দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সদ্যই ঘোষণা করা হয়েছে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ৬১ জন সহসভাপতি, ১১ জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ১১ জন সাংগঠনিক সম্পাদকসহ কমিটিতে স্থান পেয়েছেন ৩০১ জন। তবে ঘোষণার পরপরই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের একাংশ বিক্ষোভ করেছেন এই কমিটির বিরোধিতা করে। তারা বলছেন, কমিটিতে স্থান পাওয়া অনেকেই যোগ্যতা অনুযায়ী পদ পাননি। আর পদবঞ্চিত হওয়ার অভিযোগও করেছেন অনেকেই। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই কমিটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সদস্য, অর্থাৎ প্রায় একশ জনই পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন।
সোমবার (১৩ মে) বিকেলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানির সই করা পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রকাশিত হয়। এর পরপরই বিক্ষোভে নামেন ছাত্রলীগের একাংশ। সেখানেই নতুন কমিটিতে স্থান পাওয়া একাধিক ছাত্রলীগ নেতা জানান, তারা এই কমিটি থেকে পদত্যাগ করবেন। কেউ কেউ এরই মধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে পোস্টও দিয়েছেন।
সোমবার সংবাদ সম্মেলন করেই তারা পদত্যাগের ঘোষণা দিতে চেয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন। তবে মধুর ক্যান্টিনে মারধরের শিকার হওয়ায় তারা আগামীকাল মঙ্গলবার (১৪ মে) সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেবেন বলে জানিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের গত কমিটির সভাপতি বি এম লিপি আক্তার বলেন, কাউকে অভিনন্দন জানানোর অধিকার যেমন আমার আছে, ঠিক একইভাবে অযোগ্য কাউকে কমিটিতে স্থান দিলে সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অধিকারও আছে। অথচ সেই অধিকার আদায় করতে গিয়েই আমাদের ওপরে হামলা করা হলো।
লিপি বলেন, ঘোষিত কমিটিতে অযোগ্যদের স্থান করে দেওয়াতে এই কমিটির প্রায় একশ নেতা প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। অনেকের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে। তাদের মধ্যে আজকেই ৪০ জন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। নিজের অবস্থান জানিয়ে লিপি বলেন, আমি পদত্যাগ করার ঘোষণা এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের অভিভাবক। আমি তার কাছে আকুল আবেদন জানাই, যেন তদন্ত করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়।
আমরা এই কমিটি মানি না। আমি রোকেয়া হলের প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। এরপর আমি রোকেয়া হলের সভাপতির দায়িত্বও পালন করি। আমি ডাকসুর কমনরুম ও ক্যাফেটারিয়া বিষয়ক সম্পাদক। অথচ আমাকে দেওয়া হয়েছে উপসম্পাদকের পদ। এটা একটা বড় প্রশ্ন আমার কাছে। শুধু আমিই না, আমাদের সঙ্গে যারা আজ হাকিম চত্বর ও মধুর ক্যান্টিনের প্রতিবাদে ছিলেন, তাদের অবস্থাও আমার মতো। তাদেরও আমার পদের মতো পদ দিয়ে নিগৃহীত করা হয়েছে। কাউকে কাউকে তো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কমিটিতে জায়গাই দেওয়া হয়নি।
সুফিয়া কামাল হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তিলোত্তমা শিকদার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত। অথচ আমাদের বঞ্চিত করে যারা আগে কোনো কমিটিতে ছিল না, তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়েছে।
এর প্রতিবাদে আমরা মিছিল করেছি। মিছিলের সময়ই আমার ও লিপির ওপর হামলা করা হয়। এরপর আমরা সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করি। সেই সংবাদ সম্মেলনে আমাদের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়। আমি পদত্যাগ করতে চাচ্ছি। শুধু আমি না, অযোগ্যদের এভাবে কমিটিতে ঠাঁই দেওয়ার প্রতিবাদে আমাদের অনেকেই পদত্যাগ করতে চাচ্ছে।
বর্তমান কমিটিতে উপসম্পাদকের পদ পেয়েছেন বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হলের সভাপতি ফরিদা পারভীনও। তিনি বলেন, আমরা আজ অযোগ্যদের কমিটিতে স্থান দেওয়ার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ওপর হামলা করে সেটা বানচাল করা হয়েছে। আমরা আগামীকাল (মঙ্গলবার) আবার সংবাদ সম্মেলন ডাকব। সেখানে আমরা পদত্যাগ করার ঘোষণা দেবো।
এদিকে, ছাত্রলীগের এই কমিটিতে পদ দিতে টাকার লেনদেনের অভিযোগও করছেন বিক্ষোভকারীরা। লিপি বলেন, আমাদের কাছে এমন মেসেজও রয়েছে যে কক্সবাজারের একজনকে সহসম্পাদক দেওয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে।
এছাড়াও বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত অনেককেই এই কমিটিতে স্থান করে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের আদর্শিক ও সাংগঠনিক অবস্থার সঙ্গে যায় না— এমন অনেক ব্যক্তিকেও কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে।
লিপি আরও বলেন, আমরা যখন হাকিম চত্বর থেকে মধুর ক্যান্টিনে যাই, তখন সাদিক খান, রাকিব, ফাহিম, আল ইমরান, জহুরুল হক হলের সোহানরা সেখানে ছিল। বিভিন্ন হলের পদপ্রত্যাশী অনেকেই আমাদের ওপর হামলায় জড়িত ছিল। তারা ‘ভাই’দের তুষ্ট করতে এই হামলা চালায়। তারা আমাদের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে এবং চেয়ার উঠিয়ে আমাদের মারধর করে। ন্যায্য অধিকারে দাবি চাইতে গিয়ে আজ আমাদের ওপর হামলা করা হলো।
দক্ষ ও যোগ্য কমিটির দাবি জানিয়ে লিপি বলেন, নির্দিষ্ট কারও বিপক্ষে আমাদের কোনো অবস্থান নেই। আমরা চাই একটা দক্ষ ও যোগ্য কমিটি। যতক্ষণ সেটা না হবে, ততক্ষণ আমরা আন্দোলন চালাতে থাকব।
মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নেবো। আমরা আগামীকাল (মঙ্গলবার) গণভবনে যাব আপার (প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল, আমাদের ভরসা। তিনি নিশ্চয় আমাদের দাবি শুনবেন।
নতুন কমিটির সহসভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ সংগঠন। এখানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সবাই রাজনীতি করেন। রাজনীতি করলে অনেকেই পদ-পদবী নিয়ে ভাবেন, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো— সবাইকে তো আর পদ দিয়ে খুশি রাখা যাবে না। অনেকেই নিজের পছন্দের পদ পাবেন না, এটাও স্বাভাবিক।
আর সেক্ষেত্রে যারা প্রতিবাদ করছেন, তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাই— আশা করি তারা খুব দ্রুতই বুঝবেন যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভরসার স্থান হলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার অনুমোদিত কমিটি আজ (সোমবার) ঘোষণা করা হয়েছে। আশা করি, সবাই তার প্রতি সম্মান রেখেই দ্রুত নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন। যদি কমিটিতে কোনো ভুল হয়ে থাকে, তবে সেটা নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করবেন।’
বিক্ষোভকারীদের মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে নাহিয়ান বলেন, ‘যেহেতু আমি সেখানে ছিলাম না, তাই এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাইছি না।’ এদিকে, পূর্ণাঙ্গ কমিটির বিরোধিতাকারীরা সন্ধ্যায় বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে মধুর ক্যান্টিন এলাকায় গেলে মারধরের শিকার হন। আহত অবস্থায় তাদের কমপক্ষে সাত জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
তাদের মধ্যে শ্রাবণী দিশা চোখে আঘাত পেয়েছেন, মাথার পেছনে আঘাত পেয়েছেন তানজির শাকিল। এছাড়া লিপি আক্তার, ফরিদা পারভীন, তিলোত্তমা শিকদার, জেরিন জিয়া ও শ্রাবণী শায়লা শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পেয়েছেন বলে জানান ঢামেক জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক।