কোরআনে বর্ণিত এক সংগ্রামী মায়ের গল্প

মারিয়াম বিনতে ইমরান। কোরআনে বহুল উচ্চারিত একটি নাম। ঈসা (আ.)-এর পুণ্যাত্মা কুমারী মা। পবিত্র কোরআনে যাঁর জন্ম, প্রতিপালন ও সন্তান প্রসবসহ নানা ঘটনা বিবৃত হয়েছে। যাঁর প্রতিটি অধ্যায় ছিল বিস্ময় ও অলৌকিকতায় ভরপুর। আল্লাহ যাঁকে ‘নিজের মনোনীত’ বলে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন এবং বলেছেন, অনেক পুরুষ এমন নারীর সমকক্ষ নয়। একাধিক সহিহ হাদিসেও তাঁর মর্যাদার বর্ণনা এসেছে। একজন নারী ও একজন মা হিসেবে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে মারিয়াম বিনতে ইমরান যে সংগ্রাম করেছেন তা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়।

মারিয়াম (আ.) ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার দীর্ঘ প্রার্থনার ফল। দীর্ঘদিন তাঁরা নিঃসন্তান থাকার পর আল্লাহ তাঁদের সন্তানের সুসংবাদ দান করেন। মূলত বন্ধ্যা-বৃদ্ধা নারীর গর্ভে তাঁর জন্মই ছিল আল্লাহর অপার কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তাকে ও তার ছেলেকে পৃথিবীর জন্য নিদর্শন বানিয়েছি।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৯১)

মারিয়াম (আ.)-এর মা হিন্না মানত করেছিলেন, তাঁর সন্তানকে তিনি আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করবেন। সে বায়তুল মোকাদ্দাসের সেবক হবে। প্রথা ছিল শুধু পুরুষরাই বায়তুল মোকাদ্দাসের সেবক হতে পারত। তাই কন্যাসন্তান জন্মানোর পর তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। পবিত্র কোরআনে সে ঘটনার বিবরণ এভাবে এসেছে, ‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার প্রভু! আমি আমার গর্ভের সন্তানকে তোমার জন্য মুক্ত করে দেওয়ার মানত করেছি। আপনি তা আমার পক্ষ থেকে কবুল করে নিন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাতা।’ অতঃপর যখন তিনি সন্তান প্রসব করলেন, তিনি বললেন, ‘হে আমার প্রভু! নিশ্চয় আমি কন্যাসন্তান প্রসব করেছি। আল্লাহ জানেন তিনি কী প্রসব করেছেন। এবং (কোনো কোনো) পুরুষ (কোনো কোনো) নারীর সমান নয়।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩৫-৩৬)

আল্লাহ তাআলা মারিয়াম (আ.)-এর প্রতিপালনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর জন্য আসমানি খাবারের ব্যবস্থা এবং দ্রুততম সময়ে তাঁর প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করেন। পবিত্র কোরআনে তাঁর বর্ণনায়, ‘নিশ্চয় আমি তার নাম মারিয়াম রাখলাম। ... তার প্রভু তাকে সুন্দরভাবে গ্রহণ করলেন, তাকে উত্তম প্রবৃদ্ধি দান করলেন এবং তার প্রতিপালন করল জাকারিয়া। জাকারিয়া যখন তার নিকট মেহরাবে প্রবেশ করত, তার নিকট খাবার দেখতে পেত। তিনি বলতেন, হে মারিয়াম তুমি এটা কোথায় পেলে? সে বলল, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩৬-৩৭)

মারিয়াম (আ.) জন্ম থেকে যৌবনে উপনীত হওয়া পর্যন্ত একটি পবিত্র ও পরিমণ্ডলে প্রতিপালিত হন। আল্লাহ তাঁকে এক মহা ঈমানি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেন। আল্লাহর অনুগ্রহে তিনি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যৌবনে উপনীত হওয়ার পরপরই (১৩ বছর বয়সে) আল্লাহ তাঁকে ‘মা’ হওয়ার সুসংবাদ দেন। তখন থেকেই শুরু হয় জীবনের সংগ্রাম। একজন পূতপবিত্র কুমারী নারীকে হতবিহ্বল করে দেওয়ার জন্য এই সংবাদটুকু ছিল যথেষ্ট। আল্লাহ বলেন, ‘এই কিতাবে মারিয়ামের কথা উল্লেখ করো, যখন সে তার পরিবার থেকে পূর্ব দিকের নিরিবিলি স্থানে আশ্রয় নিল। সে তাদের থেকে আড়াল হলো, আমি তার কাছে আমার রুহকে (জিবরাইল) প্রেরণ করলাম, সে তার কাছে পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। মারিয়াম বলল, যদি তুমি আল্লাহকে ভয় করো তবে আমি তোমার কাছ থেকে দয়াময়ের কাছে আশ্রয় চাইছি। সে বলল, আমি তোমার প্রভুর কাছ থেকে প্রেরিত, যেন তোমাকে পবিত্র পুত্রসন্তান দান করি। মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার ছেলে হবে, আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ১৬-২০)

এই আয়াতে সতীত্বের প্রতি মারিয়াম (আ.)-এর যে ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে তা চির অনুকরণীয়। আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত নারী হিসেবে নিজের পবিত্রতা রক্ষার তীব্র তাগিদ অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এই আকুতি আরো তীব্রতর হয় যখন তিনি সন্তান প্রসব করেন। কোরআনে অত্যন্ত নিপুণভাবে সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, ‘অতঃপর সে তাকে গর্ভে ধারণ করল এবং তাকে নিয়ে দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। প্রসব বেদনা তাকে খেজুরগাছের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। হায়! এর আগে যদি আমি মরে যেতাম এবং লোকের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ২২-২৩)

এ ছাড়া মারিয়াম (আ.) ছিলেন নবী পরিবারের সদস্য। পারিবারিক সম্ভ্রম ও আভিজাত্যও তাঁকে চিন্তিত করেছিল। এ জন্য তাঁর ওপর অপবাদ ও অবিশ্বাসের বোঝা ভারীও হয়েছিল। মানুষের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েছিলেন তিনি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর সে সন্তান নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে এলো। তারা তাকে বলল, হে মারিয়াম! তুমি তো অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছ। হে হারুনের বোন! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না, তোমার মাও ছিলেন না কোনো ব্যভিচারিণী।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ২৭-২৮)

বিপরীতে মহান আল্লাহও তাঁর এই বান্দিকে দেন সান্ত্বনা, শেখান আত্মরক্ষার কৌশল। প্রমাণ তুলে ধরেন তাঁর পবিত্রতার পক্ষে। কোরআনের ভাষায়, ‘ফেরেশতারা তার নিম্ন পাশ থেকে আহ্বান জানিয়ে বলল, তুমি চিন্তিত হয়ো না। তোমার প্রতিপালক তোমার পায়ের কাছে একটি পানির প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন। তুমি তোমার দিকে খেজুরগাছের ডাল টান দাও, সুপরিপক্ব খেজুর পড়বে। সুতরাং তুমি খাও, পান করো এবং চোখ শীতল করো। কোনো মানুষ দেখলে তুমি বলবে, আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে মৌনতা অবলম্বনের মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কারো সঙ্গে কথা বলব না।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ২৪-২৬)

একজন অসহায় মায়ের প্রতি এর চেয়ে উত্তম দয়া, মায়া ও অনুগ্রহ কী হতে পারে? শুধু তা-ই নয়, সামাজিক নিন্দা, অপবাদ ও অবিচারের রাস্তা বন্ধ করতে মহান আল্লাহ নবজাতক ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.)-এর মুখে কথা ফোটালেন। তিনি বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা, তিনি আমাকে কিতাব দান করেছেন, তিনি আমাকে নবী বানিয়েছেন।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ৩০)

নবজাতক ঈসা (আ.) ‘বান্দা’ শব্দের মাধ্যমে নিজের পরিচয় দিয়ে মায়ের পূতপবিত্রতার সাক্ষ্য দানের পাশাপাশি মহান আল্লাহর সঙ্গে শিরক করার পথও বন্ধ করে দেন।

ঈসা (আ.)-এর জন্ম ও ঊর্ধ্বারোহণের মধ্যবর্তী সময়ের বর্ণনা কোরআন-হাদিসে বিস্তারিত পাওয়া যায় না। তবে ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুযায়ী, আল্লাহর পবিত্র আমানত সন্তানের জন্য মারিয়াম (আ.) আজীবন সংগ্রাম করেছেন। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের কটূকথা ও অপবাদ তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। সন্তানের জীবন রক্ষায় তিনি ফিলিস্তিন ছেড়ে মিসরে হিজরত করেন এবং সেখানে ৩০ বছর অবস্থান করেন। এরপর আল্লাহর নির্দেশে ঈসা (আ.) ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন এবং তাওহিদ ও একত্ববাদের বাণী প্রচার শুরু করেন। তখন সমকালীন ইহুদি জাতি, শাসকগোষ্ঠীসহ অনেকের শ্রেণিশত্রুতে পরিণত হন তিনি। ঘোর এ বিপদের সময় মারিয়াম (আ.) সন্তানকে আগলে রাখেন। আল্লাহর বাণী প্রচারে তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। আল্লাহ তাঁর অসামান্য আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, ‘ইমরানের মেয়ে মারিয়াম নিজের সম্ভ্রমকে সযতনে পূতপবিত্র রেখেছে। অতঃপর আমি তাতে আমার রুহ ফুঁকে দিলাম। আর সে আপন পালনকর্তার বাণী ও কিতাব মনেপ্রাণে সত্যায়ন করেছিল। প্রকৃতপক্ষে সে ছিল অনুগতদের একজন।’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ১২)

ঈসা (আ.)-এর ঊর্ধ্বারোহণের পাঁচ বা ছয় বছর পর মারিয়াম (আ.) ইন্তেকাল করেন। কথিত আছে, তাঁকে দামেস্কে দাফন করা হয়।

শেয়ার করুন: