মসজিদটি সত্যই কী জ্বীনের?

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে ১৫ কি.মি. উত্তর পূর্ব দিকে বালিয়া ইউনিয়নে এক অনিন্দ্য সুন্দর ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহি বালিয়া জামে মসজিদ অবস্থিত। শত বছরের অধীক এই পুরাতন মসজিদকে ঘিরে মানুষের মাঝে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়দের মতে, ঠাকুরগাঁওয়ের ছোট বালিয়ার এই মসজিদটি জ্বীনে তৈরি করেছেন বলে অনেক মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। আসলে কি এই মসজিদটি জ্বীনের তৈরি করা বা জ্বীনের মসজিদ?

চলুন জানা যাক এর আসল রহস্য, জাহিদ হাসান মিলু’র প্রতিবেদনে ছোট বালিয়া মসজিদের ইতিকথা-শতবছর ধরে এই মসজিদটি লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলো।১৮ শতকের শেষের দিকে বালিয়ার জমিদার মেহের বক্স সরকার এই মসজিদটি স্থাপন করেন। তার সম্পর্কে অনেক গল্প এখনো বালিয়া এলাকার মানুষের মুখে প্রচলিত আছে। মেহের বক্স সরকারের স্ত্রী গুলমতি নেছা ব্রিটিশদের কাছে সুষ্ঠভাবে নিজের জমিদারী কর/ট্যাক্স পৌছানোর স্বীকৃতি স্বরুপ চৌধুরানী উপাধী লাভ করেন। সে সূত্রে চৌধুরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন মেহের বক্স সরকার ।

তিনি ১৮ শতকের শেষভাগে বালিয়াতে এক মসজিদ তৈরীর পরিকল্পনা করেন। সেলক্ষ্যে দিল্লি থেকে মিস্ত্রি আনা হয়। এই মসজিদ তৈরি ছিল অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ইট তৈরী, চুন সুড়কির কাজ সব মিলিয়ে এক কঠিন কর্মযজ্ঞ। সেসময় এতো ইটের ভাটাও ছিলো না। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইট তৈরীর ব্যবস্থা করা হয়, সেটাও ছিলো জটিল প্রক্রিয়া।

তবু পুরোদমে কাজ চলছিল মসজিদটির। মসজিদের ছাদ পর্যন্ত নির্মাণ হয়,কিন্তু গম্বুজ নির্মিত হয়নি। এই সময় হঠাৎ করে প্রধান কারিগরের মৃত্যু হয় এবং মসজিদ নির্মাণের কাজ থেমে যায়,পরবর্তীকালে মেহের বক্স সরকার চৌধুরী স্থানীয় মিস্ত্রিদের দ্বারা কাজ শুরু করালেও তারা গম্বুজ নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়। পরে তিনি ১৯০৫ সালে ইন্তেকাল করেন।

তার মৃত্যুর পরেও তার পরিবারের সদস্যরা চেষ্টা করেছিলেন মসজিদ নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করার। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়ে যান। অবশেষে মসজিদের নির্মাণ কাজ শত বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এবং স্থাপনা এলাকায় জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে ও বাঘ, বানর, সাপ ও পোকামাকড়ের বাসস্থানে পরিণত হয় ।

এরপর ৮০ দশকের দিকে, তখন মেহের বক্স সরকার চৌধুরীর সুযোগ্য পৌত্র (নাতি) জননেতা রেজওয়ানুল হক ইদু চৌধুরী তখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এবং ঠাকুরগাঁও -০১ আসনের সংসদ সদস্য, তিনি ঢাকা থেকে একজন প্রকৌশলীকে এনে এই মসজিদ সংস্কার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন কিন্তু সেই প্রকৌশলী বলেন,এই মসজিদ কোনভাবেই আর সংস্কার করা সম্ভব না। পরে ইদু চৌধুরী নিজস্ব উদ্যোগে সোনাপাতিলা মসজিদ নির্মাণ করেন।

এরপর ২১ শতকে ছোট বালিয়া এলাকায় মসজিদের প্রয়োজন দেখা দিলে নতুন মসজিদ নির্মাণ এর পরিকল্পনা করা হয়। এ নিয়ে বহু তর্কবিতর্ক’র পর অবশেষে সেই পরিত্যক্ত মসজিদ সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নেন। এই মসজিদটি সংস্কারের উদ্যোগ যারা নিয়েছিল তাদের অন্যতম হল বালিয়া চৌধুরী পরিবারের সন্তানেরা, শিল্পী কামরুজ্জামান স্বাধীন, শাহীদ জাকিরুল হক চৌধুরী, মরহুম আলহাজ সাইফুল আলম নুরুজ্জামান চৌধুরী, আনসারুল হক চৌধুরী এবং মসজিদ সংলগ্ন বাড়ির কয়েক জন।

মসজিদ সংস্কারে প্রথম তিনজন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, এরমধ্যে তৃতীয় জন সংস্কারের শুরু থেকে উনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মসজিদের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।তিনি মৃত্যুসজ্জায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও মসজিদের খবর নিতেন। উনার চিন্তা ভাবনাই ছিল মসজিদ কেন্দ্রিক।

মসজিদ সংস্কারের যত ফান্ড সবই তার নিজ উদ্যোগে কামরুজ্জামান স্বাধীন ও শাহীদ জাকিরুল হক এই দুজনকে সঙ্গে নিয়ে যোগাড় করেছেন। তিনার অনুরোধেই বালিয়া চৌধুরী পরিবারের সন্তান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর শিক্ষক আর্কিটেক্ট সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল গম্বুজ এর ডিজাইন সংস্কারের পর মসজিদটি দেখতে কেমন হবে সেই ডিজাইন এবং অজুখানার ডিজাইন (যা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি) তৈরি করেন।

এই বৃহত্তম কাজের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এর ভূমিকা পালন করেন মেহের বক্স সরকার পৌত্র (নাতি) চৌধুরীর সুযোগ্য প্রোপৌত্রি নর্দান তসরিফা গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সেইসাথে সফিউদ্দিন আহমেদ ফাউন্ডেশন ও চক্ষু হাসপাতাল এর চেয়ারম্যান তসরিফা খাতুন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একদল শিক্ষার্থী সেই মসজিদ পরিদর্শন করে সংস্কার করার ইতিবাচক মনোভাব দেখায়। সেই শিক্ষার্থীরা নিজেরাই এবং কিছু শ্রমিকসহ মসজিদের জঙ্গল/আগাছা পরিস্কার করেন। এরপর শুরু হয়ে যায় ঐতিহ্যকে অবিকৃত রেখে পুননির্মাণ কাজ। আধুনিক ও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতিতে এই মসজিদের সংস্কার করেছে প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউট। যদিও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই কাজ তদারকিতে প্রথমে তেমন সদিচ্ছা দেখায় নি।

অবশেষে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকদের এই মসজিদ পুননির্মাণ এর কাজে তদারকির জন্য আনা হয়।পরে সংরক্ষণের প্রয়োজনে দেয়ালের কিছু অংশ খুলে ফেলা হয়। সেখানে দেখা যায়, বর্তমান দেয়ালের ১১ ইঞ্চি ভেতরে একই নকশার একটি দেয়াল। এই ভেতরের দেয়ালটির ইট ও মর্টারের সঙ্গে পরে নির্মিত ইট ও মর্টারের পার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে মসজিদটির সম্ভাব্য বয়স নির্ধারণ করা হয় ১২০ বছরের অধিক।উল্লেখ্য, ব্যয়বহুল বলে বয়স নির্ধারণে কার্বন-১৪ বা থার্মালুমেনিসেন্স ধরনের কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হয়নি।

৩ গম্বুজ ও ৪ মিনার বিশিষ্ট মসজিদটির আয়তন, পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি। আয়তাকার এই কমপ্লেক্সটিকে ‘সিঁড়িসহ প্রবেশপথ’, ‘খোলা চত্বর’ ও ‘মূল ভবন বা নামাজঘর’এই তিনটি অংশে বিভক্ত করা যায়।

মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত।প্রবেশপথ খোলা চত্বর ও মূল ভবন একই প্লাটফর্মের উপর অবস্থিত। স্থানভেদে সাড়ে ৩ ফুট থেকে সাড়ে ৪ ফুট গভীর ভিত্তির ওপর ৫ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফর্মের উপর মসজিদটি স্থাপিত। প্লাটফর্ম থেকে ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট। ভিত্তিসহ পুরো মসজিদটিই চুন-সুরকির মর্টার এবং হাতে পোড়ানো ইট দিয়ে নির্মিত হয় এই বালিয়া মসজিদটি।

প্রচলিত রূপকথা অনুসারে মানুষের মুখে শোনা যায়, এটি জ্বীন নির্মিত মসজিদ।এ সম্পর্কে মসজিদটির মুয়াজ্জিন জাহাঙ্গীর বলেন, আসলে জ্বীন নির্মিত কোনো কিছুর হদিস পৃথিবীতে নেই এটি সম্পূর্ণই মানুষের অজ্ঞতা, কুসংস্কারমুলক কথা। এভাবে জ্বীন নির্মিত মসজিদ নামে মানুষের দক্ষতা কে অপমান করা হচ্ছে।এছাড়া চৌধুরী বংশের বাবু চৌধুরী ও তার চাচা জানান, পূর্ব চৌধুরী বংশের-মেহের বক্স চৌধুরী ১৩১৭ বঙ্গাব্দে মসজিদটির প্রতিষ্ঠা করেন।

মসজিদ নিমার্ণের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই ১৩১৭ সালেই মেহের বক্স চৌধুরীর মৃত্যু হলে মসজিদের কাজ স্থগিত হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন পর পুনরায় মেহের বক্স চৌধুুরীর বংশ ধরেরা মসজিদটির পূর্ণ নিমার্ণ করেন। এটি তাদের জন্মের অনেক পূর্বের নির্মিত। তার দাদার দাদার আমলে প্রায় একশ বছরের বেশি আগের তৈরি নিদর্শন। তারা আরও বলেন যে, এটি তাদের চৌধুরী বংশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত করা হয়।

এবিষয়ে চৌধুরী পরিবারের, নাট্য অভিনেতা ও ঠাকুরগাঁও জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রাজি স্বপন চৌধুরী বলেন, এই বালিয়া মসজিদটিকে অনেকেই সংবাদ পত্রে জ্বীনের মসজিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আসলে এটা জ্বীনের মসজিদ নয়।

আমাদের পরিবারের, হাজী মেহের বক্স চৌধুরী তিনি মসজিদের কাজ শুরু করেছিলেন ১৮৮৫ সালের দিকে এবং ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তিনি এটার কাজ চলমান রেখেছিলেন। এরিমধ্যে হাজী মেহের বক্স চৌধুরী ও মসজিদ নির্মাণের প্রধান কারিগরের মৃত্যু হয়। ফলে তখন তার পরিবারের সন্তানেরা মসজিদের কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারেন নি। যার ফলে অর্ধনির্মিতভাবেই অনেকদিন মসজিদটি পরে ছিলো।

তিনি আরও বলেন, পরে আমাদের পরিবারের চাচা, দাদারা ২০০৫ সালের দিকে মসজিদটিকে পূর্ণনির্মানের পরিকল্পনা করেন। বুয়েটের প্রকৌশলীদের এনে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরে ২০০৮ সালে এটির কাজ শুরু করে এবং ২০১০ সালের শেষের দিকে ভবনের কাজ শেষ হলেও অজুখানার কিছু কাজ এখনো অসম্পূর্ণ আছে।

এই মসজিদটি ঠাকুরগাঁওয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করে। মসজিদটিকে যারা জ্বীনের মসজিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেছে এটা আসলে ভুল তথ্য, সত্য হলো এটি হাজী মেহের বক্স চৌধুরী স্থাপিত করেছিল ও এটি মানুষের তৈরি একটি মসজিদ।

আরও উল্লেখ্য যে, শত বছরেরও অধিক পুরাতন ছোট বালিয়া ঐতিহাসিক জামে মসজিদের অসমাপ্ত কাজ পুনরায় শুভারম্ভ করেন-এ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা বালিয়া চৌধুরী পরিবারের প্রথম পুরুষ হাজী মেহের বক্স চৌধুরীর পৌত্র (নাতি) মরহুম বসরত আলী চৌধুরীর সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি আলহাজ্ব তসরিফা খাতুন ১৯ নভেম্বর ২০১০ সালে।

শেয়ার করুন: