‘ভণ্ডপীর’ পিয়ারের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ! শতাধিক নারীকে………

জিন-ভূত তাড়ানোর নামে তরুণীদের কৌশলে বাসায় নিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ও পর্নো ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে গ্রেফতার ‘ভণ্ডপীর’ আহসান হাবিব পিয়ারের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেবে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপ-পরিদর্শক সজীবুজ্জামান জানান, ভণ্ডপীর আহসান হাবীব পিয়ারের কোন ব্যাংকে কত টাকা আছে, তা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকে অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট চেয়ে আবেদন করেছি। স্টেটমেন্ট পেলেই তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেবো। স্টেটমেন্ট পেতে এক-দুই মাস সময় লাগতে পারে।

তদন্তকারী এই কর্মকর্তা আরও বলেন, তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। এছাড়াও সে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মামলার তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ইসলাম প্রচারের নামে সাহায্য হিসেবে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিকাশের মাধ্যমেও অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

প্রসঙ্গত, জিন-ভূত তাড়ানোর নামে সুন্দরী তরুণীদের কূটকৌশলে বাসায় নিয়ে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতেন ‘ভণ্ডপীর’ আহসান হাবিব পিয়ার। ইংরেজি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী হাবিব কথার জাদুতে তরুণীদের সহজেই আকৃষ্ট করতে পারতেন।

নানা সমস্যা নিয়ে ছুটে আসা উঠতি বয়সী মেয়েদের কথার জাদুর ফাঁদে ফেলে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতেন তিনি। গোপনে সে দৃশ্য ভিডিও করতেন। পরে ওই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আদায় করতেন মোটা অংকের টাকা।

প্রতারণার শিকার রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্রী জানান, আহসান হাবিবের ইউটিউবে এইচপি নামে একটি চ্যানেল রয়েছে।

ওই চ্যানেলে মাঝেমধ্যেই ছদ্মনামে হাজির হতেন তিনি। কথার জাদুতে আকৃষ্ট হয়ে ওই তরুণী তার খপ্পরে পড়েন। এক পর্যায়ে হাবিব ওই তরুণীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সে দৃশ্য ভিডিও করে পরবর্তীতে তরুণীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়।

এ ধরনের ঘটনায় বেশ কয়েকজন নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের ১ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁও থেকে কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিট হাবিবকে গ্রেফতার করে।

ওইদিনই তার বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের সহকারী উপ-পরিদর্শক লুৎফর রহমান। এরপর গ্রেফতার ‘ভণ্ডপীর’কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

রিমান্ড শেষে ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম এ কে এম মাঈন উদ্দিন সিদ্দিকীর আদালতে পিয়ার ঘটনার স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আটক রয়েছেন।

শতাধিক নারীকে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করে ভন্ড পীর :
পর্নো ভিডিও ধারণ করে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার কথিত পীর আহসান হাবিব পেয়ার সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দারা কথা বলেছেন। শুক্রবার রাজধানীর খিলগাঁও থানা এলাকার তিলপাপাড়ার ২২ নম্বর রোডের ৮১৯/এ বাড়ির ফ্ল্যাটে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৭০ লাখ টাকায় বছর তিনেক আগে ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন আহসান হাবিব।

বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী জিয়াউর রহমান জানান, আহসান হাবিরের দুটি গাড়ি গ্যারেজে রাখা হয়: একটি প্রাইভেটকার, অন্যটি নোয়া ব্র্যান্ডের মাইক্রোবাস। ভবনের সব ফ্ল্যাট ব্যক্তি মালিকানাধীন।

এখানে কেউ ভাড়া থাকেন না। হাসিনা বেগম ও মাহমুদা নামের দুই ধর্মবোন, তাদের বোনজামাই, মা এখানে বসবাস করতেন। তবে তাদের আপন ভাইবোন হিসেবেই জানত সবাই। পেয়ারকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কেউ বাসায় ফেরেননি।

নিরাপত্তাকর্মী আরো বলেন, আহসান হাবিব পেয়ার সব সময় লম্বা পাঞ্জাবি, টুপি পরে চলাফেরা করতেন। তার হাতে সব সময় একটা টেলিভিশনের বুম থাকত। আর একজন ক্যামেরাম্যান তাঁর বাসায় যাতায়াত করতেন।

সবাই এ জন্য তাঁকে সাংবাদিক পীর নামেই চেনেন। তিনি সাধারণত বাসা থেকে বের হতেন না। অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ওই বাসায় আসত। আর আহসান হাবিব পেয়ার নাকি সৌদি আরব থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন বলে তিনি শুনেছেন।

বাড়ির পাশেই একটি চায়ের দোকান। পেয়ার সম্পর্কে জানতে চাইলে দোকানি মো. মমতাজ আলী বলেন, পেয়ারের চেহারা দেখতে অনেক সুন্দর। দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে সালাম দিতেন তিনি। মমতাজ বলেন, ‘পীরসাহেব শুনছি নাকি সাংবাদিক। আমার দোকানের সামনে আইস্যা একদিন একজনরে বলতাছে, আমি এই সব দোকানে চা খামু না।

বাড়ির পাশের গলিতে রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মামা টেলিকম। স্থানীয়রা জানায়, আহসান হাবিব পেয়ার সেখানে অনেক সময় বসে থাকতেন।

প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মো. নাইমুল ইসলাম বলেন, আহসান হাবিব তাঁর দোকানে মোবাইল ফোনে রিচার্জ করতে আসতেন। এ ছাড়া তার মোবাইল ফোন থেকে ইউটিউব চ্যানেলের গান, অনুষ্ঠান দেখাতেন তাদের। বিকাশে তার মোবাইল ফোন থেকে টাকা ক্যাশ আউট করতেন।

খিলগাঁও থেকে জিন ও ভূত তাড়ানোর নামে তরুণীদের সঙ্গে পর্নো ভিডিও ধারণ করে প্রতারণার অভিযোগে আহসান হাবিব পেয়ারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি ও ক্রাইম বিভাগ।

এ বিষয়ে খিলগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কিছু মেয়ের পর্নো ভিডিও তৈরি করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন এক ব্যক্তি। এমন সংবাদের ভিত্তিতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রতারণার মাধ্যমে আহসান হাবিব নিজের মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে অনেক মেয়ের পর্নো ভিডিও তৈরি করেন এবং তা তাঁর কম্পিউটারে সেভ করে রাখেন। কিছু দিন আগে দুই নারীর কাছে থেকে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।

জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, ইসলামের অপব্যাখা দিয়ে জিন তাড়ানোর নামে তিনি মেয়েদের ফাঁদে ফেলে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করতেন। তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে তাঁর পেজে এএইচপি টিভি নামের একটি ভুয়া চ্যানেল খুলে এবং নিজেকে সাংবাদিক পরিচয়ে মেয়েদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলেন তিনি।

শেয়ার করুন: