ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবি : ছেলেও গেল, বাড়িও গেল

‘আমি এখন কী করব? আমি চাইনি ছেলেকে পাঠাতে। আগেই শুনছি এভাবে নৌকা ডুবে যায়, কিন্তু আমার ছেলেকে ফুসলাইছে নাসির। কথা দিয়েছিল জাহাজে করে নিবে তাই আমি রাজি হই। আমার ছেলে বেঁচে আছে কি না জানি না, আমার স্বামীও অসুস্থ। তিন সন্তান নিয়ে বাড়ি ছেড়ে এখন রাস্তায়। না খাইয়া পানি খাইয়া থাকতেছি। বাড়ি বন্ধক দিয়ে ছেলেকে পাঠাইছি, ভাবছিলাম ইতালি গিয়ে টাকা দেবে আবার বাড়ি ফিরাতে পারব। এখন সব শেষ আমার।’

এভাবেই আহাজারি করে বিলাপ করছিলেন ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া ফাহাদের মা। নৌকাডুবির খবর শোনার পর থেকেই বারবার অজ্ঞান হচ্ছেন তিনি। ছেলের কথা বলছেন আর কান্নাকাটি করছেন। ছেলে ফাহাদ আহমদ (১৮) নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হয়েছেন ভূমধ্যসাগরে। ছেলের স্বপ্নের কথা বলে মা আয়েশা আক্তারের বিলাপ আর থামছে না।

ফাহাদের বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গাজিটেকা পূর্বের চক এলাকায়। ফাহাদ আহমদের বাবা আব্দুল আহাদ দুবাই প্রবাসী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে ফাহাদ ছিলেন সবার বড়। কলেজে পড়তেন, প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

এই অবস্থায় দালালের চক্করে পড়েন তিনি। তার পরিবার জানায়, বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের বোয়ালি এলাকার নাসির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি ইতালির পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তারা চাচ্ছিলেন না সাগর পাড়ি দিয়ে তাদের ছেলে ইতালি যাবে।

কিন্তু নাসির উদ্দিন কীভাবে ফাহাদকে পটিয়ে ফেলে। নাসির বলেছিলেন, কোনো সমস্যা হবে না। ওকে জাহাজে পাঠানো হবে। এতে ভয়ের কিছু নেই। ফাহাদ অনেকটা জোর করেই মাকে বাধ্য করে। তখন আট লাখ টাকায় চুক্তি হয়। মায়ের কাছে নগদ দুই লাখ টাকা ছিল। বাকিটা অনেকের কাছ থেকে ধারদেনা করে জোগার করেন।

ফাহাদের মামা সাব্বির আহমদ বলেন, ‘আমার ভাগনে খুব সরল সোজা। তারে খুব বেশি উসকানি দিত নাসির। ১০ দিনের মধ্যে ইতালি পৌঁছে দেবে। এমনটা বলেছে। প্রথমে আট লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। পরে কয়েকবার বন্দুক ধরে ভিডিও কল করে বলে, টাকা পাঠাও।

ধারদেনা আর বাড়ি বন্ধক দিয়ে ১৮ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। আমরা বিভিন্ন টেলিভিশনে নিউজ দেখছি। কিন্তু এখনও নিশ্চিত হতে পারছি না। এখন ছেলেও গেল। বাড়িও গেল।’

লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়া উপকূলে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীবাহী নৌকাডুবিতে যে কজন মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ফাহাদ আহমদও একজন। গত সোমবার (১৪ মে) রেড ক্রিসেন্ট প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মৌলভীবাজারের যে দুজনের নাম দিয়েছে। তাদের একজন শামীম ও অপরজন ফাহাদ। এরপরই পরিবারের সদস্যরা জেনেছেন ফাহাদ নৌকাডুবিতে মারা গেছেন। তবে মারা গেছেন কি না পরিবার এখনও নিশ্চিত করতে পারেননি।

ফাহাদের মা আয়েশা আক্তার চিৎকার করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলছিলেন, কোনো কথাই গুছিয়ে বলতে পারছিলেন না। বললেন, ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে গত ৮ মে রাত ৮টায়।

ছেলে বলেছে, ‘মাগো আমি চলে যাচ্ছি, আমাকে যে টাকা দিছো সেই টাকা আমি খাইনি দালাল নিয়ে গেছে। কোনো কিছু খাইতে দেয়নি। অনেক নির্যাতন করছে আমাকে। রাত একটায় তার মামারে লিখছে মামা আমি বোটে। আর কোনো যোগাযোগ নেই।

২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর ফাহাদ ইতালির উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। দুবাই, তুর্কি হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান। লিবিয়াতে পৌঁছার পর তিন মাস পরে একবার সাগরপথে ইতালির উদ্দেশে পাঠানো হয়েছিল। সেবার ধরা পড়ে যায়।

এরপর লিবিয়াতেই ছিলেন এতদিন। ধরা খাওয়ার পর তাকে দেশে ফেরত আনার জন্য নাসির উদ্দিনকে চাপ দেয়া হয়। নাসির উদ্দিন তাকে ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেন।

এরপর কিছুদিন পরপরই ভিডিও কলে ফাহাদের দিকে বন্দুক ধরে আত্মীয়-স্বজনের কাছে টাকা চাওয়া হয়। সন্তানের মায়ায় মা আয়েশা আক্তার প্রতিবেশীর কাছে বাড়ি বন্ধক দেন। একে একে ১৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।

টাকা নেয়ার পরও এতদিন ছেলের ওপর নির্যাতন চলেছে। খাবারের টাকা দিয়েছি। কিন্তু ওরা খাবার দেয়নি। অল্প খাবার দিত। গোসলের জন্য পানি দিত না। দুই তিনদিন পরপর পানি দিত। গোসলের জন্য তা পর্যাপ্ত ছিল না।

এ ঘটনার সঙ্গে বারবার নাসির উদ্দিনের নাম চলে আসায় তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম আল ইমরান বলেন, ‘ফাহাদ নামে একজনের মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। আমরা পরিবারের খোঁজ নিয়েছি। তার বাড়িতে যাব।’

শেয়ার করুন: