এম হাফিজউদ্দিন খান

৫০ বছরের প্রাপ্তি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের মুহূর্ত আমাদের জন্য অনেক গৌরবের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর শুরুর কয়েক বছর অনেক খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। নতুন দেশ। বলতে গেলে কিছুই নেই। নানা সমস্যা। এর মধ্যে দুর্ভিক্ষও দেখতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হারালাম। দেশ সামরিক শাসনের অধীনে গেল। নানা রকম উত্থান-পতন হলো। তারপর ১৯৯১ সাল থেকে মোটামুটি একটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে। তখন থেকে মাঝের দুই বছর বাদ দিলে একটা গণতান্ত্রিক কাঠামোর আবর্তে দেশ শাসিত হয়ে আসছে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয় হলো রাজনীতিকরাই দেশ চালাচ্ছেন। কোনো সামরিক একনায়কের শাসন দেখতে হয়নি। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখন একটি উদীয়মান দেশ।

বাংলাদেশ আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কোনো সন্দেহ নেই। আমরা সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ পরিস্থিতি পার হয়ে এসেছি। এখন নিজেদের খরচে পদ্মা সেতুর মতো একটা মেগাপ্রকল্প প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছি। শুধু এই পদ্মা সেতুর কথাটাই যদি বলি, তাহলে বলব এটা এক বিরাট অর্জন। এ জন্য সরকারের যাঁরা আছেন, বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধন্যবাদ পাবেন। এটা তাঁর প্রাপ্য। সামগ্রিকভাবে দেশ ভালো চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার বিচারেও আমরা এগিয়ে গেছি। তার বড় প্রমাণ হলো, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে আমাদের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণ। যদিও এর আনুষ্ঠানিকতা বাকি। সব মিলিয়ে আমাদের অগ্রগতি হয়েছে, সব দিক দিয়েই হয়েছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ আরো কতটা ভালো থাকতে পারত সেটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু এ কথা সত্য যে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ এখন উল্লেখযোগ্য নাম। বিশ্ব অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে আমরা জায়গা করে নিয়েছি। এই এগিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের কিছু অস্বস্তিও আছে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের চলার পথ কখনোই কণ্টকমুক্ত ছিল না। পৃথিবীর কোনো দেশেরই অগ্রযাত্রা নির্বিঘ্ন হয় না। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো বহির্বিশ্বের বাধার চেয়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাধাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

আমরা অন্ধকার অতীত ফেলে এসেছি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলো দূর করতে না পারা আমাদের স্বাধীনতার অপ্রাপ্তির দিক। দেশ গণতান্ত্রিক কাঠামোর আবর্তে শাসিত হলেও দেশের রাজনৈতিক কাঠামো এখনো ভঙ্গুর। গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল অপরিহার্য হলেও এই মুহূর্তে তা দেখা যাচ্ছে না। গণতন্ত্রের প্রতি দলগুলোর দৃঢ় অঙ্গীকারও দেখা যায় না। দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা বলতে গেলে নেই। দেশের প্রশ্নে, দেশের ভবিষ্যতের প্রশ্নে, দেশ শাসনের নীতিগত প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐক্য রীতিমতো দুরাশায় পরিণত হয়েছে। ফলে ক্ষমতার সঙ্গে দেশের নীতিও বদলে যায়।

একটি জাতির ভবিষ্যৎ নিহিত থাকে তার শিক্ষাব্যবস্থায়। কিন্তু একটি সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। এর মধ্যে শিক্ষার মান নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে; কিন্তু শিক্ষার মান সেই অর্থে উন্নত হয়নি। মাধ্যমিক শিক্ষাকে এখনো শক্তিশালী করা যায়নি। উচ্চশিক্ষা রীতিমতো দিশাহারা হয়ে পড়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপচার্যদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছারিতা ও দুর্নীতির অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। এটা নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু এগুলো কমে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারি এসে শিক্ষা খাতকে আরো লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে আছে।

স্বাধীনতার পর দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ। গত কয়েক বছরে এই জায়গায় আমরা খুব দ্রুত উন্নতি করি। দারিদ্র্যের হার কমতে কমতে ২০১৯ সালের শেষের দিকে ১৯ শতাংশে নেমে আসে। চরম দারিদ্র্যের হার আরো অনেক কম। আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছরে এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন। যদিও করোনাভাইরাস এসে আমাদের দারিদ্র্যের হার আবার বাড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলছে করোনায় দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে, কেউ বলছে ৩৫ শতাংশ, আবার কেউ বলছে ৪৩ শতাংশ হয়েছে। তবে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও যেভাবে আমাদের ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে, তাতে দারিদ্র্য বিমোচনেও আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব বলে বিশ্বাস করি। এ ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা আরো সুস্পষ্ট করতে হবে, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতে সহযোগিতার ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে আমরা অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতি অর্জন করেছি। সেটা বিশ্বের সবাই স্বীকার করছে। শুধু দারিদ্র্য বিমোচন নয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স অর্জনে বিরাট সাফল্য দেখিয়েছি।

আমাদের অর্থনীতির এই এগিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দুটি বিপরীত টানও দেখা যাচ্ছে। একটি হচ্ছে বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা এবং অপরটি হচ্ছে আয়বৈষম্য। অর্থনীতিতে যেমন মেগাপ্রকল্প আসছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে মেগা দুর্নীতিও দেখা যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিয়ম, সরকারি কেনাকাটায় লুটপাট, সরকারি কাজকর্মে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। গণমাধ্যমের খবর অন্তত তা-ই বলছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। অথচ অর্থনৈতিক বৈষম্য দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই বৈষম্যের পেছনে দুর্নীতি একটা কারণ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি হয় সবচেয়ে বড় সাফল্য, তাহলে দুর্নীতি দমন করতে না পারা হতে পারে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার নাম। দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে দুর্নীতি দমন কমিশনে উন্নীত করা হলেও এই সমস্যা দূর করা গেল না। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুলেই আমরা দেখতে পাই দুর্নীতির নানা খবর। পত্রপত্রিকায় ছোটখাটো দুর্নীতির খবর এখন গুরুত্বই পায় না।

আমাদের স্বাধীনতার এই ৫০ বছরের অন্যতম বড় সাফল্য হলো সামরিক শাসনের সংস্কৃতিকে মোটামুটি কবর দিতে পারা। তার ১৯৯১ সাল থেকে দোষত্রুটি সত্ত্বেও আমরা একটা গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে ফেরত এসেছি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনকে এখনো আমরা জবাবদিহিমূলক করতে পারিনি। সরকারের জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে পারিনি। এ জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দরকার, সেটাও গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, মানবাধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। নির্বাচনব্যবস্থা গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু নির্বাচনব্যবস্থা বলতে গেলে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই জায়গাগুলোতে আমাদের অবস্থা খুবই করুণ। এ জন্য অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী। কোনো পক্ষই নিজেদের দায়মুক্ত ভাবতে পারে না। দলগুলো যদি অঙ্গীকারবদ্ধ হয় যে আমরা স্বচ্ছ নির্বাচন করব, দুর্নীতি করব না, আমরা ভোটকেন্দ্র দখল করব না, তাহলে নির্বাচনব্যবস্থা শক্তিশালী না হয়ে পারে না। আবার নির্বাচন কমিশনকেও স্বচ্ছ নির্বাচন চাইতে হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনে দরকার দৃঢ়চেতা মানুষের। আবার দৃঢ়চেতা মানুষ চাইলেই হবে না, নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়াও শক্তিশালী করা দরকার। আমাদের সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের একটা আইন করতে হবে। সেই আইন প্রণয়ন করাটা এখন খুব জরুরি। নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা নেই। গণতন্ত্র সুসংসত করতে গেলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে গেলে এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

বৈদেশিক সম্পর্কের জায়গায় আমাদের আরো পরিপক্বতা দেখাতে হবে। আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কের মধ্যে বড় একটা সমস্যা হলো ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান সমস্যা। এই সম্পর্ক নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথাই বলা যায়। সামগ্রিকভাবে আমাদের বঞ্চনার বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। যেটা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘আমরা কিছু পাই না, সব দিয়েছি।’ সুতরাং এখানে আমাদের করণীয় কিছু রয়ে গেছে। সীমান্ত হত্যা কোনো যুক্তিতেই চলতে পারে না। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে গেছেন, ‘সীমান্তে সংঘটিত অপরাধের জন্য সীমান্ত হত্যা হয়। সীমান্তে অপরাধ না থাকলে হত্যাও হবে না।’ কিন্তু অপরাধ করলেই কাউকে ধরে মারতে হবে নাকি? এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা কি নেই? সুতরাং ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই উক্তিটা আমি মনে করি খুবই আপত্তিকর। কোনো দায়িত্ববান ব্যক্তি এমন বলতে পারেন না। আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কের সাম্প্রতিক সময়ের আরেকটা বিষয় হলো, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও ভারতকে কাছে না পাওয়া। সুতরাং আমাদের সম্পর্ক নির্ণয় নিয়ে আরো ভাবতে হবে।

পরিশেষে বলব, আমাদের স্বাধীনতার প্রথম ৫০ বছর অবশ্যই অর্থনীতির সাফল্যের। এখন পরবর্তী ৫০ বছরের যাত্রা শুরু হোক সুশাসনের; যেখানে গণতন্ত্র সুসংহত হবে, মানবাধিকার নিশ্চিত হবে, দুর্নীত ও আয়বৈষম্য কমবে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে, জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠবে। প্রথম ৫০ বছরের সাফল্য হোক পরবর্তী ৫০ বছরের অনুপ্রেরণা। লেখক: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, অনুলিখন: আফছার আহমেদ

শেয়ার করুন: