বিষাক্ত ছোট প্রাণী

জল ও স্থলের কয়েকটি বিষাক্ত ছোট প্রাণী

আমাদের চেনাজানা পরিবেশের ভেতরই এমন কিছু বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ বাস করে, যাদের কামড় কিংবা নির্গত তরল মানুষের জন্য প্রাণঘাতী পর্যন্ত হতে পারে। মশা, সাপ, ব্যাঙসহ বেশকিছু ক্ষতিকর প্রাণী আমাদের আশপাশেই বাস করে। কিন্তু এগুলোর বাইরে প্রকৃতির রহস্যময় জগতে বিভিন্ন প্রজাতির কীট-পতঙ্গ হরহামেশাই ঘুরে বেড়ায়। তাদের নির্গত কোনো তরল কিংবা একটি কামড় জীবন সংশয়ের মুখে ফেলে দিতে সক্ষম। বেশিরভাগ সময় প্রাণীরা নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে নিজের বিষাক্ত অস্ত্র কাজে লাগায়। আকারে ছোট হলেও কাজের বেলায় সিদ্ধহস্ত এসব প্রাণীর কোনোটি জলে কিংবা স্থলেও বসবাস করে। এমন কিছু বিষাক্ত ক্ষুদ্র প্রাণীর পরিচয় নিয়েই সাজনো হয়েছে আজকের লেখাটি।

১. নিভৃতচারী বাদামি মাকড়শা: পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ২০,০০০ মাকড়শার প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যাদের ভেতর গুটিকয়েক বাদে সবগুলো প্রজাতি বিষাক্ত নয়। আর বিষাক্ত কয়েকটি প্রজাতির ভেতর বাদামি মাকড়শাগুলো অন্যতম, যাদের মাঝে মাঝে আমেরিকার আরিজোনা এবং টেক্সাসে দেখা যায়। মাকড়শার বৈশিষ্ট্য অনুসারে এরা সাধারণত নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত হয় না।
মাকড়শার বৈশিষ্ট্য অনুসারে এরা সাধারণত নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত হয় না; Image Source: poison.org

বাদামি মাকড়শাটির বৈজ্ঞানিক নাম 'Loxosceles recluss', অন্যান্য মাকড়শার ৮টি চোখ থাকলেও এর রয়েছে ৬টি চোখ। অন্ধকার, উষ্ণ আর শুষ্ক জায়গা পেলে সেখান থেকে সহজে বেরিয়ে আসে না এরা। আপাত ঝুট-ঝামেলাহীন নিরীহ আচরণের এই প্রাণীটির শরীরে উৎপাদিত হয় একধরনের এনজাইম যা মানুষের চামড়ার সংস্পর্শে এলে জ্বালাপোড়া ভাব তৈরি করবে। সামান্য পরিমাণ তরল প্রাণঘাতী না হলেও অতিরিক্ত পরিমাণে বিষাক্ত তরলটি চামড়ার বড় রকমের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে মাকড়শাটি , যদিও এটির আক্রমণে মানুষ মারা গিয়েছে এমনটি জানা যায় না।

২. প্লাটিপাস: অদ্ভুত এক প্রাণী প্লাটিপাস, জীববিজ্ঞানের ভাষায় যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না! চুল আছে আবার লম্বা চঞ্চুও আছে, ডিম দেয় আবার দুধও উৎপাদন করে! পূর্ব ও দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া এবং তাসমানিয়ার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এদের বাস। সে যা-ই হোক, পৃথিবীতে তো কত অদ্ভুত জিনিসই আছে! কিন্তু প্রাণীটিকে লিস্টে রাখার কারণ এর পা, প্লাটিপাসের পায়ে নখর রয়েছে যেগুলো বিষাক্ত। মাত্র একটি আঁচড় একজন মানুষকে অন্তত তিন মাসের জন্য বিছানায় শুইয়ে রাখতে পারে। আজ পর্যন্ত এই বিষের কোনো ব্যথানাশক তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আক্রান্ত অংশে সাধারণত পেশিগুলো শুকিয়ে যেতে শুরু করে এবং ব্যাথার তীব্রতা বাড়ে-কমে, মৃত্যু ছাড়াই মৃত্যুর মতো মনে হবে প্রতিটি মুহূর্ত। তাই নিরীহ দেখতে প্লাটিপাস থেকে দূরত্ব বজায় রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।

৩. স্টোনফিশ: সাগরতলে একজন ডুবুরিকে আক্রমণ করার মতো প্রাণীর অভাব নেই। নাজুক অবস্থায় থাকার কারণে হাঙর কিংবা তারচেয়ে ছোট যেকোনো প্রাণীই একজন মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আর এরকমই একটি প্রাণী হলো স্টোনফিস। সাগরতলে পাথরের সঙ্গে লেগে থেকে নিজেকে আড়ালে রাখে ছোট্ট প্রাণীটি। তারপর সুযোগ বুঝে পিঠের কাঁটাগুলো দিয়ে শত্রুকে আঘাত করে।
সাগরতলের যেকোনো প্রাণীর জন্য তো বটেই মানুষের জন্যও তাদের স্পাইনের আঘাত মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কারণ স্পাইনগুলোতে রয়েছে একধরনের প্রোটিন যা রক্তের সংস্পর্শে এসে শত্রুকে পাকড়াও করে ফেলে। পানির নিচে এমনিতেই অক্সিজেনের ঘাটতি থাকে, সেখানে কেউ যদি সৌভাগ্যক্রমে স্টোনফিশের আঘাত পায় তবে তার মৃত্যু সময়ের ব্যাপার। কারণ শরীরে অক্সিজেন চলাচলে বাধা প্রদান করে এর বিষ এবং খিঁচুনির কারণে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে।

৪. লায়নফিস: স্টোনফিশের মতো এতটা ভয়ঙ্কর না হলেও লায়নফিস নিজের শত্রুকে ছাড় দিতে রাজি নয়। তাই নিজের স্পাইনের সহায়তায় বিষাক্ত তরল শত্রুর শরীরে ছড়িয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না সে। মৃত্যুর ঝুঁকি না থাকলেও শরীরে খিঁচুনি এবং শ্বাসকষ্ট তৈরি করতে পারে প্রাণীটির বিষাক্ত তরল। তাই সময়মতো পানির উপর উঠে আসতে ব্যর্থ হলে মৃত্যুও হতে পারে আক্রান্ত মানুষটির। বর্তমানে বাইরের দেশে অনেকেই লায়নফিস নিজেদের খাদ্য তালিকায় যুক্ত করছেন এবং একুরিয়ামেও সোভা পায় প্রাণীটি। কারণ এর বিষ কেবল স্পাইনেই সীমাবদ্ধ থাকে, শরীরের অন্যান্য অংশে এই বিষ তাই ছড়িয়ে পড়ে না।

৫. তারামাছ: সমুদ্রের এই দৃষ্টিনন্দন প্রাণীটির এখন পর্যন্ত ১,৫০০ প্রজাতির দেখা পাওয়া গেছে। পৃথিবীর যেকোনো সমুদ্র অঞ্চলে তারামাছের দেখা মেলে এবং পানির প্রায় ৬,০০০ মিটার তলদেশেও এর বিচরণ রয়েছে। তারামাছের সাধারণত ৫টি বাহু থাকে, যদিও অনেক প্রজাতিতে আরও বেশি বাহু থাকে। তারামাছের বাহুগুলোতেই এদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজুদ থাকে। বাহুগুলোতে অসংখ্য গ্রন্থি রয়েছে, যেগুলো দিয়ে একধরনের বিষাক্ত তরল বের হয়। কাঁটাযুক্ত আরেক প্রজাতির তারামাছ রয়েছে যারা সমুদ্রতলে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। একজন মানুষের জন্য তারামাছের প্রথম আক্রমণটি খুব সাধাসিধে হতে পারে। কিন্তু সময়-সুযোগ পেলে মানুষের মৃত্যু ডেকে আনার মতো অস্ত্র প্রাণীটির রয়েছে।

৬. আরিজোনা বার্ক স্করপিয়ন: মোটামুটি পৃথিবীর বেশিরভাগ কাঁকড়া প্রজাতিই তেমন বিষাক্ত নয়। কিন্তু এদিক থেকে আরিজোনা বার্ক স্করপিয়ন খুবই বিষাক্ত একটি প্রাণী। মেক্সিকোর উত্তর-পশ্চিমে এবং আমেরিকার কিছু মরু এলাকায় বিষাক্ত কাঁকড়াটির দেখা পাওয়া যায়। মরুভূমির সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে নেওয়া প্রাণীটি রোদের তীব্রতার কারণে পাথর কিংবা অন্য কোনো অবলম্বন খুঁজে নিয়ে তার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। মরুভূমিতে টিকে থাকতে গিয়ে প্রতিনিয়ত অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় তাকে। তাই নিজের গোপন অস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজনে সবসময়ই সে তৈরি থাকে।

উত্তর আমেরিকার প্রাণীটির বিষ একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহে প্রবেশ করলে ব্যাথার অনুভূতি জাগাবে। আঘাত পাওয়া অংশে তীব্র ব্যথা ছাড়াও ঘন্টাখানেকের জন্য ওই স্থানটি অবশ হয়ে থাকতে পারে। আবহাওয়ার আনুকূল্য না থাকার কারণে শ্বাসকষ্টেও ভুগতে পারেন আক্রান্ত ব্যক্তি।

৭. গিলা মনস্টার: আমাদের বাসাবাড়িতে যে টিকটিকিগুলো বাস করে তাদের চেয়ে আমেরিকান এক বিশেষ প্রজাতির টিকটিকি রয়েছে, যেগুলো খুব একটা বিষাক্ত না হলেও যথেষ্ট বেদনাদায়ক। উত্তর আমেরিকা এবং মেক্সিকোর বিশেষ কিছু এলাকায় এদের দেখা মেলে। এদের কামড়ে ত্বকে চুলকানি এবং ক্ষত তৈরি হতে পারে, কিন্তু কখনোই সেগুলো মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। সাধারণত পানি এবং জীবাণুনাশক দিয়ে আক্রান্ত অংশ পরিষ্কার করলে কিছুদিনের ভেতর যেকেউ সুস্থ হয়ে যেদে পারে।

৮. ব্ল্যাক উইডো: মাকড়শা প্রজাতির ভেতর আশ্চর্যজনকভাবে ব্ল্যাক উইডো অনেক বেশি বিষাক্ত। ছোট আকারের এমন একটি প্রাণীর জন্য এই বিষের পরিমাণ অনেক বেশিই মনে হয়! কারণ এর একটিমাত্র কামড় একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। কামড়ের প্রাথমিক তীব্রতা সামাল দিতেও একজন মানুষকে হিমশিম খেতে হয়। কারণ আক্রমণের সঙ্গে-সঙ্গেই ব্ল্যাক উইডোর বিষ খিঁচুনি তৈরি করে শরীরে, সেই সঙ্গে তীব্র ব্যথার অনুভূতি তো রয়েছেই। সময় গড়াতে গড়াতে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে অবশ করে দিতে শুরু করে এর বিষ। একদিনের বেশি যদি এর বিষ শরীরে থাকে তবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব না-ও যেতে পারে।

৯. মধু মৌমাছি: মধু মৌমাছি কিংবা আফ্রিকান মৌমাছি খ্যাত ছোট পোকাটি এর আক্রমণাত্মক ভঙ্গির জন্য সুপরিচিত। তারা দলবেঁধে নিজেদের শত্রুকে তাড়া করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় এক মাইল দূর পর্যন্ত যাওয়ার পর নিজেদের নিরাপদ ভাবে। মানুষকে কামড়ানোর সময় চোখ ও মুখই তাদের পছন্দসই জায়গা! দলবেঁধে কামড়ায় বিধায় এদের বিষের তীব্রতা একজন মানুষকে মেরে ফেলতে পারে। পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ এই ক্ষুদে পোকাটি। মানুষ ছাড়াও ঘোড়া ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য সাক্ষাত বিপদ এটি।

১০. বুলেট পিঁপড়া: সমস্ত পিঁপড়া প্রজাতিগুলোর ভেতর বুলেট পিপড়া আকারে সবচেয়ে বড় হয়। এর প্রতিটি কামড় বুলেটের মতো এসে বিঁধে বলেই এমন নামকরণ। সত্যিকার অর্থে এই পিপড়ার একটিমাত্র কামড় মৌমাছির চেয়ে অন্তত ৩০ গুণ বেশি দংশন করে। নিকারাগুয়া এবং প্যারাগুয়ের রেইনফরেস্টে এদের বসবাস। তাই লোকালয়ের মানুষ হিসেবে আপনার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই! বুলেট পিঁপড়া সাধারণত বড় গাছের গোড়ায় বসত গড়ে এবং একটি কলোনিতে শত শত পিপড়া বাস করে। নিজের শত্রুদের শিক্ষা দিয়ে ছাড়তে বুলেট পিঁপড়ার কোনো জুড়ি নেই।

শেয়ার করুন: