কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার তিন বছর আজ। ২০১৬ সালের এই দিনে (৭ জুলাই) ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের কাছে পুলিশের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহে নামাজ শুরুর কিছু আগে জঙ্গিদের গুলি আর বোমায় কেপে ওঠে চারপাশ। পুলিশের সঙ্গে শুরু হয় জঙ্গিদের বন্দুকযুদ্ধ।
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। হামলায় দুই পুলিশ সদস্য, এক গৃহবধূ, দুই জঙ্গিসহ নিহত হন ৫ জন। আহত হন ৯ পুলিশ সদস্যসহ আরও কয়েকজন। ঘটনার তিন বছর কেটে গেলেও এখনও আতঙ্ক কাটেনি এলাকাবাসীর। শোক কাটেনি নিহত ও আহতদের পরিবারে। ভয়াবহ এ জঙ্গি হামলা মামলার বিচার কার্যক্রমও চলছে ধীর গতিতে।
জঙ্গিদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্নস্থানে মামলা থাকায় তাদের সময় মতো আদালতে হাজির করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারি ভয়াবহ এ হামলার মামলায় আদালতে চার্জশিট দিতেই সময় লেগেছে ২ বছর। চার্জশিট দেয়ার পর মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন শুরু হলেও এরপর আর তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
এ ছাড়া এ মামলার আসামিরা হলি আর্টিসানসহ দেশের অসংখ্য জঙ্গি হামলা মামলার আসামি। মামলায় হাজির করতে তাদের নিতে হয় বিভিন্ন আদালতে। নিরাপত্তা ইস্যুসহ একই সময় বিভিন্ন স্থানে মামলার হাজিরার তারিখ থাকায় বিঘ্নিত হচ্ছে শোলাকিয়া হামলা মামলার আসামিদের নিয়মিত আদালতে হাজির করা। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে তারা কাজ করছে।
২০১৬ সালের ৭ জুলাই সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঈদগাহের কাছে মুফতি মুহাম্মদ আলী মসজিদের কাছে পুলিশের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে অতর্কিত হামলা চালায় জঙ্গিরা। ঈদের খুশির দিনের বোমা আর গুলির শব্দে কেপে ওঠে শোলাকিয়া ময়দানের আশপাশ। হামলায় নিহত হন পুলিশের দুই কনস্টেবল ও এক গৃহবধূ। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাস্থলে নিহত হয় আবির রহমান নামে এক জঙ্গি। আহত অবস্থায় আটক করা হয় শফিউল ইসলাম ডন নামে অপর এক জঙ্গিকে। পরে সেও মারা যায় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে। হামলার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। আজও সেই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে এলাকার মানুষকে।
ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন শোলাকিয়া ঈদগাহের পাশের বাসিন্দা গৌরাঙ্গ ভৌমিকের স্ত্রী গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিক। এখনও শোকে কাতর তার স্বজনরা। গৌরাঙ্গ ভৌমিক জানান, এখনও রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। সেই স্মৃতির কথা মনে পড়ে। আর কোনো পরিবারে যেন এমন দুর্যোগ নেমে না আসে।
দ্রুত মামলার কার্যক্রম শেষ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জঙ্গিদের বিচার ও জঙ্গিমুক্ত দেশ গঠন করা গেলেই ঝর্ণার আত্মা শান্তি পাবে।
জঙ্গি হামলার সময় পাশের একটি বহুতল ভবন থেকে মোবাইল ক্যামেরায় জঙ্গিদের নৃশংসতার দৃশ্য ধারণ করছিলেন ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান রেনু। সে সময় তার স্ত্রী-সন্তান ভয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন।
তিনি জানান, সেদিনের নৃশংসতা কখনও ভুলতে পারব না। এখনও একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করে। এ দিনটি এলেই মনে হয় আবারও জঙ্গি হামলা হবেনা তো!
হামলাস্থলের পাশের আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন বলেন, সেদিন খবর পাওয়ার পর এখানে ছুটে আসি। ছাত্ররা এত ভয় পেয়েছিল যে এক সপ্তাহ স্কুল ছুটি দিতে হয়েছিল।
মুফতি মুহাম্মদ আলী মসজিদের ইমাম হামলার পুরো ঘটনা দেখেন মসজিদের দ্বিতীয় তলা থেকে। তিনি জানান, এমন বর্বরোচিত হামলার পর স্বাভাবিক হতে কয়েকদিন সময় লেগেছিল তার। ইসলাম কখনও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। জঙ্গিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই নিহতদের আত্মা শান্তি পাবে।
জানা গেছে, মামলার পুলিশি তদন্ত চলার সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শোলাকিয়া হামলায় জড়িত ৫ জঙ্গি নিহত হয়। এ ছাড়া ঘটনার সময় আবির রহমান নামে এক জঙ্গি মারা যায়। আহত অবস্থায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার অপর জঙ্গি শফিউল ইসলাম ওরফে ডনও পরবর্তীতে র্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ারে নিহত হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে দুই বছর পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ৫ আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ।
এরই মধ্যে চার্জ গঠনের পর জঙ্গি হামলা মামলায় শুরু হয়েছে বিচার কার্যক্রম। তবে জঙ্গিদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে হলি আর্টিসানসহ অন্যান্য মামলা থাকায় তাদের নিয়মিত আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না।
কিশোরগঞ্জের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক জানান, রাষ্ট্রপক্ষ যত দ্রুত সম্ভব মামলাটি নিষ্পত্তির চেষ্টা করছে। এ মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি জানান, আগামী ২২ জুলাই আসামিদের আদালতে হাজির করার কথা রয়েছে। আসামিরা কাশিমপুর কারাগারে রয়েছে। সিকিউরিটি সেল থেকে অনুমতি পেলেই তাদের কিশোরগঞ্জ আদালতে আনা হবে।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো: মাশরুকর রহমান খালেদ বিপিএম (বার) জানান, হামলায় নিহত ও আহতদের পরিবারকে পুনর্বাসনসহ পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে আমরা আশা করছি।