কুতুব মিনার

কুতুব মিনার, নাকি মানারা?

ইজাজুল হক
উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন কুতুব মিনার। তবে এই স্থাপনার নাম কি আসলেই কুতুব মিনার ছিল? ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইংরেজ শাসনামলের আগে কেউ এই মিনারকে ‘কুতুব মিনার’ নামে আখ্যায়িত করেননি। কুতুব মিনারের শিলালিপিতেও এটিকে ‘কুতুব মিনার’ বলা হয়নি; বরং শুধু ‘মানারা’ বলা হয়েছে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, সমসাময়িক দুই ঐতিহাসিক হাসান নিজামি ও মিনহাজ তাঁদের রচিত ইতিহাসগ্রন্থে এ মিনারের কথা উল্লেখই করেননি। এ মিনার সম্পর্কে প্রথম নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় ঐতিহাসিক আমির খসরুর কাছ থেকে। তিনি এটিকে ‘জামে মসজিদের মিনার’ বলে অভিহিত করেন। বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতাও এটিকে কুতুব মিনার বলেননি। ঐতিহাসিক আবুল ফিদা বলেছেন ‘জামে মসজিদের আজানখানা’। ফিরোজ শাহ তুঘলক বলেছেন ‘সুলতান মুঈজউদ্দিন সামের মিনার’। সম্রাট বাবরও তাঁর আত্মজীবনী বাবরনামায় ‘কুতুব মিনার’ না বলে এটিকে ‘আলাউদ্দিন খিলজীর মিনার’ নামে আখ্যায়িত করেছেন।

তাইলে কিভাবে এলো এই কুতুব মিনার নামটি? ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি না থাকলেও ব্রিটিশ আমলের কয়েকজন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ এটিকে ‘কুতুব মিনার’ নামে আখ্যা দেন। তাঁদের মধ্যে কানিংহাম, র‌্যাভারটি, উলসলিহেগ, এন আর মুন্সি প্রমুখ অন্যতম। তাঁরা একমত পোষণ করেন যে কুতুব উদ্দিন আইবেক বাগদাদের সুফিসাধক কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার খাকির নামানুসারে এই মিনারকে ‘কুতুব মিনার’ নাম দেন। এভাবেই ঐতিহাসিকদের ভিত্তিহীন কথায় ইংরেজ আমলে ‘কুতুব মিনার’ নামটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

এই আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়, এ মিনার কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার খাকির স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়নি। তবে কী উদ্দেশ্যে এ মিনার নির্মিত হয়—তা নিয়ে একমত হতে পারেননি ঐতিহাসিকরা। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন, এই মিনারের অদূরে অবস্থিত ‘কুওয়াতুল ইসলাম’ মসজিদের আজানখানা হিসেবেই এটি নির্মিত হয়। কেউ বলেছেন, বরং বিজিত অঞ্চলে ইসলামের শক্তি প্রদর্শনের লক্ষ্যেই এটি নির্মিত হয়। সে হিসেবে তাঁরা এটিকে ‘বিজয়স্তম্ভ’ আখ্যা দেন। তবে এই দুটি মত প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত নয়।

সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কথা হলো, দিল্লির সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের কীর্তিগাথা উত্কীর্ণ করার উদ্দেশ্যেই এটি নির্মিত হয়। মিনারের শিলালিপিতে ঘুর সাম্রাজ্যের প্রশস্তি ও কুতুব উদ্দিন আইবেকের কৃতিত্বের কথাই উত্কীর্ণ আছে। শিলালিপির কোনো এক জায়গায় এটিকে ‘মালিক দীনের কীর্তিস্তম্ভ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

তবে ইসলামের শান-শওকত প্রকাশের বাসনা অবশ্যই এ মিনার নির্মাণে কাজ করেছিল—এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। পৌত্তলিকতা ও বহুত্ববাদের মরুভূমিতে একত্ববাদের মহত্ত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে এই অনিন্দ্যসুন্দর মিনার। সেদিকে ইঙ্গিত করেই হয়তো মিনারের শিলালিপিতে লেখা হয়েছে, ‘সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ছায়া পূর্ব থেকে পশ্চিমে ফেলার জন্যই এ মিনার নির্মাণ করা হয়।’

ড. মুহাম্মদ মোখলেছুর রহমান রচিত ‘সুলতানী আমলে মুসলিম স্থাপত্যের বিকাশ’ অবলম্বনে

শেয়ার করুন: