প্রেসিডেন্ট ফোনে বললেন, অফিসারদের কথা মেনে কাজ করো

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। ঘুমন্ত রাজধানী। মধ্যরাত পেরেয়ি গেছে। চাপা অন্ধকারে দ্রুত গতিতে চলতে জলপাই রঙের একটি পিকআপ ভ্যান। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে এসে থামে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তখন রাত আনুমানিক দেড়টা থেকে দুইটা। গাড়ি থেকে জেলগেটে নামেন কয়েকজন সেনা সদস্য ।

ঢাকা তখন এখন অস্থিরতার নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে তখন। ওই সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান।

রাত দেড়টার দিকে কারাগার থেকে টেলিফোন করে জেলার আমিনুর রহমানকে তাৎক্ষনিকভাবে জেল গেটে আসতে বলেন। কারণ জানতে চাইলে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ডিআইজি প্রিজন জানান, গুরুতর ঘটনা, আপনি জলদি আসেন।

দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে গিয়ে জেলার দেখলেন, একটি পিকআপের সামনে কয়েকজন সেনা সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় পায়চারি করছে।সেনা সদস্যরা ডিআইজি প্রিজনকে একটি কাগজ দিয়েছেন। এতে লেখা , প্রেসিডেন্টের নির্দেশে জরুরী তদন্তে এসেছি। কারাগারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার কেউই বুঝতে পারছিলেন না, কি তাদের করনীয়।

কারাগারে ওই সময় মূল ফটকের বাম দিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষ। সেখানকার টেলিফোনটি বেজে উঠে। জেলার এগিয়ে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন। অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।

গণমাধ্যমের কাছে ২০১০ সালে ওই ঘটনার সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তৎকালীন জেলার আমিনুর রহমান বলেন, টেলিফোনে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবেস আইজি সাহেবের সাথে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম।

কথা শেষে আইজি সাহেব আমাদের ডেকে বললেন প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলেছেন আর্মি অফিসাররা যা কারতে চায়, তা করতে দাও। অফিসারদের কথা মতো তোমরা কাজ করো।

কারা মহাপরিদশর্ক (আইজি প্রিজন) নুরুজ্জামান ৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে সেই রাতে কারাগারে প্রবেশ করেন৷ মূল ফটকের সামনে কথাবাতার্ চলতে থাকেএকসময় রাত ৩টা বেজে যায়।

আমিনুর রহমান বলেন, এক পর্যায়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের চার নেতাকে একত্র করার আদেশ আসে। আইজি প্রিজন একটি কাগজে চার ব্যক্তির নাম লিখে জেলার আমিনুর রহমানকে দিলেন।

চারজন হলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান।

আমিনুর রহমানের বণর্না অনুযায়ী সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ কারাগারের একটি কক্ষে ছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে অপর কক্ষ থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আসার আগে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কাপড় পাল্টে নিলেন।

আমিনুর রহমানের বণর্না করেন, তাজউদ্দীন সাহেব তখন কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। ওনারা কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করলেন না তাদের কোথায় নেয়া হচ্ছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব হাত-মুখ ধুলেন। আমি বললাম আর্মি আসছে।।

চারজনকে যখন একটি কক্ষে একত্র করার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগার কারণে সেনাসদস্যরা কারা কমর্কতাের্দর নোংরা ভাষায় গালাগাল করছিল বলে জানান আমিনুর রহমান। তিনি বলেন, মনসুর আলী সাহেব বসা ছিল সবর্ দক্ষিণে। যতদূর আমার মনে পড়ে। আমি মনসুর আলীর ‘ম’ কথাটা উচ্চারণ করতে পারি নাই, সঙ্গে সঙ্গে গুলি।

চারজনকে নিউ সেলে জড়ো করে ঘাতকরা ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে৷

তখনকার ডিআইজি প্রিজন কাজী আবদুল আউয়াল ৩রা নভেম্বরেই লালবাগ থানায় অনেকটা গোপনে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন৷

আমিনুর রহমান জানান, তখনকার আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান জানতেন যে ৪ নেতাকে কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করা হবে৷ কিন্তু কারাগারের আর কোন কর্মকর্তা ভাবতেই পারেননি যে ওই রাতে এমন পৈশাচিক হত্যাকান্ড ঘটবে৷

কারাগারের ভেতর এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর চার নেতার পরিবার সেদিন জানতে পারেনি। তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার কারাগারে খোঁজ নেয়ার জন্য সারাদিন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।

পরের দিন অথার্ৎ ৪ নভেম্বর পুরান ঢাকার এক বাসিন্দা তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় গিয়ে জানান যে, তিনি আগের দিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলির শব্দ শুনেছেন। ৪ নভেম্বর বিকেল চারটার দিকে পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত হন তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।

হত্যাকান্ডের ২ দিন পর পরিবারের সদস্যদের কাছে জাতীয় নেতাদের লাশ হস্তান্তর করা হয়৷ কিন্তু তা ছিল সেনা পাহারায়৷ তার আগে কারাগারের ভেতরে লাশের ময়না তদন্ত হয়৷

ওইসময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে লে. কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে তিনি মারা যান।

জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে আমিন আহমেদ দাবি করেন, ওই সময় সেনাবাহিনীতে নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েনের পরিণতি ছিল জেলখানার হত্যাকাণ্ড। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের বিপরীতে পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছিল ৩ নভেম্বর। সেটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ।

আমিন আহমেদ চৌধুরীর মতে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি ছিল অনিবার্য।কারণ শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা তখন বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে পরিচালনা করছিলেন।

শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কম্যান্ড-এর আওতায় আনার জন্য ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্ব অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন জেনারেল চৌধুরী। তাছাড়া শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডকেও তাঁরা মেনে নিতে পারছিলেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সে অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীর ভেতরে আবারো চেইন অব কমান্ড ভাঙার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল বলে মনে করেন জেনারেল চৌধুরী।

খালেদ মোশারফের অনুগত সৈন্যরা বন্দি করে সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানকে।ঢাকা সেনানিবাসে যখন এ অবস্থা চলছিল সে সময় পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে জেলখানায় আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র নেতাকে হত্যা করা হয়।

পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানের আশংকায় ছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।

মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূণর্ পদগুলোতে থেকে জাতীয় চার নেতা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, অথর্মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খাদ্য ও ত্রাণমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান।

শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, সব আন্দোলন-সংগ্রামে এই চার নেতা ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুকে যখন কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে তখন আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে এই চার নেতা আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন।

তাই হয়তো ঘাতক চক্রের লক্ষ্য ছিল বাঙালিকে নেতৃত্বশূন্য করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের পদানত করে মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে আটক করে রাখার পর যে চার নেতা বঙ্গবন্ধুর হয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন সেই চার নেতাকেও বঙ্গবন্ধুর মতো নিমর্মভাবে হত্যা করা হয়।

শেয়ার করুন: