দুদক

৬০ ব্যক্তির পাচারের টাকা ফেরাতে ১৮ দেশে চিঠি

দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে উপার্জিত কোটি কোটি টাকা কৌশলে বিদেশে পাচার করে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন, ঘরবাড়ি করে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসায় তৎপর হয়ে ওঠে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ৬০ জন দুর্নীতিবাজের বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনতে কাজ করছে দুদক।

সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকারসহ এই ৬০ জনের পাচার করা টাকা ফেরত আনতে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৮টি দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই আবেদন করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে থাকা কয়েকজন দুর্নীতিবাজকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সাহায্য চেয়েও আবেদন করা হয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, এরই মধ্যে ৩৫ জন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির অর্থপাচারের রেকর্ডপত্র দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা হাতে পেয়েছেন। ওই সব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চার্জশিট আকারে আদালতে দাখিল করা হয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে আদালতে ট্রায়াল চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ডসহ অর্থপাচার করা হয়েছে—এমন দেশগুলোতে এমএলএআর পাঠিয়েছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা। পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক ও উপসহকারী পরিচালক পর্যায়ের অন্তত ২২ জন কর্মকর্তা এ নিয়ে কাজ করছেন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ১৬০ কোটি টাকা পাচার করেছেন। এবি ব্যাংকের মাধ্যমে দুবাইয়ের এডিসিবি ব্যাংকে জালিয়াতির মাধ্যমে ওয়াহিদুল হক ওই টাকা পাচার করেছেন। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা ও উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের তদন্তে এই টাকাপাচারের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। দুবাই থেকে ওই টাকা ফিরিয়ে আনতে গুলশান আনোয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আরব আমিরাতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমএলএআর পাঠান।

একইভাবে অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধেও দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের বিষয়ে তদন্ত করছে দুদক। সেলিম প্রধানের পাচার করা টাকা দেশে ফেরাতে থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে আবেদন করেছেন দুদক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আলোচিত কেরানি আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা খানমের বিরুদ্ধে ২৬৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করছেন দুদকের উপপরিচালক তৌফিকুল ইসলাম। চলতি বছরের ২৭ জুন তিনি বাদী হয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জন, মানি লন্ডারিং এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে ওই দম্পতির বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন। এরপর টাকা দেশে ফেরাতে অস্ট্রেলিয়ায় আবেদন করেন।

কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের হোতা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের বিষয়েও তদন্ত চলছে। পি কে হালদারের পাচার করা অর্থের মধ্যে ৬৫০ কোটি টাকার তথ্য পেয়েছে দুদক। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন আহমেদ টাকা ফেরত আনতে আবেদন করেন।

কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক (বহিষ্কৃত) কাজী আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের তদন্তে প্রায় ১০০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। তিনি মালয়েশিয়া ও ভারতে টাকা পাচার করেছেন বলে তদন্তে বেরিয়ে আসছে। এমপি শহিদ ইসলাম পাপুল, গত কমিটির যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী, বেসিক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম, শেয়ার খাতের ব্যবসায়ী লুত্ফর রহমান বাদলসহ আরো কিছু দুর্নীতিবাজের পাচার করা টাকা ফেরাতে কাজ করছে দুদক।

দুদকের মধ্যম সারির একজন কর্মকর্তা বলেন, ৫৫ থেকে ৬০ ব্যক্তির পাচার করা টাকা দেশে ফেরাতে এরই মধ্যে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। দুদক থেকে পাঠানো ৩০টির বেশি চিঠির জবাব পাওয়া গেছে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শুধু মামলাই নয়, বিদেশ থেকে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এখন জোর দিয়েছে কমিশন।

দেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নানা কৌশলে টাকা পাচার করছেন দুর্নীতিবাজরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, শুধু ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে।

জিএফআইর তথ্য মতে, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার এসংক্রান্ত তালিকায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।

শেয়ার করুন: