গহীন

গহীনকে কারো কাছে দিতে চাইছেন না পলি বেগম

ঢাকা শহরের রাস্তা-ঘাটে কত বাচ্চা, কত শিশুকে মানুষ এতিমখানায় রেখে আসে। প্রতিদিন কত শিশু এতিম হচ্ছে, তাদের প্রতি কারও মায়া হচ্ছে না, তাদের কাউকে নিতে পারছে না, সবার চোখ কেন এই মেয়েটার দিকে? গহীন কি কোনো সোনার মোহর’— চোখের পানি মুছতে মুছতে বলছিলেন পলি বেগম।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) শিশু হাসপাতালের নির্ধারিত কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, একটি বেডে গহীনকে কোলে নিয়ে বসে আছেন পলি বেগম। গোলাপী রঙের একটি কাঁথা আর তোয়ালে দিয়ে পুরো শরীর মোড়ানো। কেবল মুখটুকুই খোলা। আর সে মুখ দেখতেই হাসপাতালে কয়েক’শ মানুষ ভিড় জমিয়েছেন। হাসপাতালে এসেছে কয়েক হাজার ফোন, সংশ্লিষ্ট থানায় গহীনকে পাওয়ার জন্যও টেলিফোন করেছেন হাজারো মানুষ।

আর তাই গহীনের মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে পলি বেগম বারবার বলছিলেন, ‘সবাই কেন গহীনের দিকে চোখ দিচ্ছে, গহীন কি কোনো সোনার মোহর?’

এর আগে, গত ১৪ মে সন্ধ্যায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকার শিশু হাসপাতালের একটি বাথরুমের ভেতর থেকে এক নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, ‘তারা যখন বাচ্চাটিকে পেয়েছেন তখন তার বয়স ছিল তিন দিন।’ পরে ওই কন্যাশিশুর নাম রাখা হয় ‘গহীন’। শিশুটি সুস্থ রয়েছে বলেও জানান শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শেখ শরীফ শাহীন।

শিশুটিকে উদ্ধারের পর ওই হাসপাতালেই ভর্তি এবং থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার (১৬ মে) দুপুর দেড়টার দিকে ছোটমনি নিবাসের কর্মকর্তাদের কাছে তুলে দেওয়া হয় শিশু গহীনকে। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে শিশুটিকে আজিমপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তার আগে বাচ্চাটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য ভিড় জমান বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষ। সিলেট থেকে আসা এক দম্পতি জানান, তারা কেবল শিশুটিকে নেওয়ার জন্যই এখানে এসেছেন। টাঙ্গাইল, গাজীপুর থেকেও এসেছেন অনেকে। আর ঢাকা থেকে জড়ো হয়েছেন অসংখ্য মানুষ।

জানা যায়, শিশুটির সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই তার দেখাশোনা করছেন শিশু হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার রাসেল মাহমুদ ও তার স্ত্রী পলি বেগম। ১০ বছর আগে এই দম্পতির বিয়ে হলেও তারা নিঃসন্তান। তারাও এই শিশুটিকে দত্তক নিতে চান। তবে নিয়ম অনুযায়ী সরাসরি এভাবে হাসপাতাল থেকে কোনো শিশুকে হস্তান্তরের নিয়ম নেই বলে গহীনকে শিশুমনি নিবাসে পাঠানো হয়েছে।

রাসেল মাহমুদ বলেন, ‘বাচ্চাটিকে উদ্ধারের পর থেকেই আমার স্ত্রী এই বাচ্চার দেখাশোনা করছে। তিনদিন ধরে তার নাওয়া-খাওয়া-ঘুম কিছুই নেই। সে তিনদিন ধরে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বসে আছে, বাসায় পর্যন্ত যাচ্ছে না।’ আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, ‘তিন বছর আগেও তিনি নিজ হাতে কুড়িয়ে পাওয়ার পর হাসপাতালে আনা অনেক শিশুকে দত্তক নিতে আগ্রহী দম্পতির হাতে তুলে দিয়েছেন। অথচ আজ আইনের কাছে তিনি বাধা পরে যাচ্ছি। তিন বছর আগেও কি এই আইন ছিল না?’

নিয়ম আর আইন মেনে কোর্টে আবেদন করলে আপনারাও গহীনকে পেতে পারেন মন্তব্য করলে রাসেল মাহমুদ বলেন, ‘কোর্ট নাকি বাবা-মায়ের আার্থিক সচ্ছ্বলতা, লেখাপড়াসহ অনেক কিছু দেখেন। একজন সচিব আর আমি তো কোনও দিক দিয়েই এক কাতারে পরবো না। তাহলে সেখানেই তো আমি হেরে যাবো।’ আমি কেমন করে এই মেয়েকে পাবো বলে চোখ মুছতে থাকেন তিনি।

পলি বেগমের স্বামী রাসেল মাহমুদ যতই তাকে বোঝাতে যান, ততই শক্ত করে বুকের সঙ্গে শিশুটিকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে পলি বেগম বলেন, ‘আমি এই মেয়েকে কাউকে দেব না। যারা ফেলে গেছে, সিসিটিভিতে তো তাদের দেখা গেছে। শুধুমাত্র যদি আসল মাকে পাওয়া যায়, তাহলে তার কাছেই আমি ওকে দেব। নয়তো আর কারো কাছে না।’

এসময় সরকারি নিয়মের কথা জানালে পলি বেগম বলেন, ‘সব নিয়মের মধ্যে থেকেই বাচ্চাটা আমার কাছে থাকুক। আমি কোনো আইন ভঙ্গ করবো না। হাসপাতালে থাকতে না দিলে প্রতিদিন এখানে এসে আসামির মতো হাজিরা দেব, কিন্তু গহীনকে আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিও না।’

চোখের পানি মুছতে মুছতে পলি বেগম আরও বলেন, ‘আমার টাকা নাই, ক্ষমতা নাই। কী দিয়ে আমি গহীনকে ধরে রাখবো? আমরা শুনতে পেয়েছি, অনেক বড় বড় জায়গা থেকে ফোন এসেছে গহীনকে নেওয়ার জন্য। যাদের অনেক ক্ষমতা, অনেক টাকা। তাদের কাছ থেকে কেমন করে আমি এই বাচ্চাকে পাবো?’

রাসেল মাহমুদ আর পলি বেগমের এই আবেগ ছুঁয়ে গেছে হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। তারা বলছেন, ‘কঠিন এই মানুষটা (রাসেল মাহমুদ) নরম হইয়া গেছে। চোখ মুছতাছে বাচ্চাটারে নিয়ে যাওয়ার কথা শুইনা।’ শিশু হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ডা. ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘শিশুটির সন্ধান পাওয়ার ঘটনায় আমরা জিডি করেছি। শিশুটিকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাকে আমাদের কাছে রাখার উপায় নেই। তাই তাকে সমাজসেবা অধিদফতরের শিশুনিবাসে পাঠানো হয়েছে।’

রাসেল মাহমুদ ও পলি বেগম দম্পতির বিষয়ে পরিচালক বলেন, ‘বিষয়টি মানবিক। শিশুটিকে তিন দিন ধরে তারাই দেখাশোনা করছেন। কিন্তু আমরা তো আইনের কাছে বাধা। এখন তারা নিয়ম অনুযায়ী পারিবারিক আদালতে আবেদন করবেন। আদালত তাদের উপযুক্ত মনে করলে তারা শিশুটির দায়িত্ব পেতে পারেন।’ এর আগে, শিশু হাসপাতালের বাথরুম থেকে উদ্ধার হওয়া শিশু ‘গহীন’কে আজিমপুরে অবস্থিত সমাজসেবা অধিদফতরের ছোটমনি নিবাসে স্থানান্তর করা হয়।

শেয়ার করুন: