পিয়াসা-মৌ

গোপন ভিডিও ফাঁস, পিয়াসা-মৌ গ্রেপ্তারের নেপথ্যে

বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌ গ্রেপ্তার হন মূলত ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগে। ‘ম’ আদ্যাক্ষরের এক প্রভাবশালী ব্যাংকারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। একপর্যায়ে ওই ব্যাংকারের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা মেরে দেন পিয়াসা। টাকা চাইলে নারীঘটিত বিষয় প্রকাশের ভয় দেখানো হয়। এছাড়া গুলশানের ভাসাভি ফ্যাশন হাউজের মালিক জামানের সঙ্গেও পিয়াসার ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। তার কারণে জামানের সংসারে দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। একপর্যায়ে জামানের স্ত্রী তানজিয়া চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পিয়াসার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। এরই সূত্র ধরে পহেলা আগস্ট সহযোগী মৌ নামের এক সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন পিয়াসা। গ্রেপ্তারের সময় বারিধারার বাসায় পিয়াসা সাংবাদিকদের বলেন, তার গ্রেপ্তারের পেছনে জামানের স্ত্রীর হাত রয়েছে। মূলত জামানের পরকীয়া সম্পর্কের কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জামানের পুরো নাম জামান মোল্লা ওরফে নুরুদ্দিন। তার বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরে। চার ভাইয়ের মধ্যে তার এক ভাই লতিফ মোল্লা আওয়ামী লীগ নেতা এবং বর্তমানে শিবচর উপজেলা চেয়ারম্যান। এক সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। পরে রাজনীতি ছেড়ে জাপান চলে যান। প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফেরার পর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায় নাম লেখান। ব্যবসা সূত্রে এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে ভারতীয় তারকাদের ঢাকায় এনে কনসার্ট আয়োজন করেন। কিন্তু ইভেন্ট ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান হয় তার। এরমধ্যে ২০০৭ সালে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে তিনি ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। এক-এগারোর আমলে অদৃশ্য ক্ষমতার জোরে বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করেন। তার দাপটে প্রতিষ্ঠিত অনেক রাজনীতিবিদকে দেশছাড়া হতে হয়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে মাদারীপুর থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে এমপি নির্বাচন করলেও তিনি পরাজিত হন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। এছাড়া পিয়াসার ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম নেপথ্যে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির টিকিট পাওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হননি। গুলশানে তার মালিকানাধীন ভাসাভি নামের অভিজাত ফ্যাশন হাউজ রাজধানীর অন্যতম দামি পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অভিযানে পিয়াসা-মৌ গ্রেপ্তার হওয়ার অল্প কয়েক দিন আগে পার্টির জন্য সংরক্ষিত গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে তাদের সঙ্গে তুমুল বাগ্‌বিতণ্ডা হয় ওই প্রভাবশালী নারীদের। এরই একপর্যায়ে তারা একে অপরের চুল ধরে টানাটানিও করেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা এবং ওই প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জানান, একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে একটি ফ্যাশন হাউসের এমডির স্ত্রীর ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্ক রয়েছে। এই দুজনের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কথিত মডেল পিয়াসা-মৌসহ তাদের মতো অনেকেরই। বিভিন্ন উপলক্ষে তারা বিভিন্ন বাসায় ও ক্লাবে পার্টি করতেন। সেখানে মদপানের পাশাপাশি মডেলদের দিয়ে নাচের আয়োজন থাকত। এসব পার্টিতে দেশের বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা থাকতেন। পিয়াসা-মৌ সিন্ডিকেট এসব পার্টিতে বড় বড় ব্যবসায়ীকে টার্গেট করতেন। একান্তে সময় কাটাতেন এবং গোপনে সেই একান্ত সময়ের ছবি মোবাইলে বা অন্য কোনো মাধ্যমে ধারণ করতেন। পরে ওই ব্যবসায়ীদের পরিবারের সদস্য বা স্ত্রীদের কাছে ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে অর্থসহ নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা আদায় করতেন।

জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়ার ৪-৫ দিন আগে এক শিল্পপতির ছেলের গুলশানের পার্টির জন্য একটি ফ্ল্যাটে জড়ো হন পিয়াসা-মৌসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর স্ত্রী। সেখানে উপস্থিত নারীরা তাদের ‘বয়ফ্রেন্ডদের’ প্রভাব-ক্ষমতা নিয়ে গল্প করছিলেন। গল্পের একপর্যায়ে পিয়াসার সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হয় ফ্যাশন হাউসটির এমডির স্ত্রীর। এ নিয়ে তাদের মধ্যে চুলাচুলিও হয়। ফ্যাশন হাউসটির ওই কর্মকর্তার স্ত্রী এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযোগ করেন বেসরকারি ওই ব্যাংকের এমডির কাছে। তিনি বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানিয়ে প্রতিকার চান। এরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজরদারিতে পড়েন পিয়াসা ও মৌ। তাদের বিভিন্ন কৃতকর্মের তথ্য পাওয়ার পরপরই অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।

এর আগে গত ১ আগস্ট রাতে আটকের সময় সাংবাদিকদের কাছে মডেল মরিয়ম আক্তার মৌও একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। ভাসাবির জামানের স্ত্রী বাসায় পুলিশ পাঠিয়ে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়েছিলেন। ভাসাবির জামানের স্ত্রী তানজি আমার পরিচিত। তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রামে গিয়ে পিয়াসার সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়। তানজির সঙ্গে ওদের কার যেন ঝামেলা হয়েছে, সেজন্য আমাকেও ফাঁসানো হচ্ছে। আমার বাসায় এসব মদ আর ইয়াবা আগে থেকে ছিল না।

বুধবার (১১ আগস্ট) রিমান্ড শুনানি শেষে এজলাস থেকে পিয়াসাকে বের করে আদালতের হাজতখানায় নেওয়ার সময় সাংবাদিকদের উদ্দেশে ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা বলেন, ‘জামান ও জামানের বউকে খুঁজে বের করেন। ওই প্রস্টিটিউটকে খুঁজে বের করেন। ভাসাবির (ফ্যাশন হাউজ) মালিক জামান। জামানের কাছে যান। বাঁচানোর মালিক জামান। তার বউয়ের পরকীয়ার ষড়যন্ত্রের শিকার আমরা। আমাদের না ধরে ওই প্রস্টিটিউটকে ধরেন। আমরা তার ষড়যন্ত্রের শিকার।’

তার এ কথা শুনে উপস্থিত সাংবাদিকরা পিয়াসার কাছে জানতে চান কে এই জামান? কিন্তু এর কোনো উত্তর দেননি তিনি। বারবার জামান ও তার স্ত্রীকে খোঁজে বের করতে বলেন পিয়াসা।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ফ্যাশন হাউসটির এমডির স্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমার ১৩-১৪ বছর আগে বিয়ে হয়। তার সঙ্গে ভালোই আছি। আমরা গুলশান-বনানীর অনেক সোসাইটি মেইনটেইন করি। আমাদের নামে আজ পর্যন্ত কোনো বাজে রেকর্ড ছড়ায়নি। কোনো স্ক্যান্ডাল বের হয়নি। পিয়াসা কে? ওকে নিয়ে আমার নতুন করে কিছু বলার নাই। আর মৌ হচ্ছে সেই মেয়ে, যার চারটা বিয়ে হয়েছে, সবাই জানে। আর পিয়াসার বিষয়টা আপনারাই জানেন। আপন জুয়েলার্স বলেন, এশিয়ান টিভি বলেন।’

এই নারী আরে বলেন, ‘মৌ অনেক মানুষের সঙ্গে ফাইজলামি করে কারও কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা নিছে, কারও কাছ থেকে নিয়েছে এক কোটি টাকা। তাদের কাছ থেকেই এটা জেনেছি। এ জন্যই ওরা ভয় পেয়েছিল। যে কারণে আমার নামটা অভিযানের সময় বলেছে। ওরা ভাবছে কাজটা আমি করেছি। কিন্তু বিষয়টা তো এত সোজা না। ওদের ব্ল্যাকমেইলগুলো যখন আমি বুঝতে পেরেছি, তখন ওনাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। হয়তো এটা ঠিক যে, আমরা খারাপ পারসনদের চুজ করে কিছুটা ফ্রেন্ড রেখেছি, এটা আমরা স্বীকার করি।’

তিনি বলেন, ‘আমি তো ওদের অনেক কিছুই জেনে গেছি। ওদের বাসায় মাঝেমধ্যেই প্রোগ্রাম করেছি। সেখানে কিছু মডেল নিয়ে নাচগান করানো হতো। মদটদও থাকত। এগুলো তো কমপালসরি। এসব ঘটনায় আমি ওদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলাম। কারণ এগুলো কেন করবে? তাই না?’

পিয়াসার সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখেন, তার বাসায় (শিল্পপতির ছেলে) অনেকেই যাই। তাই আমার নাম মেনশন না করাই বেটার। দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে যাই। সেখানে পিয়াসা আমার সঙ্গে অনেক বাড়াবাড়ি করেছে। এছাড়া তাকে তো আমার স্বামী পছন্দই করে না। ওপেনলি ও যখন, ওই যে... ভাইয়ারা ... পিয়াসাকে বনানী ক্লাবে আনত, তখন তো আমার স্বামী ডিরেক্টলি বলেছে, এসব মেয়ে ক্লাবে কী করে আসে? কারণ ওরা তো মেম্বার না। মেম্বারশিপ ছাড়া ওখানে ঢুকত। রং-তামাশা করত। আর পিয়াসার তো এই রকম একটা ছবিও আছে। আমি জানি না, আপনাদের কাছে আছে নাকি। ....ভাইয়ার সঙ্গে কিস করছে- এ রকম একটা ছবি আছে।’

এই নারী আরো বলেন, ‘এমনিতেই এগুলো বলতাম না। কারণ... ভাইয়াদের সঙ্গে, কী বলব আর? এগুলো বললে, আকাশের দিকে থুতু মারলে নিজের গায়ে পড়ে। মানে আমার জামাইরা তো তাদের ফ্রেন্ডস। সত্যি কথা বলতে একটু দ্বিধাই লাগে। তো আমি যখন এগুলা বুঝতে পেরেছি, ওর (পিয়াসা) এগুলার কারবার। মৌরা বিভিন্ন পার্টিটার্টিতে মডেলদের নাচতে দিত, আর বড় বড় যেগুলা বিগশট আছে, বড় বড় ব্যবসায়ী আছে, ওদের সঙ্গে এই রকম করত।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এইগুলার প্রতিবাদ করছি। ...ভাইয়ার বউয়ের সঙ্গে আমার ভালো খাতির। ....ভাইয়ার বউয়ের সঙ্গে আমাদের সবার ভালো খাতির। যখন দেখছে বউদেরকে, সবগুলাকে আমিই বলতাম গিয়ে, তো ক্ষেপবে না! আর তার মধ্যে পিয়াসা তো একজনের রক্ষিতা হিসেবেই আছে, তাকে সবাই চেনেন। যার (পিয়াসা) নিজের বেতন ৫০ হাজার টাকা তিনি রাখেন বডিগার্ড! গত তিন-চার মাস ধরে রীতিমতো ওদের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে। আজকে একটা সত্যি কথা বলি, দুই দিন আগেও পিয়াসার বাসায় একটা প্রোগ্রাম হয়েছে, সেখানে কারা কারা ছিলেন তাদের একটা ছবি আছে। শুধু আমরাই যাই নাই। কারণ আমরা সবাই জানি ওদের ঘরে কী হয়। এসব নিয়ে কেউ তো বলে না। সবাই চুপ থাকে। এ জন্যই ওরা সবাই আমাদের বিরুদ্ধে লেগেছে। এমডির সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে এসব কথা বলছে।’

শেয়ার করুন: