যেভাবে গড়ে ওঠে দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং

তানিম আহমেদ (ছদ্মনাম) একসময় একটি কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বছর কয়েক আগে নিজ এলাকায় সমবয়সী কিশোরদের নিয়ে কিশোর গ্যাংটি নিজেই গড়ে তুলেছিলেন।

তামিম বলেন, 'শুরুতে মূলত অন্যদের হামলা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্যই আমরা কয়েকজন বন্ধু একত্রিত হই। পরে বেশ বড় একটি গ্যাং তৈরি হয় আমাদের। দেখলাম, এটি একটি ট্রেন্ড। সবাই গুন্ডামি করছে, গ্যাং বানাচ্ছে, দেয়ালে দেয়ালে স্প্রে দিয়ে গ্যাংয়ে নাম লিখছে। তখন আমরাও শুরু করলাম। ৫-৬ টি গাড়ি নিয়ে একসঙ্গে মুভ করতাম। একসময় বেশ বড় একটি গ্যাং তৈরি হয় আমাদের।'

তবে গ্যাং তৈরি হওয়ার পর খুব দ্রুতই অন্য এলাকার গ্রুপগুলোর সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় বলে জানান তামিম। অনেক সময় তুচ্ছ কারণেও ঘটতো মারামারির ঘটনা। এক এলাকার ছেলে অন্য এলাকায় গেলে মারধরের ঘটনা ঘটতো। কাউকে গালি দিলে, 'যথাযথ সম্মান' না দেখালে, এমনকি বাঁকা চোখে তাকানোর কারণেও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। মেয়েলি বিষয় এবং সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব থেকেও অসংখ্য মারামারি হয়েছে বলে জানান তিনি।

'গ্যাংয়ে একসময় কয়েকটি অস্ত্র সঙ্গে রাখা শুরু করি আমরা। এসব দিয়ে মাঝেমধ্যে ফাঁকা ফায়ারিং করা হতো। তবে আমরা কাউকে গুলি করিনি কখনো'- বলেন তামিম। তিনি বলেন, অস্ত্র আসার কিছুদিনের মধ্যেই গ্রুপে মাদকও ঢুকে পড়ে। গ্যাংয়ের কয়েকজনের মধ্যে একসময় লোভ চলে আসে। গ্রুপটাকে কাজে লাগিয়ে টাকা আদায়ের ধান্দা শুরু করেন কেউ কেউ। ছিনতাই শুরু হয়। আর মাদক নেওয়া তো চলে যায় ভয়াবহ পর্যায়ে।

তামিম বলেন, 'দুয়েকজন বিভিন্ন অপরাধে জেলও খেটেছে। মারাও গেছে।' ফলে নিজেকে রক্ষায় নিজের তৈরি গ্যাং থেকে একসময় নিজেই বেরিয়ে আসেন বলে দাবি করেন তানিম। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেয়ালে দেয়ালে অনেক কিশোর গ্যাংয়ের নাম লেখা গ্রাফিতি চোখে পড়বে। ধানমন্ডি লেকের পাশে কয়েকটি সড়কে ঘুরেই আমি এরকম অন্তত ১৫টি কিশোর গ্যাংয়ের নাম দেখতে পেয়েছি।

মূলত স্কুলে পড়তে গিয়ে কিংবা এলাকায় আড্ডা দিতে গিয়ে শুরুতে মজার ছলে এসব গ্রুপ তৈরি হলেও পরে একসময় মাদক, অস্ত্র এমনকি খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়ে।

কিশোর গ্যাং কেন তৈরি হচ্ছে?
সমাজবিজ্ঞানী রাশেদা ইরশাদ নাসির মনে করেন, মূলত দুটি কারণে কিশোররা এসব গ্যাং সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ছে। প্রথমত মাদক, অস্ত্রের দাপটসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। দ্বিতীয়ত এখনকার শিশু-কিশোররা পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট মনোযোগ পাচ্ছে না। ফলে কিশোরদের কেউ যখন বন্ধুদের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংগুলোতে ঢুকছে এবং মাদক ও অস্ত্রের যোগান সহজেই পেয়ে যাচ্ছে তখন তার প্রলুব্ধ হওয়া এবং অপরাধপ্রবণ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

রাশেদা ইরশাদ মনে করেন, একদিকে সমাজে অপরাধী হওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে পরিবারে কিশোরদের একাকী বা বিচ্ছিন্ন না রেখে যথেষ্ট সময় দিতে হবে।

পুলিশের পদক্ষেপ
গত একমাসে কিশোর গ্যাংকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি অপরাধ ও খুনের ঘটনা ঘটে। এর পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে।

গাজীপুরে এক কিশোর হত্যার ঘটনায় 'ভাই-ব্রাদার' নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের আটজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় র‍্যাব। অন্যদিকে ঢাকায় শুরু হয় কিশোর গ্যাং-বিরোধী অভিযান। একদিনেই অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় শতাধিক কিশোরকে। এর মধ্যে শুধু হাতিরঝিল থানাতেই আটক করা হয় ৮৮ জনকে। যদিও পরে অপরাধ খুঁজে না পাওয়ায় ৮০ জনকেই ছেড়ে দেওয়া হয় বলে নিশ্চিত করেছে থানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কিশোর গ্যাং-বিরোধী এ ধরনের অভিযানে ঢালাওভাবে কিশোরদের আটকের ঘটনার সমালোচনাও হচ্ছে।

রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, 'যে কোনো কিশোরকে আটক করে থানা হাজতে আনার আগে সে অপরাধী কি-না, সে বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা উচিত পুলিশের।' তিনি বলেন, 'কোন নিরপরাধ কিশোর কিংবা তার পরিবার যেন ভোগান্তির মধ্যে না পড়ে, হয়রানির শিকার না হয়। নিরপরাধ একজন কিশোরকে হুট করে সন্দেহের ভিত্তিতে আটক করা হলেও তা ওই কিশোরকে ট্রমার মধ্যে ফেলে দিতে পারে।' তিনি বলেন, 'সে যদি তাৎক্ষণিক ছাড়াও পায়, এর পরও এর একটি প্রভাব থাকতেই পারে। একইসঙ্গে ওই পরিবারটিও সামাজিকভাবে হেয় হতে পারে।'

পুলিশের বক্তব্য
পুলিশের মুখপাত্র সোহেল রানা জানান, নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় যখন তারা অভিযান চালান তখন আসলে তাৎক্ষণিক যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ তেমন থাকে না। কিন্তু আটকের পর যারা দোষী নয়, তাদের অভিভাবকদের ডেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে অভিভাবকদেরও খেয়াল রাখা উচিত, তাঁদের সন্তান অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোতে যাওয়া-আসা করছে কি-না।

রানা বলেন, সারা দেশেই পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে তারা নির্দেশ দিয়েছেন কিশোরদের গ্যাং সংস্কৃতি এবং অপরাধ বন্ধ করতে স্কুল-কলেজ, অভিভাবক এবং সুশীল সমাজের সমন্বয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চালাতে।

শেয়ার করুন: