মানসিক চাপ

বিশ্বের সবচেয়ে ‘মানসিক চাপের’ শহর ঢাকা!

সম্প্রতি, কেন ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ‘মানসিক চাপের’ শহর? যেখানে ঢাকাবাসীর মানসিক চাপ কমানোর জন্য কতৃর্পক্ষ বা বেসরকারিভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই এমন বিষয়ই সামনে এসেছে।

বিশ্বে সবচেয়ে শারীরিক ও মানসিক চাপের শহরগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে আছে ঢাকা৷ তবে এশিয়ায় ঢাকার অবস্থান আরো খারাপ৷ যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যিপজেটের ২০১৭ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকাতে বাস করা সবচাইতে স্ট্রেসফুল বা মানসিক চাপের ব্যাপার।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই চাপ হতাশার সৃষ্টি করে৷ এই হতাশার কারণে অনেক নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে ঢাকায় বসবাসরত নাগরিকদের৷

যিপজেট মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, ট্রাফিক জ্যাম, লৈঙ্গিক সমতাসহ বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণ করে এই তালিকা তৈরি করেছে৷ ১৫০টি শহরের উপর করা বৈশ্বিক এই তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৪৪, যা এশিয়ার মধ্যে খুব খারাপ৷

তবে ঢাকার চেয়েও বেশি চাপের মধ্যে আছে ইরানের তেহরান, আফগানিস্তানের কাবুল, নাইজেরিয়ার লাগোস৷ তালিকার সবশেষে, মানে সবচয়ে বেশি চাপের শহর হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইরাকের রাজধানী বাগদাদ৷ ঢাকা বিশ্বের অন্যতম চাপগ্রস্থ শহর হওয়ার পিছনে মূল কারণ ছিল ট্রাফিক জ্যাম, ঘন জনবসতি ও দুষণ৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম এ মালেক বলেন, ‘ঢাকা শহরের প্রধান সমস্যা যানজট। গাড়ি বেশি, সড়ক কম৷ ঢাকা একটা মেগাসিটি৷ এখানে অনেক লোকের বসবাস৷ এখানে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার, তা নেই৷ মার্কেটগুলো শহরে আরো চাপ তৈরি করছে৷ এর একটা প্রভাব আছে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম মনে করেন, ‘ঢাকা শহর নানা দিক দিয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে৷ এটা বড় ধরণের মানসিক চাপে রাখছে ঢাকার অধিবাসীদের৷

তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে৷ বাসা থেকে কর্মস্থলে যেতে যানজটের কারণে দীর্ঘ সময় পথে থাকতে হয় যা প্রতিনিয়ত আমাদের উপর মানসিক চাপ তৈরি করছে। আর এর ফলে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘নাগরিকরা অনেক সুযোগ-সুবিধাই পায়না৷ তারপরও গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ছে এবং বাড়ছে হোল্ডিং ট্যাক্স৷ নগরবাসীর জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠছে৷’

তাজুল ইসলাম মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, ‘ মানসিক চাপের ফলে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে৷ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে৷ অল্পতেই রেগে যাচ্ছে৷ রগচটা হয়ে পড়ছে৷ সামাজিক আচরণে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে৷ তরুণ বা কমবয়সিরা এই মানসিক চাপ বা হতাশা থেকে মাদকাসক্ত হতে পারে, অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে৷ এবং তারা জড়িয়ে পড়ছেও।’

চাপ কম এমন বিবেচনায় শীর্ষ পাঁচটি শহরের তিনটি শহরই জার্মানির৷ স্টুটগার্ট প্রথম, হানোফার তৃতীয় এবং মিউনিখ রয়েছে পঞ্চম অবস্থানে৷ অস্ট্রেলিয়ার সিডনি রয়েছে তালিকার ৮ নম্বরে৷

শীর্ষের বেশিরভাগ শহরই ইউরোপের৷ এশিয়ার মধ্যে কম চাপের শহর সিঙ্গাপুর৷ তাদের অবস্থান ৪২৷ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক রয়েছে তালিকার ৮৪ নম্বরে৷ মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের অবস্থান ১১০ তম৷ আব্দুর রহমান। তিনি একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করেন। ঢাকার দক্ষিন বনশ্রীতে তার বাসা। অফিস মতিঝিলে।

রহমান বলেন, অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে তিনি বেড় হন সকাল ৭টায়। কিন্তু যখন তিনি জ্যামে পড়েন তখন আস্তে আস্তে তার মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। একটা ভয় তখন কাজ করে। আর সেটা হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অফিসে পৌঁছাতে না পারা। এই সময় মেজাজও তার খিটখিটে হয়ে যায়।

যিপজেটের গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপ সৃষ্টির পেছনে শব্দ ও বায়ু দূষণ যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, প্রাকৃতিক পরিবেশের হার কমে যাওয়া, গণ-পরিবহন ও ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি বিষয়সমূহ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের মনোবিজ্ঞানী ডাঃ মেখালা সরকার বলেন, এসব বিষয় একজন মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে। প্রতিদিনের কাজ সম্পন্ন করা যখন কঠিন হয়ে যায় সিম্পল একটা জ্যামের কারণে তখন সেটা একজন মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে।

শহরে দেখবেন সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক অবিশ্বস্ততা, সেটাও অস্থিরতা থেকে আসতে পারে। আমরা সাময়িক একটা আনন্দের জন্য আমাদের মনটাকে নানাভাবে ‘চ্যানেলাইজ’ করছি।

ঢাকা শহরে যে ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে মানুষজন বসবাস করে এবং তা মোকাবেলার জন্য কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয় তা স্বীকারও করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।

তিনি বলছেন, ২০১৭ সালের শুরুতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ৩১টি খেলার মাঠ ও পার্ক পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেছে, যাতে মানুষজন সেখানে সময় কাটাতে পারে। পাশাপাশি ‘গোস্বা ঘর’ নামে একটি অভিনব উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেসব এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

শেয়ার করুন: