মসজিদে বাচ্চাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

রাজধানী ঢাকার উত্তরা ১০ নং সেক্টরের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে লাল-সাদা ব্যানারে লিখে রাখা হয়েছে মসজিদে শিশু/বাচ্চাদের প্রবেশ নিষেধ। মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে লাগিয়ে রাখা এ নোঠিশটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে।

বেশিরভাগ লোকজনই এ সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিবাদ করছেন এবং এমন সিদ্ধান্ত প্রকাশের পূর্বে “মসজিদে বাচ্চাদের প্রবেশ বা বাচ্চাদের নিয়ে মসজিদে যাওয়ার ব্যাপারে ইসলামের বিধান” সম্পর্কে জেনে নেওয়া উচিত ছিলো বলে সবাই মতামত দিচ্ছেন। মসজিদে বাচ্চাদের উপস্থিতি ও তাদের সাথে নিয়ে নামাজ আদায় করার ব্যাপারে শরিয়তের হুকুম

সাধারণত নামাজের সময় কথা বলে বা কাতারের মাঝখানে বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করে এ ধরণের কিছু হালকা যুক্তি দেখিয়ে বিভিন্ন মসজিদে বাচ্চাদের প্রবেশের ব্যাপারে অনেকেই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকেন।

কিন্তু ইসলামে এ ব্যাপারে স্পষ্ট আলোচনা রয়েছে এবং বাচ্চাদের মসজিদে যাওয়ার ব্যাপারে বা বড়দের সাথে করে বাচ্চাদের মসজিদে নেওয়ার ব্যাপারে নবী স. এর জোর তাগিদ রয়েছে।

মহানবী সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের সন্তানদের বয়স যখন সাত বছরে পৌঁছে, তখন তাদের নামাজ শিক্ষা দাও, যখন বয়স দশে পৌঁছে, তখন বাধ্যতামূলক ভাবে নামাজ পড়াও। যদি না পড়ে তাহলে হালকাভাবে মার-ধর করে হলেও তাকে নামাজ পড়াও”।

বুখারী শরীফে এসেছে- রাসুল (সাঃ) তার নাতনী হযরত উমামা বিনতে যায়নাব (রাঃ) কে বহন করে (কোলে কিংবা কাঁধে) নামাজ আদায় করেছেন। যখন তিনি দন্ডায়মান হতেন তখন তাকে উঠিয়ে নিতেন আর সিজদাহ করার সময় নামিয়ে রাখতেন।

আবু দাউদ শরীফে এসেছে- সাহাবায়ে কেরাম রা. বলেন, আমরা একদা জোহর কিংবা আসর নামাজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বেলাল (রাঃ) রাসুল (সাঃ) কে নামাজের জন্য ডাকলেন। রাসুল (সাঃ) তাঁর নাতনী হযরত উমামাহ (রাঃ) কে কাঁধে করে নিয়ে আমাদের কাছে আসলেন।

রাসুল (সাঃ) ইমামতির জন্য নামাজের স্থানে দাড়ালেন আমরা তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে গেলাম অথচ, সে (উমামাহ রা.) তার স্থানে তথা রাসুল (সাঃ) এর কাঁধেই আছে। রাসুল (সাঃ) নামাজের তাকবির দিলেন আমরাও তাকবীর দিলাম।

রাসুল (সাঃ) রুকু করার সময় তাকে পাশে নামিয়ে রেখে রুকু ও সিজদাহ করলেন। সিজদাহ শেষে আবার দাঁড়ানোর সময় তাকে আগের স্থানে উঠিয়ে নিতেন। এভাবে নামাজের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাকাতেই তিনি এমনটি করে যেতেন।

এ ছাড়াও রাসুল (সাঃ) এর খুতবা দেয়ার সময় তাঁর নাতি হাসান ও হুসাইন (রাঃ) আসলে তিনি খুতবা দেয়া বন্ধ রেখে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেন, কোলে তুলে নিতেন চুম্বন করতেন আর বলতেন খুতবা শেষ করা পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। তাই, আমি খুতবা দেয়া বন্ধ করেই এদের কাছে চলে এসেছি। (নাসায়ী শরীফ)

এ বিষয়ে সৌদী আরবের সর্বোচ্চ ফতোয়া বোর্ডে প্রশ্ন করা হলে আল্লামা শাইখ ইবনে উসাইমিন (রহ) বলেনঃ “শিশুরাও বশর_হাযর নয়” অর্থাৎ শিশুরাও মানুষ তারা পাথর নয় তারা বড়দের সাথে দাড়ালে কোন প্রকার মাকরুহ হবে না বরং মসজিদে পরে এসে তাদের কে সামনের কাতার থেকে হঠিয়ে ঐ জায়গা দখল করাটাই বরং ভূল হবে।

মসজিদে শিশুদের আনা প্রসঙ্গে তুর্কীরা বলেন, শিশুরা হলো ফেরেস্তার মতো। এরা এখানে আসবে। একটু দুষ্টুমি করবে। এভাবেই দেখতে দেখতে সালাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। দুষ্টুমির ব্যাপারটা বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। তাই সেটা কোনও ব্যাপারই না। কিন্তু এখন যদি ওদের মসজিদে বকাঝকা ও মারধর করা হয় তাহলে তারা তো আর এখানে আসতেই চাইবে না।

শিশুরা একটা ভয় নিয়ে বেড়ে উঠবে। এমন করা আদৌ ঠিক নয়। মানবিক চেতনা এবং চমৎকার যুক্তি। আর এর ঠিক বিপরীত চিত্র চোখে পড়ে আমাদের দেশে। এখানে এমনও দেখা যায় যে, শিশুকে মসজিদে নিয়ে আসবার কারণে দাদা-নানা অথবা মামা-চাচার সঙ্গে একশ্রেণির মুসল্লির দুঃখজনক মারামারিও ঘটে যায়।

এছাড়াও তুরস্কে শিশুরা মসজিদে গেলে তাদের চকলেট দেয়া হয়। তাইতো ওসব দেশে শিশুরা আনন্দের সাথে মসজিদে ছুটে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে হয় তার উল্টো। মসজিদে এলে তাদেরকে মারধর ধমকের শিকার হতে হয়। এমন ধমকের শিকার হলে হয়তো শিশুরা ভাবতে পারে মসজিদে গিয়ে ধমক খাওয়ার চাইতে বাসায় বসে কম্পিউটারে গেইমস খেলাই ভালো।

হাদীসে যেখানে ছোটদেরকে নামায পড়ানোর জন্য কড়াকড়ি আরোপ করতে বলা হয়েছে সেখানে আমরা যারা নামায পড়তে যাচ্ছে তাদের উপর কড়াকড়ি আরোপ করছি! হ্যাঁ সাত বছরের নিচের বা একদম ছোট অবুঝ শিশুদের মসজিদে নিয়ে আসার ব্যাপারে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করা যায় তবে সেটাও তাদেরকে মসজিদে আনার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে নয়।

তাছাড়া বাচ্চাদেরকে যদি আমরা বড়দের মাঝে মাঝে কাতাতে দাঁড় করাই, তাহলে তারা হাঁসাহাসি করা থেকে অনেকটা বিরত থাকবে, অবিভাবকও অনেকটা নিশ্চিত থাকতে পারবেন এবং বাচ্চারাও খুশি হবে। তাদের মসজিদে যাবার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।

কখনো কখনো এটাও দেখা যায় যে বাচ্চারা ইমামের সাথে নামাযে দাঁড়িয়েছে। নামায দুই-এক রাকায়াত হয়েও গেছে। এমন সময় সিনিয়র কেউ এসে নামাযরত অবস্থায়ই তাকে পাশে সরিয়ে সে সেখানে দাঁড়ায়।

এতে বাচ্চার মনে ব্যপক আঘাত লাগার এবং মসজিদে আসার প্রতি অনীহা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। এ লোকের প্রতি হয়তো তার মনে ব্যপক ক্ষোভও সৃষ্টি হয়। বাচ্চাদের হয়তো নামাযের মাঝে মাঝে দাঁড় করালে সে কখনো কখনো একটু আধটু খেলা করবে, একটু আধটু মজার কথা বলবে। সে যা করে করুক। তাকে স্নেহ করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।

রাসুল (সাঃ)বলেছেন: যে আমাদের ছোটদেরকে স্নেহ করে না এবং বড়দেরকে সম্মান করতে জানে না সে আমার দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ, তিরমীজি, মুসনাদে আহমদ, ইবনে আবি শায়বাহ।

তাই আসুন, বাচ্চাদের স্নেহ করি এবং তাদেরকে মসজিদে যাবার ব্যপারে উৎসাহিত করে একজন দ্বীনদার মুত্তাকী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলি। এ ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক হওয়া জরুরি। জুমার খুতবায় বিষয়টি স্পষ্ট করা খুব দরকার।

তাহলে মুরুব্বিদের প্রতি বিরূপ মানসিকতা থেকে যেমন সরে আসবে শিশুরা। তেমনই মসজিদমুখী হতে আগ্রহী হবে। উত্তরার এ মসজিদের মতো এ ধরণের উদ্ভট নোঠিশ যেন আমরা না টানিয়ে বসি।

শেয়ার করুন: