প্রফেসর ড. প্রদীপ কুমার পান্ডে ও মামুন আ. কাইউমঃ কয়েকদিন আগে ফেসবুকে হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর বাবা-মার ছবি দেখে থমকে গেলাম। ভালো করে চোখ বুলাতেই খেয়াল করলাম, একজন তরুণ সাংবাদিক তাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। বাবা শেখ লুৎফর রহমান স্বাবলীলভাবে কথা বললেও মা মোসাম্মৎ সাহারা খাতুন শুধুই চোখ মুছছিলেন। এ কান্না কষ্টের নয় বরং গর্বের, আনন্দের। সাক্ষাৎকারের অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর বঙ্গবন্ধুর বাবা দিলেও, বঙ্গবন্ধুর মায়ের একটা কথা আমাকে বেশ আলোড়িত করলো। তিনি বলছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুর মতো এমন সন্তান তো চেয়ে পাইনি, আল্লাহ এমন সন্তান দিয়েছেন তাই পেয়েছি। আসলে হাজার বছরে এমন সন্তান তো তেমনটা জন্মায় না।
ফরিদপুর (তখনকার) জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সাহারা খাতুনের সেই ‘খোকা’ যে একদিন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি হয়ে উঠবেন তা কি কেউ জানতো। বেশ কয়েকবার সেই বিখ্যাত টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যাতায়াতের পথে শুধুই ভেবেছি, আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে এ প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নিয়ে একজন মানুষ কীভাবে মহীরুহ হয়ে উঠলেন। যোগাযোগ ব্যবস্থাও তো তেমন ভালো ছিল না। শৈশবে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ কাঁপালেন এবং ১৯৪৭ পরবর্তীতে ঢাকা তথা পুরো দেশ কাঁপিয়ে তুললেন। সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, আত্মত্যাগ তথা মানুষের প্রতি অদম্য ভালোবাসা দিয়ে জয় করলেন, বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম দিলেন বাংলাদেশ নাম স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের। বাংলাদেশের জনগণের কাছে স্বীকৃতি পেলেন জাতির পিতার।
স্বাধীনতার পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিলেন তার কিছুদিনের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকদের চক্রান্ত ও সেনাবাহিনীর উচ্ছৃঙ্খল-উচ্চাভিধাষী সদস্যের নির্মম বুলেটের আঘাতে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। হায়ানার দল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেই ক্ষান্ত হলেন না, বঙ্গবন্ধুর নামটিও মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। বাংলাদেশের সে সময়কার সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ খেয়াল করলে বিষয়টির স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়।
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল ১৫ আগস্ট ভোরের দিকে। স্বাভাবিকভাবেই ১৫ আগস্টের সংবাদমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত কোনো সংবাদ সে সময়কার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও গবেষণা প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৫ আগস্ট কেবল বেতারে মেজর শরিফুল হক ডালিমের একটি ঘোষণা প্রচার করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘শেখ মুজিবুকে হত্যা করা হইয়াছে এবং খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। দেশবাসী সবাই শান্ত থাকুন। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’ সেই সাথে ‘দেশের স্বার্থে’ নতুন সরকারকে দেশবাসীর সমর্থন দেয়া, সামরিক আইন জারি এবং বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক সরকারকে সমর্থনের কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। বেতারের সেই প্রচারে অত্যন্ত সুকৌশলে ‘জাতির জনক’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ পদবিগুলো বাদ দেয়া হয়েছিল।
রাতারাতি চরিত্র বদলের দৃশ্যপট আমরা সে সময়কার চারটি সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দেয়ার বিষয়টি ১৫ আগস্টের পত্রিকায় বেশ গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ করা হয়েছিল। অথচ মাত্র একদিন পরে অর্থাৎ ১৬ আগস্টও পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু তথা সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ছিল চরমভাবে উপেক্ষিত। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মহান নেতা, জাতির জনকের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের মতো মর্মান্তিক, নির্মম ও জঘন্য ঘটনাটি সংবাদের বিচারে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপনের নৈতিক কারণ থাকলেও খবরটি কোনো পত্রিকায় প্রধান সংবাদ হিসেবে আসেনি। বরং সেদিনের পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি চেপে গিয়ে দৈনিক বাংলায় প্রধান সংবাদ ছিল ‘খোন্দকার মোশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি’। পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তেও শেখ মুজিবের পতন ঘটিয়ে মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ বলা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের কোনো বিস্তারিত বর্ণনা না দিয়ে পত্রিকাটির শোল্ডারে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্থান পেয়েছিল এভাবে, ‘শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য প্রকাশ’। দ্য বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় প্রথম পাতার সম্পাদকীয়তে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে ‘ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজনীয়’ বলা হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যার বিষয়টি না এনে প্রথম পাতার সম্পাদকীয়তে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ বলা হয়েছিল। এমনকি স্বাধীন- সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নিহত সদস্যদের টুঙ্গিপাড়ায় দাফনের সংবাদগুলোও তখনকার সংবাদপত্রে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে এমনকি কোনো কোনো পত্রিকায় দুই থেকে তিন লাইনের মধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের সংবাদ বরং বিদেশী সংবাদমাধ্যমগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছিল। স্বাধীনতা দিবসের ছুটি থাকায় ১৬ আগস্ট ভারতে কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। তবে ১৭ আগস্ট কলকাতার প্রভাবশালী আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম ছিল- ‘বন্ধুর মৃত্যুতে ভারত শোকাহত’। আবার, কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় এ-হত্যাকাণ্ড, অভ্যুত্থান ও সামরিক আইন জারি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছিল। পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে মুজিব হত্যার জন্য সিআইএ-কে সরাসরি দায়ী করা হয়। এতে মার্কিন প্রতিনিধি পশ্চিম বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কাছে এ ধরনের সংবাদ প্রতাশের প্রতিবাদ জানায় এবং এ ধরনের সাংবাদ প্রকাশের জন্য যুগান্তর পত্রিকাকে প্রথম পাতায় ক্ষমা প্রার্থনার চাপ দেয়। দিল্লি থেকে প্রকাশিত অন্যান্য পত্রিকাও বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছিল।
ভারতের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংবাদমাধ্যমেও এ-হত্যাকাণ্ডের সংবাদটি বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে’। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে’। ওই বছরের ২৮ আগস্ট লন্ডনের দ্য লিসনার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনগণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক এবং তার কবরস্থান পুণ্যতীর্থে পরিণত হবে।’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডেরর পরে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বরেণ্য বিশ্ব নেতাদের বক্তব্য সে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছিল। যেমন- কিউবার প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে’। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’
তবে, আন্তর্জাতিক কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে একটু ভিন্নভাবেও উপস্থাপন করেছিল। যেমন- যুক্তরাজ্যের দ্য সানডে টাইমস পত্রিকায় অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড তিনটি সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণ করেছিল ( সামরিক বাহিনীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস, ইসলামের অবনয়ন এবং জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতা)। আবার হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ পর দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের পূর্বাভাসে ছিল এমন বার্তা- শেখ মুজিবুর রহমানের উৎখাত হয়তো দেশটিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দূরে সরিয়ে চীনের দিকে নিয়ে যেতে পারে’।
প্রশ্ন আসতে পারে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যম কেন এভাবে উপস্থাপন করেছিল? দেশি সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে এমনটি কেন হয়েছিল তা ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের বাংলাদেশ বেতারের ব্রডকাস্ট ইনচার্জ প্রণব চন্দ্র রায়ের সাক্ষাৎকার থেকে কিছুটা পাওয়া যায়। সাক্ষাৎকারে মি. রায় বলেছিলেন, ভোরবেলা সেনাবাহিনী বেতারের ট্রান্সমিশন কক্ষে প্রবেশ করে এবং তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যার ঘোষণাটি প্রচারের ব্যবস্থা করে দিতে বলে। মেজর ডালিম রক্তে ভেজা শরীর নিয়ে তার মাথায় বন্দুক ঠেকান। একইভাবে সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি পত্রিকাকেও চাপ দেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির তৈরি হলেও সামরিক শাসন ও বহুমুখী চাপের কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও তেমনভাবে একত্রিত হতে না পারায় অনেকটা অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে চারটি সংবাদপত্র এমন ভূমিকা পালন করেছিল বলে ধরে নেয়া যায়। আবার ভারত, আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও বাংলাদেশের অর্জনে তার ভূমিকাকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হলেও, কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে সে দেশের সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটেছিল।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসলেই মৃত্যুঞ্জয়ী। জীবিত মুজিবের চেয়ে নিহত মুজিবের চেতনা আরও বেশি শক্তিশালী। দুঃখের বিষয় হলো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সেই হত্যাকাণ্ড বা পরবর্তী দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে গণমাধ্যমে তুলে ধরার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা ও গণমাধ্যমের অনীহাও খেয়াল করা গেছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস বিকৃতিও করা হয়েছে। আগামীতে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের ইতিহাস নিয়ে গণমাধ্যমকে আরও বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো যেতেই পারে।
লেখকদ্বয়: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের যথাক্রমে প্রফেসর ও সহকারী অধ্যাপক। উল্লেখ্য, লেখাটির তথ্যসূত্র হিসেবে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও এ সংক্রান্ত গবেষণা থেকে সেকেন্ডারি তথ্য নেয়া হয়েছে।