপে বসার চেষ্টা করছে উদভ্রান্ত, ভীতসন্ত্রস্ত আফগানরা, এরা তালেবানের ভয়ে দেশ ছাড়তে চায়।
এসব দৃশ্য দেখে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক যে তালেবান কি বৃহত্তর আফগান জনজীবনে আস্থা ফেরাতে পেরেছে? তালেবান যদিও দাবি করছে তারা বদলেছে, বলছে নারীদের জীবন-জীবিকার ওপর বিধি-নিষেধ থাকবে না, আবার এটিও বলছে, নারীদের শরিয়া আইন মেনে চলতে হবে। তালেবানবিরোধী অবস্থানের কারণে এরই মধ্যে দেশের সাবেক নারী গভর্নর শামস মাজহারকে তারা নিয়ে গেছে। তাঁর ভাগ্য কেউ জানে না। দেশের নারী ফুটবলাররা আতঙ্কিত, কী আছে ভাগ্যে জানেন না তাঁরা। একমাত্র পুরুষ ক্রিকেটার রশিদ খানকে আনন্দ করতে দেখা গেছে। সিএনএনের একজন খ্যাতিমান নারী সাংবাদিক কাবুল এয়ারপোর্টের বাইরে যখন সন্ত্রস্ত লোকজনের ভিডিও করছিলেন, তখন তালেবান যোদ্ধারা তাঁর দিকে পিস্তল তাকিয়ে তেড়ে এসেছে। অথচ তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মাসুদ বারবার করে বলে যাচ্ছেন, গণমাধ্যমকে তাঁরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবেন।
তবে নিশ্চিত করেই বলা যায় তালেবান তাদের বৈশ্বিক কৌশল বদলেছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে তারা কাজ করার নীতি গ্রহণ করেছে। তবে আমেরিকাবিরোধী অবস্থান সত্ত্বেও এসব দেশ যে শরণার্থী ঢুকিয়ে তাদের দেশে ‘জিহাদি বিপ্লব’ ছড়াতে দেবে না, সেটিও মনে রাখার কারণ আছে। তুরস্ক ও রাশিয়া এরই মধ্যে সীমান্তে প্রতিরক্ষা বাড়িয়েছে।
যাই হোক, নতুন বাস্তবতা এই যে তালেবান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছে। তারা সরকারও গঠন করবে, যদিও সে সরকারের বৈধতার প্রশ্নে সংকট কম নেই। তালেবান প্রতিনিধিরা এরই মধ্যে চীনের সঙ্গে কথা বলেছেন। বলেছেন, উইঘুর মুসলমানদের তাঁরা সাহায্য করবেন না। অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তো তালেবানি বিজয়কে অভিনন্দিত করেছেন এই বলে যে দেশটি ‘দাসত্ব থেকে মুক্তি’ লাভ করেছে।
আশির দশকে কমিনিস্ট ঠেকাতে আমেরিকা ও পাকিস্তান মিলে যে তালেবানের জন্ম দিয়েছিল, সে তালেবান পাকিস্তানের মাটিতেও পোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। ইতিহাস হচ্ছে এই তালেবান বানানোর যে ফ্যাক্টরিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অংশ নিয়েছিল, সেই ফ্যাক্টরি আজও অটুট আছে। পানশিরের তালেবানবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়ে আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহ অতি সম্প্রতি জোর দিয়েই অভিযোগ করেছেন, পাকিস্তান মাটিই হচ্ছে তালেবানদের ‘মূল ঘাঁটি’।
অনেক দূরের জনপদ হলেও আফগানিস্তান নানা কারণেই বাংলাদেশে আলোচিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আফগানদের সহায়তায় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে বহুসংখ্যক বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছিলেন। লক্ষ করার ব্যাপার যে স্থানীয় যে তালেবানপন্থীরা একদিন বাংলাদেশে ‘তালেবানি বিপ্লব’ সম্পন্ন করার খায়েশে লম্ফঝম্প করেছিল, এবারের তালেবানি বিজয়ের পর তারা নতুন আশায় বুক বাঁধবে সেটিই স্বাভাবিক। পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সম্প্রতি জানিয়েছেন, অতি উৎসাহী কিছু লোক এরই মধ্যে তালেবানের পক্ষে কাজ করার জন্য দেশ ছেড়েছে। অতএব সর্বাত্মক সতর্কতা জরুরি বৈকি।
এত কিছু বলার পরও মনে করি, কোনো দেশ বা সমাজের অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ একান্তভাবেই তার নিজস্ব অবস্থান ও স্বার্থে বিবর্তিত হয়। তবে হ্যাঁ, আফগানিস্তান যদিও বহুদূরের দেশ; কিন্তু তার ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশ-ভারতসহ গোটা অঞ্চলে প্রভাব ফেলবে নিশ্চিতভাবেই। সে প্রভাব ইতিবাচক হতে পারে না। কাজেই সুপরিকল্পিত পন্থায় তাকে মোকাবেলা করতে হবে। অন্যথায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সমাজে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির যে শক্তি অর্জিত হয়েছে, তার পথে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। তবে বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত সমাজশক্তি তালেবানি বিপ্লবের সমর্থক নয়।
আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নয়, বরং চোখ খোলা রেখে পরিস্থিতি অবলোকন করতে হবে। তালেবান বা উগ্রপন্থীরা নিশ্চয়ই মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ-সংস্কৃতির পরিপূরক নয়, কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির জনজীবনকে উপেক্ষা করা যাবে না। অর্থাৎ দেশটির সামাজিক উন্নয়নে শান্তির সুযোগ বিকশিত করার সব সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব করা গেলেই শুধু জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও কট্টরপন্থার উত্থানের আশঙ্কা স্তিমিত করা সহজ হবে। তবে তালেবান যদি তাদের ‘বিপ্লব রপ্তানির’ পুরনো নীতি বজায় রাখে, গণতান্ত্রিক না হয়, নারী নীতির পরিবর্তন না ঘটায়, তাহলে এসবের কোনো সুযোগ থাকবে না। লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও চিন্তাবিদ