বটগাছ
বটগাছ

অযত্নের মাঝেই টিকে থাকার সংগ্রামে বৃহত্তম বটগাছ

শুধু দেশের নয়, এশিয়া মহাদেশের মধ্যেই বৃহত্তম। তথ্যটা জানার পর থেকেই বটগাছটি দেখতে যাওয়ার আগ্রহ ছিল। কিন্তু সময়-সুযোগ মিলছিল না। কাজের ফাঁকে ফুরসৎ মিলতেই ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর—একসাথে তিন জেলা ঘুরতে চলে যাই।

সঙ্গী না পাওয়ায় একলাই যাই ভ্রমণে। ঝিনাইদহ হয়ে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর এই ছিল রুটপ্ল্যান। ভ্রমণের প্রথমদিনই যাই ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের বেথুলীতে। শ্রান্ত হই বটছায়ায়। নিজের ক্লান্তি জুড়ালেও প্রতিনিয়ত সংগ্রামে ক্লান্ত গাছটিকে দেখে মায়া লাগে।

ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে সুইতলা বটগাছকে। অযত্ন আর অবহেলায় বিলীনের শঙ্কায় রয়েছে ২০০-২৫০ বছরের পুরনো গাছটি। রক্ষণাবেক্ষণে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করছে বন বিভাগও। তবে কার্যকর উদ্যোগের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্বে মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলী গ্রামে অবস্থিত মূল বটগাছটি মারা গেছে অনেক আগে। বর্তমানে ১১ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত গাছটির ৪৫টি উপবৃক্ষ ও ৩৪৫টি ঝুরি মাটির সঙ্গে যুক্ত এবং ৩৮টি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। মাঝখানে কিছু অংশ ফাঁকা এবং চারপাশ শাখা-প্রশাখায় বেষ্টিত।

দক্ষিণ-পূর্ব পাশের গাছগুলি জমাটবদ্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম পাশে কিছুটা ফাঁকা ছাউনি দিয়ে বেষ্টিত। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট উঁচু গাছটির পাশে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। এখনো নির্দিষ্ট দিনে গাছের নিচে চলে পূজা-অর্চনা।

বিশ্বব্যাপী গাছটির পরিচিতি ঘটে ১৯৮৪ সালে প্রতিবেদনের মাধ্যমে। সংবাদমাধ্যমটির নিজস্ব জরিপের বরাতে বলা হয়, ১৯৮২ সাল থেকে ভারতের কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের গাছটিকে ছাড়িয়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় বটগাছে পরিণত হয়েছে সুইতলা।

এরপর থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটক ঝিনাইদহ সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গাছটি দেখতে যাওয়া শুরু করেন। ১৯৯০ সালে সরকারি অনুদানে সেখানে নির্মিত হয় রেস্ট হাউজ। বিস্তৃত বটগাছে সারাক্ষণই চলে পাখির কিচির-মিচির। কয়েক প্রজাতির পাখির আনাগোনা শুধু এই গাছকে কেন্দ্র করে।

যশোর হয়ে ঝিনাইদহের বারোবাজার এলাকায় বেশ কয়েকটি পুরনো আমলের মসজিদ ঘুরে দুপুরে পৌঁছাই কালীগঞ্জ উপজেলায়। সেখান থেকে বেথুলীর বটগাছের নিচে পৌঁছাতে প্রায় ২টা বেজে যায়।

মধ্য দুপুরে গাছের ছায়ায় বসে ক্লান্তি দূরের পাশাপাশি সজীবতাও অনুভব করি। অজস্র পাখির কিচির-মিচির মন ভালো করে দেয়। বুঝাই যায় না, গাছটির পাশেই সড়ক ও বাজার! অথচ বিরাট গাছটিকে ঘিরে কী নিস্তব্ধ, গহীন পরিবেশ! এরই মাঝে কথা হয় দু-একজন পর্যটক ও এলাকাবাসীর সাথে। এলাকাবাসী জানায়, প্রশাসনের অযত্ন-অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও নানামুখী অত্যাচারের কারণে ঐতিহ্যবাহী বটগাছটি অস্তিত্ব বিলীনের হুমকিতে পড়েছে।

স্থানীয় বেলায়েত মিয়া বেঁচে থাকা পর্যন্ত গাছের দেখাশোনা করতেন। তিনিই এই গাছের কাছে সর্বপ্রথম দোকান দেন, কালক্রমে সেখানে বাজার গড়ে ওঠে। কথা হয় কয়েক বছর ধরে বটগাছটির পরিচর্যা করে যাওয়া আব্দুল খালেকের (৪৫) সঙ্গে।

এই গাছের টানে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন মিস্ত্রীর পেশা। এখানে আসা সরকারি কর্মকর্তা ও পর্যটকদের দেওয়া অর্থে কোনোমতে চলছে তার সংসার। পাশাপাশি গাছের দায়িত্বে সরকারিভাবে নিয়োগের স্বপ্নও রয়েছে তার। তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার তার চাকরি স্থায়ী করার আশ্বাস দেওয়া হলেও এখনও তা হয়নি।

আব্দুল খালেক বলেন, গাছটি বন বিভাগের অধীনে থাকলেও এটি রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বরং তিনি নিজ অভিজ্ঞতা থেকে গাছের পরিচর্যা চালিয়ে যাচ্ছেন। বৈজ্ঞানিক উপায়ে রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়া ও স্থানীয়দের ডাল-পালা কেটে নেওয়াসহ নানা অত্যাচারে মারা যাচ্ছে অনেক উপবৃক্ষ। দেখতে পাই, বন বিভাগের এক কর্মীকে গাছের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রাখা হয়েছে। বৃহৎ এই গাছের পরিচর্যায় সার্বক্ষণিক দায়িত্বপ্রাপ্ত আরও লোক দরকার বলে মানছেন যশোর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান।

এ নিয়ে তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। একই বিষয় নিয়ে আগে কথা বলেছিলাম সদ্যসাবেক যশোর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সারওয়ার আলমের সঙ্গেও। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনীয় বাজেট ও লোকবল চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকল্প পরিকল্পনা পাঠানো হয়েছে। বটগাছের পাশে একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। যেখান থেকে একনজরে গাছ ও আশেপাশের এলাকা দেখা যাবে।’

প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছটি বেড়ে উঠছেও প্রাকৃতিকভাবেই। রাস্তার উপর ছড়িয়ে পড়া ডাল-পালা স্থানীয়রা কেটে নেওয়ায় গাছের বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একপাশে বাঁশঝাড়সহ জঙ্গলের কারণেও বাড়তে পারছে না গাছটি।

এ ব্যাপারে সারওয়ার বলেছিলেন, ‘বাঁশঝাড়সহ জঙ্গল কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গাছের পাশ দিয়ে যাওয়া মাটির রাস্তাটি আরও দূরে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবও তুলে ধরব।’ এখনও অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।

কালীগঞ্জ সদর থেকে বেথুলী পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা নিয়ে কথা না বললেই নয়। প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার রাস্তা স্থানীয় মাহিন্দ্রে পাড়ি দিতে গিয়ে হার-গোড় সব খুলে যাওয়ার উপক্রম! রাস্তার প্রায় বেশিরভাগ অংশই ভাঙা। কোথাও কোথাও উঠে গেছে কংক্রিটও।

রাস্তার অবস্থা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয় কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুবর্ণা রানী সাহার সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে এলজিইডির (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর) সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি। এলজিইডির সঙ্গে আলোচনার কথা বলেছিলেন তৎকালীন বন কর্মকর্তা সারওয়ারও। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে রাস্তাটি মেরামত করেছে।

নামকরণ : শুধু আকার-আয়তনের দিক থেকেই নয়, নামকরণের দিক থেকেও অনন্য বটগাছটি। ‘সুঁই’ (সূঁচ) থেকে নয়, ‘শোয়া’ থেকে নাম হয় সুইতলা। জনশ্রুতি আছে, কুমার বাড়ির একটি কুয়ার পাড়ে জন্মায় এই গাছের মূল অংশ। বটগাছটি এতটাই ঘন ছিল যে এর নিচে রোদ, বৃষ্টি, কুয়াশা পড়ত না। প্রচণ্ড গরমের সময়ও গাছের নিচে থাকত ঠাণ্ডা।

পথিক, কৃষক থেকে শুরু করে নানা পেশা-বয়সি লোকজন গাছের তলায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিত। দুপুর ও বিকালে দেখা যেত ডালে ডালে শুয়ে ঘুমাচ্ছে মানুষ। এ থেকেই এটি ‘সুইতলা বটগাছ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

বেথুলী মৌজা ও গ্রামে অবস্থিত হওয়ায় বেথুলীর বটগাছ হিসেবেও স্থানীয়দের কাছে এর পরিচিতি রয়েছে। ইদানীং গাছটি বেশি পরিচিতি পেয়েছে ‘মল্লিকপুরের বটগাছ’ হিসেবে।

মল্লিকপুর নামে সেখানে কোনো গ্রাম না থাকলেও বটগাছ ঘিরে গড়ে ওঠা বাজারের ব্যবসায়ীরা এই নামের প্রচলন ঘটান। গাছের স্থানটির সর্বশেষ মালিক ছিলেন রায় গ্রামের জোতদার নগেন সেনের স্ত্রী শৈলবালা সেন। পরবর্তীতে এটা খাস হয়ে যায়। ২০০৯ সালে গাছটি বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করে জেলা প্রশাসন।

শেয়ার করুন: