তারেক রহমান
তারেক রহমান

তারেক রহমানকে দেশে ফেরানো সম্ভব?

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে আদালত। আর এ সাজা কার্যকর করতে হলে তাকে লন্ডন থেকে দেশে ফেরত আনতে হবে। তবে তাকে দেশে ফেরত আনতে হলে কি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, সেটি নিয়ে রয়েছে অনেকের কৌতূহল।

যুক্তরাজ্যের বন্দী বিনিময় আইন-২০০৩ অনুযায়ী তারেক রহমানকে দেশে ফেরত আনা সম্ভব না। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বন্দী বিনিময় বা প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই।

এমন বাস্তবতায় কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সে সব ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয়।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফেরত আনা কোনোভাবেই সম্ভব না। লিগ্যালি তাকে আনার কোনো স্কোপ (সুযোগ) নাই।

তারেক রহমান নিজে থেকে ফেরত না আসলে তাকে কোনোভাবেই ফেরত আনা সম্ভব না। আমাদের দেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের কোনো বন্দী বিনিময় চুক্তি নাই।’

রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুল আলম বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের দি এক্সট্রাডিশন অ্যাক্ট (বন্দী বিনিময় প্রত্যাবর্তন আইন)-২০০৩ অনুযায়ী তাদের সঙ্গে যে দেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি আছে সেই দেশের সঙ্গে বন্দী বিনিময় করতে পারবে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের এ ধরনের কোনো চুক্তি নাই। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে আইনগতভাবে তারেক রহমানকে ফেরত আনা সম্ভব না।’

‘তারেক রহমানকে দেশে ফেরত আনতে হলে তাদের দেশের সরকারের সঙ্গে কথা বলে চুক্তি করতে হবে বন্দী বিনিময়ের জন্য। অথবা সে দেশের লিগ্যাল ফাইটে অংশগ্রহণ করতে হবে।’

সাইফুল আলম আরও বলেন, ‘তারেক রহমানকে ফেরত আনতে হলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের দেশের (যুক্তরাজ্যের) মন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠাবে। সে দেশের মন্ত্রী আমাদের প্রস্তাব ইমিগ্রেশন কোর্টে পাঠাবে।

আদালত এ বিষয়ে শুনানি করে সিদ্ধান্ত দেবেন। আমাদের দেশের আবেদন গ্রহণ করলে তারেক রহমানকে ফেরত আনা যাবে। আবেদন খারিজ করলে কোনোভাবেই তারেক রহমানকে দেশে ফেরত আনা যাবে না।’ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘তারেক রহমানকে দেশে ফেরত আনতে হলে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিতে হবে।

নরমাল কোনো পদ্ধতিতে তাকে দেশে ফেরত আনা যাবে না। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি করে তাকে ফেরত আনা যাবে। তাদের দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি নাই।’ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিএনপির এই নেতাকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩ ও ৬ নং ধারায় দোষি সাব্যস্ত করে সাজা দেওয়া হয়েছে।

এ ধারাগুলোতে যা বলা আছে:- ধারা-৩: জীবন, দেহ বা সম্পতি বিপন্ন করিতে পারে এমন বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য শাস্তি- কোনো ব্যক্তি যিনি বেআইনিভাবে বা বিদ্বেষপূর্ণভাবে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্যের দ্বারা এমন ধরনের বিস্ফোরণ ঘটান, যাহাতে জীবন বিপন্ন হইবার সম্ভাবনা থাকে, বা দৈহিক, বা সম্পত্তি মারাত্মক ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা থাকে, তাহা হইলে দৈহিক বা সম্পত্তির কার্যত কোনো ক্ষতি হোক না হোক,

তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে শাস্তিযোগ্য হইবেন, যাহাতে অর্থদণ্ড যুক্ত করা যাইবে, বা কারাদণ্ডে শাস্তিযোগ্য হইবেন যাহার মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত হইতে পারে তবে উহা অনুন্য পাঁচ বছর হইবে যাহাতে অর্থদণ্ড যুক্ত করা যাইবে।

ধারা-৬ঃ প্ররোচকের শাস্তি- কোনো ব্যক্তি যিনি অর্থ সরবরাহ করিয়া, বা অর্থের জন্য আবেদন করিয়া বা গৃহাদির সংস্থান করিয়া, উপকরণাদি সরবরাহ করিয়া, বা যেকোনো উপায়েই হোক, এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে তৎপর হোন, পরামর্শ দেন, সাহায্য করেন, প্ররোচণা দেন, বা উহাতে সহযোগী হন তাহা হইলে তিনি অপরাধটির জন্য ব্যবস্থিত দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাসমূহ- এ ঘটনায় রাজধানীর মতিঝিল ও ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতে আলাদা দুটি মামলা দায়ের করা হয়। মতিঝিল থানায় জি আর মামলা ৪৯৮/২০০৪ ইং। দণ্ডবিধির ১২০ (বি) ৩২৪/৩২৬/৩০৭/৩০২/ ২০১/১১৮/১১৯/২১২/২১৭/২১৮ ধারায় মামলাটি করা হয়।

ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করা হয় ২০০৭ সালে। সি আর মামলা নং ১১৭৮/২০০৭ ইং। দণ্ডবিধির ৩২৪/৩২৫/ ৩২৩/৩০৭/৩০২/৩৪/৫০৬ ধারা মামলায় উল্লেখ করা হয়।

সঙ্গে অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩ ও ৪ ধারা যুক্ত করেন মামলার বাদী বদর আজিজ উদ্দিন। তিনি সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ২০ জনের নাম উল্লেখ করে অসংখ্য অজ্ঞাত আসামি করেন এ মামলায়।

বাদী অভিযোগ করেন, ঘটনার দিন ২৩, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ৫টা ২০ মিনিট হতে ৫টা ২৭ মিনিট পর্যন্ত ঘটনা ঘটে। বাদী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী দাবি করেন নিজেকে। আসামিগণ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী, হত্যাকারী, সন্ত্রাসের গড ফাদার বলে মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়।

বাদী আরও অভিযোগ করেন, ঘটনার দিন আওয়ামী লীগের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল। সেখানে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়ে মঞ্চ থেকে নামছিলেন।

সে সময় খালেদা জিয়ার নির্দেশে সন্ত্রাসীরা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাদের হাতে থাকা স্পেনের তৈরী শক্তিশালী আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন অনেকেই।

যে সব মামলা ও দণ্ড নিয়ে লন্ডনে রয়েছেন তারেক রহমান: লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কয়েকটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদকের) দায়ের করা অর্থপাচার মামলায় দণ্ডাদেশ পেয়েছেন সাত বছর।

দুর্নীতির দায়ে ১০ বছর দণ্ডাদেশ পেয়েছেন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায়। আর নতুন করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ পেলেন বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা।

শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসা নেওয়ার জন্য তিনি ২০০৮ সালে হাইকোর্টের অনুমতি নিয়ে লন্ডনে যান। পরে তার জামিনের মেয়াদ বাতিল করে আদালতে হাজির হতে সমন জারি করা হয়। তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে না আসায় পলাতক আসামি হিসেবে তার বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।

অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা ও সাজা বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১০ সালের ৬ জুলাই ওই মামলায় তারেক রহমান ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয় আদালতে।

২০১১ সালের ৮ আগস্ট তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়ে অভিযোগ গঠন করে আদালত। এ মামলার ২০১৩ সালের রায়ে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সাজা হলেও তারেক রহমানকে খালাস দেয় আদালত।

আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে দুদকের আপিলের পর ২০১৬ সালের ২১ জুলাই বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয় হাইকোর্ট। পাশাপাশি ২০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা ও সাজা ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রাজধানীর রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করে দুদক। মামলায় খালেদা জিয়াসহ আসামিদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয় যে, এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে পাঠানো দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এ মামলায় চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি অন্য আসামিদের সঙ্গে তারেক রহমানকেও ১০ বছরের দণ্ড দেওয়া হয়। খালেদা জিয়াকে দেওয়া হয় পাঁচ বছরের দণ্ড।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ও সাজা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। এ ঘটনার দীর্ঘ ১৪ বছর পর ১০ অক্টোবর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।

রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারক। একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে অপর ১১ আসামিকেও।

এই মামলায় মোট আসামি ছিল ৫২ জন। জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও জেএমবি সদস্য শহিদুল আলম বিপুলের অন্য মামলায় ইতোমধ্যেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। আদালত ৪৯ আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করে। এর মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন।

শেয়ার করুন: