কয়েকদিন আগেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ অনিশ্চিত ছিল। অনেকের ধারণা ছিল, গতবারের মতো এবারও বিএনপি হয়তো নির্বাচনে আসবে না, কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নাটকীয়ভাবে শেষমেশ নির্বাচনে এসেছে বিএনপি।
যদিও শেষপর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনের মাঠে থাকে কি থাকবে না এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে ব্যাপক সংশয়। কিন্তু একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকবে বিএনপি। এ বিষয়ে বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি যদি নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত থাকে, তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের মতো নাটকীয় একটি ফলাফল অর্জনে সমর্থ হবে তারা।
এবারের নির্বাচন অনেকটাই বিএনপির কাছে অস্তিত্ব রক্ষার মতো। নির্বাচনে তারা যদি জয়লাভ নাও করে, তবুও সম্মানজনক অবস্থানে থাকবে বিএনপি। যা তাদের জন্য ইতিবাচক ফলাফল আনবে বলে মনে করেন তারা। এদিকে, বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা বলছেন যে, এবারের নির্বাচন যদি নূন্যতম নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তাহলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল নিয়ে বিএনপি যে জোট দল গঠন করেছে, তা একটি নাটকীয় ফলাফল আনবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আজকের সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন যদি ২০ ভাগ নিরপেক্ষ হয় তবুও জয়লাভ করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এর পরপরই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ধানের শীষ প্রতীক নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তবে, বিএনপিকে জিততে হলে পাঁচটি বিষয় তাঁদের মানতেই হবে। এগুলো হলো:
১. গত ১০ বছরে একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে এমনকি বিরোধী দল হিসেবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করেনি বিএনপি। তাদের সকল দাবি-দাওয়াই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আরও নির্দিষ্ট করে বললে জিয়া পরিবার কেন্দ্রিক।
খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক জিয়ার মুক্তি, খালেদা জিয়ার মামলা, এগুলোই ছিল তাদের রাজনীতির ইস্যু। সাধারণ জনগণের কোনো ইস্যু নিয়ে মাঠে নামেনি তারা। কিন্তু, কতিপয় কিছু আওয়ামী নেতার কারণে আওয়ামী লীগের কিছু কিছু বিষয়ে ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এই নেতিবাচক ধারণার প্রভাবেই নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের সম্ভাবনা রয়েছে বলে একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। গত ২০০১ সালেও ব্যর্থ বিরোধী দল ছিল বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী বিরোধীদের ভোট বিএনপির বাক্সে পড়ায় ক্ষমতায় আসে বিএনপি।
এবার ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী, ক্ষমতায় থাকলে সবাইকে খুশি করা অসম্ভব। অনেকেই ক্ষমতাসীনদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন, আবার সুবিধাবঞ্চিত হয়ে দূরে সরে যান অনেকেই। এর ফলে আওয়ামী বিরোধী একটি মনস্তাত্ত্বিক দলের সৃষ্টি হয়েছে। এই দলসহ আওয়ামী বিরোধী ভোটগুলো যদি বিএনপি একাট্টা করতে পারে, তবে এ নির্বাচনে একটি অভাবনীয় ফলাফল অর্জন করতে পারে দলটি।
২. আওয়ামী লীগের মধ্যে এখনো গ্রুপিং, উপদলীয় কোন্দল, অভ্যন্তরীণ কোন্দল বিরাজমান। এছাড়াও প্রতিটা আসনে গড়ে আওয়ামী লীগের প্রায় ১৪ জন প্রার্থী মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। মাত্র ৭ টি আসনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ফরম তুলেছেন। যে সাতটি আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন একক প্রার্থী কিনেছেন সেগুলো হলো: গোপালগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা,
গোপালগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, বরিশাল-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য শেখ হাসনাত আবদুল্লাহ, বাগেরহাট-২ থেকে শেখ হেলাল উদ্দিন, খুলনা-২ আসন থেকে শেখ জুয়েল, মৌলভীবাজার-১ আসন থেকে শাহাবুদ্দিন ও নোয়াখালী-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এদিকে, বাকি আসনগুলোতে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকায়, যে নমিনেশন পাবে অন্যরা ঐ নমিনেশন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে কিনা এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারাই যথেষ্ট সংশয়ে রয়েছেন।
যদিও আওয়ামী সভাপতি শেখ হাসিনা গতকাল বুধবার মনোনয়ন প্রত্যাশীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্যে দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টিতেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যদি কেউ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে কিংবা যাকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে, তার বিরুদ্ধে কাজ করে, তবে দল থেকে আজীবন বহিষ্কারেরও ঘোষণা দেন তিনি। দলের সভাপতির এ বক্তব্যের পরও সবাই তাঁর নির্দেশ মেনে নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করবে কিনা এনিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকেরই মনে। সুতরাং, আওয়ামী লীগ যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে ব্যর্থ হয়, তবে অনেকগুলো আসনেই আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে, এক্ষেত্রে লাভবান হবে বিএনপি।
৩. বাংলাদেশের মানুষ অনেকটাই আবেগপ্রবণ। ৯০’এ স্বৈরাচারী এরশাদের যখন পতন হয়েছিল, তখন আটক করা হয়েছিল তাঁকে। যে রংপুরেই এরশাদ ছিলেন সবচেয়ে অজনপ্রিয় ব্যক্তি, ঐ রংপুরেই ৫ টি আসনে জয়ী হন তিনি।
পরাজিত ও দুর্বলের প্রতি অবস্থান গ্রহণ যেন বাঙ্গালীদের একটি চিরাচরিত স্বভাব। এদিকে, বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী আছেন। এটাকে পুঁজি করে বিএনপি তার নির্বাচনী কৌশলে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে কতটা অনুকম্পা-করুণা আদায় করতে পারে তা এখন দেখার বিষয়। সবমিলিয়ে এই ইস্যুকে দাঁড় করিয়ে জনগণের মধ্যে যদি তারা আবেগ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে এই নির্বাচনে বিএনপি একটি ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৪. আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও মতবিরোধ শুধু আওয়ামী লীগেই নয়, বিএনপির মধ্যেও বিরাজমান। বিএনপির একাধিক আসনেই মনোনয়ন প্রার্থীদের মধ্যে কোন্দল ও মতবিরোধ রয়েছে। ইতিপূর্বে বহিষ্কৃত অনেক নেতাকেই সাম্প্রতিক সময়ে আবার দলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। গত একমাসেই এমন ৬১ জনকে দলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এদের মধ্যে আবু হেনা, শহিদুল হক জামাল, গোলাম মো. সিরাজ, মফিকুল হাসান তৃপ্তি, জহির উদ্দিন স্বপন অন্যতম। এরা সবাই এখন নির্বাচনের প্রার্থী। এতে আপত্তি উঠেছে খোদ বিএনপির মধ্যেই।
ইতিমধ্যেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, যারা এতদিন বিএনপির বিরোধিতা করেছে, এমনকি বেগম জিয়াকে দল থেকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদেরকে যদি মনোনয়ন দেওয়া হয় তবে এতদিনের ত্যাগী কর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসবে। এই বহিষ্কৃত ও সংস্কারপন্থীদের দলে ফিরে আসার ফলে বিএনপিতে যে কোন্দলের সৃষ্টি হয়েছে, এই কোন্দল বিএনপি কীভাবে মিটমাট করতে পারবে, তার উপর দলটির সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করছে। যদি গত ১০ বছরের নির্যাতিত, ত্যাগী নেতা-কর্মীরা তা নীরবে সহ্য করে নেন তাহলে নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে ইতিবাচক ফলাফল আসবে বলা আশা করাই যায়।
৫. বিএনপি কয়েকটি নামসর্বস্ব দল ও ব্যক্তি নির্ভর দলের সঙ্গে ঐক্য করেছে। এই ঐক্যের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, খারাপ ইমেজ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। কেননা, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার খারাপ ইমেজ শুধু বাংলাদেশেই না বিশ্বব্যাপী রয়েছে।
এছাড়াও ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ নানারকম অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি, টানা তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। কাজেই বিএনপি তার অতীতের অপকীর্তি আড়াল করার জন্যই বর্ম হিসেবে ড. কামাল হোসেন, আ. স. ম. আবদুর রব, মাহমুদুর রাহমান মান্নাদেরকে দলে ভিড়িয়েছেন।
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে এরা বিএনপির জন্য কতোটা কাজ করবে এবং বিএনপির হয়ে তারা সাধারণ মানুষদের কাছে কতখানি পৌঁছতে পারেন, তার উপর বিএনপির সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করবে। এই ৫ ক্ষেত্রে যদি বিএনপি ইতিবাচক ফলাফল করতে পারে, ৯১’এর মতো এ নির্বাচনেও চমক দেখাতে পারে বিএনপি।