ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করে বাজেট তৈরি করুন

আগামী অর্থবছরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করেই ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) আইন ২০১২ বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষভাবে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের মতামতকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। এনবিআর কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, শুধু ভ্যাট আইন নয়, রাজস্ব বাজেটের সব ক্ষেত্রে এফবিসিসিআইয়ের সুপারিশ গুরুত্ব দিয়ে আগামী বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেট বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শ নিতে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে এনবিআর বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তারা গতকাল সকাল ১০টায় গণভবনে যান। এ সময় সেখানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের উপস্থিতিতে বৈঠক চলে টানা চার ঘণ্টা। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এনবিআর সূত্রে এসব জানা যায়।

সূত্র জানায়, গতকালের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বাজেট প্রস্তাব পেশের পর ভ্যাট আইন ২০১২ নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক হলে দায়ী ব্যক্তিকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। বৈঠকের শুরুতে অর্থমন্ত্রী ও এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে প্রধানমন্ত্রী আগামী বাজেটে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে কী কী পদক্ষেপ থাকছে তা জানতে চান।

প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগ খরচ কমানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, খরচ কমলে বিনিয়োগ বাড়বে। দেশের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী না হলে বিদেশিরা আসবে না। দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে এনবিআরকে কাজ করতে হবে। সরকার বিতর্ক চায় না। সবাইকে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশে যে উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়েছে তার ধারা ধরে রাখতে হবে।

বিনিয়োগ বিষয়ে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বর্ণনায় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘চলতি বাজেটে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে যেসব পদক্ষেপ আছে, তার সবই থাকছে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, মূলধনী যন্ত্রপাতি, কারখানার কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি আমদানিতে ছাড় থাকছে। কর অবকাশ সুবিধা বহাল থাকছে। শহরের বাইরে কারখানা নির্মাণে রাজস্ব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।’

শিল্পে বেশি ব্যবহৃত কিছু কাঁচামালের নাম উল্লেখ করে চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে আগামী বাজেটে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কাঁচামাল বিনা শুল্ক ও ন্যূনতম শুল্কে আমদানির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।’ দেশি শিল্পের সুরক্ষা দিতে কিছু আমদানি পণ্যে শুল্ক আরোপের কথাও জানান মোশাররফ হোসেন। দেশে মোবাইল ফোনসেট, টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, এসিসহ সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত পণ্য উৎপাদনে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।

তৈরি পোশাক শিল্পের মতো সম্ভাবনাময় অন্যান্য শিল্প খাতে রাজস্ব ছাড়ের বিষয়গুলো উল্লেখ করে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আগামী বাজেটে ওষুধ, চামড়া, অটোমোবাইল, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, কম্পিউটার, তথ্য-প্রযুক্তিসহ আরো কিছু খাতে উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে বড় ধরনের রাজস্ব সুবিধা দেওয়া হবে।

বৈঠকে আগামীতে ভ্যাট আইন ২০১২ সম্পর্কিত এনবিআরের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত জানানো হয় প্রধানমন্ত্রীকে। চার ঘণ্টা বৈঠকের প্রায় অর্ধেক সময় পার হয় ভ্যাটের বিষয়ে আলোচনায়।

প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে সতর্ক করে বলেন, ভ্যাটের হারের অজুহাত দেখিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম যাতে বাড়াতে না পারে সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। অভিন্ন ভ্যাট হারের পরিবর্তে বহুস্তর ভ্যাট হারে প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। আগামী অর্থবছরের জন্য ভ্যাট এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত হিসেবে নির্ধারণে অর্থমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের প্রতি প্রধানমন্ত্রী সম্মতি জানান।

এনবিআর চেয়ারম্যান এ সময় জানান, ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন হার শূন্য শতাংশ ধার্য থাকছে। বর্তমানেও একই হার। তবে সেবা খাতে ভ্যাট হারের স্তর কমানো হচ্ছে। উচ্চহারে থাকা পণ্য নিম্ন হারে নেওয়া হচ্ছে।

নিম্ন হারে থাকা পণ্য উচ্চহারে আনা হচ্ছে না। তবে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্যের ভ্যাট উচ্চ হারের স্তরে আনা হবে। এ সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, কোনো পণ্যের বিষয়ে ব্যবসায়ীরা আপত্তি করলে প্রয়োজনে তা সংশোধন করা যাবে।

বৈঠকে এফবিসিসিআইয়ের দাবি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী জানতে চান। এনবিআর কর্মকর্তারা তাঁকে জানান, ভ্যাট আইন ২০১২-তে এনবিআর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। আদায়ের কঠোরতা কমানো হয়েছে।

অভিন্ন হারের পরিবর্তে বহুস্তর করা হয়েছে। রপ্তানিকারদের জন্য শূন্য হার বহাল থাকছে। একক হারের পরিবর্তে একাধিক হার, ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৩৬ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৫০ লাখ টাকায় উন্নীত করা, টার্নওভার করের সীমা তিন কোটি টাকা পর্যন্ত ৪ শতাংশ ভ্যাটসহ অন্যান্য বিষয়ে এ সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বৈঠকে আলোচনায় করপোরেট কর হারের বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। প্রধানমন্ত্রী করপোরেট কর হার কমাতে নির্দেশ দেন। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ বহাল রাখতে বলেন।

বৈঠকের একপর্যায়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আগামী অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমানোর আবেদন জানালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামীতে আর ঘাটতি দেখতে চাই না। রাজস্বের আওতা বাড়ান। শহরে বসে করদাতা সংগ্রহ করা যাবে না। এ জন্য উপজেলায় যেতে হবে। করদাতা সংগ্রহে নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। ই পেমেন্ট, ইটিআইএন, ই রিটান দাখিল বাধ্যতামূলক করতে বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি অর্থবছরের শেষ সময়ে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা হচ্ছে। এ ধারা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ সম্পদের পূর্ণ ব্যবহারে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে।

করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোর পক্ষে এনবিআর বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনো মন্তব্য করেননি বলে জানা গেছে। এনবিআর চেয়ারম্যান বৈঠকে বলেন, আগামী অর্থবছরে প্রযুক্তির ব্যবহারে জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে ম্যানুয়াল পদ্ধতি উঠিয়ে দেখা হবে না। কারণ এখনো অনেকে প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়নি।

আলোচনাকালে অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে করদাতা সংগ্রহে আউটসোর্সিংয়ের মতো নতুন কৌশল নেওয়ার বিষয় প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। আগামী বাজেটে অর্থপাচাররোধে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানো হয়।

অর্থমন্ত্রী বলেন, এনবিআরের লোকবলের সংকটে কী কী পণ্য আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে তা যাচাই করতে কিছুটা সমস্যা হয়। এ সমস্যা দূর করতে সব বন্দরে স্ক্যানার বাধ্যতামূলক করা হবে। চালানে পণ্যের নাম ও পরিমাণের সত্যতা স্ক্যানারে যাচাই করে ছাড় করা হবে।

শেয়ার করুন: