রঙ, ভাতের মার ও কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে আইসক্রিম

রাজবাড়ী জেলার প্রায় ৩০ টি অনুমোদনহীন কারখানায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্নমানের রঙ, এরারুট,ভাতের মার,নারকেল ও কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে আইসক্রিম। এসব আইসক্রিম খেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ ও শিশুরা।

সরেজমিনে রাজবাড়ী শহরের ডিম্পল মিল্ক ভিটা আইসক্রিম, সদর উপজেলার গোয়ালন্দমোড়ের জমজম আইসক্রিম ও মদিনা সুপার আইসক্রিম,বালিয়াকান্দি মিতালী আইসক্রিম এবং খানখানাপুরের রুচি আইসক্রিম কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে আইসক্রিম।

অপোরিশোধিত পানি মিষ্টি করতে চিনির পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে স্যাকারিন। আর গরুর দুধের পরিবর্তে মেয়াদোত্তীর্ন গুড়ো দুধ। আকর্ষণীয় ও মজাদার ও দ্রুত জমাট বাধতে করতে মেশানো হচ্ছে নিম্নমানের রঙ, এরারুট,ভাতের মার,নারকেল। অপরিচ্ছন্ন বালতিতে খালি হাতেই মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকারক সব উপকরণ।

পানি রাখার হাউসে রয়েছে দীর্ঘ পুরনো লবণ মেশানো নোংরা পানি। হাউসের ঢাকনা দেওয়া হয়েছে কাঠ দিয়ে। তৈরি করা আইসক্রিমে পড়ছে ধুলোবালি আর শ্রমিকের গায়ের ঘাম। অস্বাস্থ্যকর এসব আইসক্রিম বাহারি সব মোড়কে প্যাকেটজাত করে সরবরাহ করা হচ্ছে বিভিন্ন দোকানে। দোকানে প্রতিটি আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। প্রচন্ড দাবদাহে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য শিশুদের পাশাপাশি বড়রাও খাচ্ছেন এই আইসক্রিম। এসব খেয়ে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে।

কারখানা মালিকদের কেউ কেউ অনুমোদন না থাকা এবং আইসক্রিমে অস্বাস্থ্যকর উপাদান ব্যবহারের কথা স্বীকার করেছেন। কেউ আবার মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স দেখিয়েই সব অনুমোদন আছে বলে দাবি করেছেন। জমজম আইসক্রিমের মালিক শাহাদত হোসেন বলেন, ‘অনেক বড় বড় কারখানাতেই বিএসটিআই এর লাইসেন্স নেই।

আর আমরা তো ছোট কারখানা। যদি লাইসেন্স করতে হয় তাহলে করে নিবো।’ এসব মালাই কারখানায় শিশুরা কম মজুরীতে কাজ করছে। নোংরা পরিবেশে হাতে গোল্বস্ ব্যাবহার না করে মালাই চটকদার প্যাকেটে ভরছে শিশুরা।

ডিম্পল মিল্ক ভিটা আইসক্রিমের ম্যানেজার দাবি করেন, ‘আইসক্রিম তৈরি করতে স্যাকারিন ব্যবহার করতেই হয়। স্যাকারিন ছাড়া আইসক্রিম তৈরি হয়না। তাই স্যাকারিন ব্যবহার করি। তবে স্যাকারিনের সঙ্গে চিনিও ব্যবহার করা হয়’।

অপরদিকে মদিনা সুপার আইসক্রিম কারখানার মালিক লক্ষী বেগম দুই বছর আগে মেয়াদ শেষ হওয়া স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স দেখিয়েই তার কারখানার সকল অনুমোদন আছে বলে দাবি করে বসেন।

আর এসব অনুমোদনহীন মালাই ফ্যাক্টরির মালিকরা অনেকেই সরকার দলীয় নেতাকর্মী দোহাই দিয়ে প্রশাসনের সর্তকতার কোন ভ্রæক্ষেপও করছে না। তবে গত ১৫মে রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর এলাকার জমজম আইক্রিম-এ সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসারের ভ্র্যামমান আদালত ত্রিশ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন।

অস্বাস্থ্যকর এসব আইসক্রিমের বিষয়ে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. শাহনিমা নার্গিস বলেন, আইসক্রিমে অপোরিশোধিত পানি ব্যবহার করার কারণে এগুলো খেয়ে মানুষের ডায়রিয়া ও টায়ফয়েড জ্বর হচ্ছে।

চিনির পরিবর্তে স্যাকারিন ব্যবহার করার কারণে চিনির যে ফুড ভ্যালু সেটা পাওয়া যাচ্ছেনা। স্যাকারিন হচ্ছে একটা কেমিক্যাল; যেটার নাম হচ্ছে সালফোনামাইট। এই কেমিক্যাল মানুষের শরীরে অ্যালার্জিক রি-অ্যাকশন, স্ক্রিনের ক্ষতি, ডায়রিয়া ও শ্বাসের সমস্যাসহ নানান ক্ষতি করে।

আর নির্দিষ্ট ফুড কালারের পরিবর্তে আইসক্রিমে নিম্নমানের যেসব রঙ ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এই রঙ হচ্ছে ক্যান্সারের একটা বড় উৎস; যা দীর্ঘসময় খেলে ক্যান্সার হয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া এই রঙ খাওয়ার কারণে শিশুদের আচরণ খিটখিটে ভাব হয়ে তাদের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজবাড়ী জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, বিএসটিআইয়ের যেসকল ম্যানডেটরি প্রোডাক্ট আইটেম রয়েছে তার মধ্যে আইসক্রিম একটি অন্যতম প্রোডাক্ট।

অর্থাৎ আইসক্রিম তৈরি করতে অবশ্যই বিএসটিআইয়ের অনুমতি লাগবে। কিন্তু রাজবাড়ীতে আমরা যতোগুলো আইসক্রিম কারখানা দেখেছি তাদের একটিরও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেই।

তারা ঘনচিনি ও রঙ ব্যবহার করে আইসক্রিম তৈরি করছে। যে কারণে আমরা সবাইকে সতর্কতামূলক জরিমানা করছি। তাদেরকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। এরপরেও যদি তারা আমাদের কথা না শোনে তাহলে পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন: