বিশ্বের আটটি দামি খাবারের একটি তৈরি হয় বিশেষ এক ধরনের বিড়ালের মল থেকে কফি বিন সংগ্রহ করে। বিশ্বের সবচেয়ে দামি আটটি খাবার কী দিয়ে তৈরি হয়, কেন এত দাম, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন। চলুন দেখে নিই সেটি।
১. জাফরান: আপনার পাতের ভাত যদি হলদে রঙের আভা ছড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে এটির ওপর ছিটানো হয়েছে জাফরান। জাফরান আসলে একটি ফুলের গর্ভমুণ্ড। এটি মূলত ব্যবহার করা হয় খাদ্য রঙিন করতে। যদি ওজনের তুলনা করেন, এটি নিঃসন্দেহে স্বর্ণের চেয়ে দামি। কেন জাফরানের দাম এত বেশি?
কারণ খুব সহজ। যে ফুল থেকে এই জাফরান সংগ্রহ করা হয়, সেটি ফোটে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য, শরৎকালের শুরুতে। একটি ফুলে মাত্র তিনটি গর্ভমুণ্ড থাকে। খালি হাতে এটি খুব সতর্কতার সঙ্গে সংগ্রহ করতে হয়। এক কিলোগ্রাম জাফরান সংগ্রহ করতে অন্তত দুটি ফুটবল মাঠের সমান জায়গায় এই ফুলের চাষ করতে হবে। বা দরকার হবে প্রায় তিন লাখ ফুল।
২. ক্যাভিয়ার: ক্যাভিয়ার আসলে এক ধরনের সামুদ্রিক মাছের ডিম। এই ডিমকে নোনা জল ও চাটনিতে রসিয়ে নেয়া হয়। বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু খাবারের একটি বলে গণ্য করা হয় একে। এই ক্যাভিয়ার সংগ্রহ করে প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করার কাজটি খুবই দুরূহ। তবে তার চেয়ে বড় কথা হলো ক্যাভিয়ার খুবই বিরল।
সবচেয়ে বিখ্যাত ক্যাভিয়ার আসে বেলুজা স্টার্জেন মাছ থেকে। কেবল কাস্পিয়ান সাগর ও কৃষ্ণ সাগরে এই মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু এই মাছ এখন বিপন্নপ্রায়। খুব কম মাছের ডিমই এখন বৈধভাবে কেনাবেচা হয়। একটি বেলুজা ক্যাভিয়ার পূর্ণবয়স্ক হতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর। এর পরই কেবল এই মাছ ডিম পাড়তে পারে। কিন্তু এই মাছ হত্যা করেই কেবল এর ডিম সংগ্রহ করা সম্ভব।
অ্যালবিনো স্টার্জেন মাছের ডিম তো আরও বিরল। এটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের হিসাবে এক কিলোগ্রাম অ্যালবিনো ক্যাভিয়ারের সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ৩৪ হাজার ৫০০ ডলার।
৩. ঝিনুক: ঝিনুক এখন বিলাসী খাবার হিসেবে বিবেচিত হলেও আগে কিন্তু তা ছিল না। উনিশ শতকের শুরুতে ঝিনুক ছিল খুব সস্তা। উপকূলীয় এলাকার শ্রমজীবী লোকজনের অন্যতম প্রধান খাবার ছিল এটি। কিন্তু অতিরিক্ত ঝিনুক আহরণ এবং সমূদ্রদূষণের ফলে ঝিনুকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ফলে এর দাম বেড়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দামে বিক্রি হয় ঝিনুক। কিন্তু লন্ডনের কোনো দামি রেস্তোঁরায় এক ডজন ঝিনুক খেতে আপনাকে অন্তত ৬৫ ডলার খরচ করতে হবে। তারপরও এর কদর কমছে না। অনেকে তো মনে করে ঝিনুকের মধ্যে আছে যৌনশক্তি বর্ধক উপাদান।
৪. সাদা ট্রাফল: সাদা ট্রাফল বিশ্বের সবচেয়ে দুর্লভ ছত্রাকগুলোর একটি। এটি জন্মায় মাটির নিচে। তাও আবার কেবল উত্তর ইটালির পাইডমন্ট অঞ্চলের কিছু গাছের শেকড়ের মধ্যে।
সাদা ট্রাফলের মধ্যে আছে এক দারুণ সুগন্ধ। এবং খুবই তীব্র এক স্বাদ। সাদা ট্রাফলের চাষ করা যায় না। এটি নিজে থেকে হয়। অনেকে এই ট্রাফলের চাষ করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। এ কারণেই সাদা ট্রাফলের দাম এত বেশি। ম্যাকাওয়ের এক ক্যাসিনো মালিক স্ট্যানলি হো একটি মাত্র সাদা ট্রাফলের জন্য ২০০৭ সালে ৩ লাখ ৩০ হাজার ডলার খরচ করেছিলেন। সেই ট্রাফলটির ওজন ছিল দেড় কেজি। মাটির নিচে জন্মানো দেড় কেজি ছত্রাকের জন্য বেশ চড়া মূল্যই বলতে হবে।
৫. ইবেরিকো হ্যাম: একটা প্রবাদই আছে। পৃথিবীতে দুই ধরনের হ্যাম আছে। হ্যাম, আর ইবেরিকো হ্যাম। এই বিশেষ ধরনের শূকরের মাংস আসে কেবল স্পেন আর পর্তুগালের একটি নির্দিষ্ট এলাকা থেকে। সেখানে ওক গাছের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় কালো ইবেরিয়ান শূকর ।
ওক গাছ থেকে ঝরে পড়া ফল খেয়ে বাঁচে এই শূকর। ইবেরিয়ান হ্যাম আসে এই শূকর থেকে। প্রায় তিন বছর ধরে এই শূকরের মাংস প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কখনো কখনো চার বছর। গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের হিসাবে সবচেয়ে দামি ইবেরিয়ান শূকরের একটি পা সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০ ডলার দামে বিক্রি হয়েছিল।
৬. ওয়েগু বিফ: ওয়েগু বিফ মানে আসলে জাপানি গরুর মাংস। চার ধরনের জাপানি গরুর যে কোনোটি থেকেই আসতে পারে এই মাংস। এই গরুর মাংসের পরতে পরতে থাকে চর্বি। যখন রান্না করা হয়, তখন এই চর্বি গলে মাংসে মিশে যায়। ফলে মাংসটা থাকে খুবই নরম। মুখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হবে মাংসটা যেন গলে যাচ্ছে।
এর দাম এত বেশি হওয়ার কারণ, এসব গরু পালতে খরচ অনেক। ওয়েগু মাংস হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য এই গরুগুলিকে কঠোর নিয়ম-নীতি মেনে পালতে হয় এবং বড় করতে হয়। যাতে তাদের পেশীর পরতে পরতে চর্বি জমে সেজন্যে বাছুরগুলোকে একেবারের শুরু থেকেই বিশেষ ধরণের খাবার খাওয়ানো হয়। জাপানে সবচেয়ে দামি ওয়েগু বিফ হচ্ছে 'কোবে বিফ'। প্রতি কেজির দাম ৬৪০ ডলার।
৭. কোপি লুয়াক কফি: এক কাপ কফি কেন দামি খাবারের তালিকায়, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু এটি যেমন-তেমন কফি নয়। এই কোপি লুয়াক কফির দাম প্রতি কেজি ৭০০ ডলার।
যে কফি বিন থেকে এই কফি তৈরি হয়, সেই বিনগুলো এক ধরনের বিড়ালকে খাওয়ানো হয়। এশিয়ান পাম সিভেট নামের এই বিড়াল কফি বিনগুলো খাওয়ার পর সেগুলো তার পাকস্থলীর এসিডে জারিত হয়। এরপর বিড়ালের মলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে এই কফি বিন। সেই বিন থেকে তৈরি হয় কফি। আশা করি এই প্রক্রিয়ার কথা শুনে কফি খাওয়ার বাসনা আপনার উড়ে যায়নি! যারা এই কফির ভক্ত, তাদের যুক্তি, বিড়ালের পেটেই আসলে এই কফির সঙ্গে যুক্ত হয় ভিন্ন এক ফ্লেভার।
৮. ফোয়া গ্রা: ফোয়া গ্রা একটি দামি খাবার। মূলত হাঁস বা রাজহাঁসের লিভার বা যকৃৎ দিয়ে তৈরি করা হয় এই খাবার। এই হাঁস বা রাজহাঁসের লিভার স্বাভাবিক আকারের চাইতে প্রায় দশ গুণ পর্যন্ত বড় করা হয় বেশি করে খাইয়ে।
এ কারণে এই লিভারের স্বাদ অনেক বেশি। যারা এই খাবারের ভক্ত, তারা এর জন্য যেকোনো মূল্য দিতে রাজি। তবে মানুষের এই লোভের বলি হচ্ছে হাঁস। কারণ তাদের জোর করে বেশি খাইয়ে মেদবহুল করে তোলা হচ্ছে।
গলা দিয়ে টিউব ঢুকিয়ে এসব হাঁসকে জোর করে খাওয়ানো হয়। উদ্দেশ্য তাদের লিভারকে স্বাভাবিকের চেয়ে বহুগুণ বড় করে তোলা। এই প্রথা নাকি চালু আছে কয়েক হাজার বছর ধরে। তবে এখন অনেক দেশে ফো গ্রা উৎপাদনের বিরুদ্ধে আইন করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের অনেক জায়গায় এখনো এই খাবার ভীষণ জনপ্রিয়।