কোরবানির ঈদে অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় খাওয়া-দাওয়া। ঈদের আনন্দ ভিন্ন মাত্রা পায় মাংসের বাহারী সব রান্নায়। এই সময়টা আমাদের ইচ্ছে মতো মাংস খাওয়া হয়।এই সময় আমাদের অনেকেরই মাথায় থাকে না খাবারের পুষ্টিগুণ কিংবা অতিরিক্ত খাওয়ার অপকারিতার কথা। তাই এইদিনে গরুর মাংস খেয়েও কিভাবে সুস্থ থাকা যায়, জেনে নিন কিছু টিপস।
চর্বি ফেলে দিয়ে মাংস খান: কসাই এর কাছে থেকে মাংস আসার পর দেখা যায় মাংসে প্রচুর চর্বি থাকে। ওজন বাড়া এবং বিভিন্ন রোগ বেড়ে যাবার জন্য কিন্তু এই চর্বিই দায়ী। এসব কারণে মাংস থেকে চর্বি কেটে ফেলে দিন যতটা সম্ভব। অনেকেই চর্বিযুক্ত মাংস পছন্দ করেন কিন্তু স্বাস্থ্যের প্রতি মায়া থাকলে এই চর্বিটুকু বাদ দেওয়াই আপনার জন্য ভালো।
অতিরিক্ত তেল-চর্বি দিয়ে রান্না করবেন না: মাংস রান্নার সময়ে অতিরিক্ত চর্বি তো বাদ দেবেনই, সাথে অতিরিক্ত তেল-চর্বি না দিয়েই রান্না করার চেষ্টা করুন। চর্বি ফেলে দেবার পরেও মাংসের ভেতরে যতটা চর্বি থাকে তা' রান্নার জন্য যথেষ্ট। এতে আরো চর্বি বা তেল যোগ করলে রান্না হয়তো মজা হবে কিন্তু স্বাস্থ্যের হবে ক্ষতি।
বেশি করে সবজি খান মাংসের সাথে: কোরবানি এলেই যে সবজি খাওয়া বাদ দিতে হবে তা' কিন্তু নয়। বরং সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখার জন্য অনেকটা করে সবজি খাবেন প্রতিটি বার মাংস খাওয়ার সময়ে। খেতে পারেন সালাদ অথবা সবজির তরকারি। মাংসের সাথেও সবজি দিয়েই রান্না করতে পারেন।
কিমা থেকে ঝরিয়ে ফেলুন চর্বি: মাংসের টুকরো থেকে চর্বি কেটে সরিয়ে ফেলা যতো সহজ, কিমা থেকে চর্বি কমানো তত সহজ না বলে মনে করেন অনেকে। আসলে কিন্তু তা নয়। বেশ কয়েকটি উপায়ে কিমা থেকে চর্বি সরিয়ে ফেলতে পারেন। কড়াইতে কিমা একটু ভেজে নিন, এতে চর্বিটা গলে বের হয়ে আসবে। এই চর্বিটুকু কড়াই কাত করে ফেলে দিন। এছাড়াও ঝাঁঝরি চামচে করে মাংস তুলে নিতে পারেন এতে চর্বিটা আলাদা হয়ে যাবে। মাংসটুকু তুলে পেপার টাওয়েল দিয়ে শুষে নিতে পারেন চর্বিটুকু।
এছাড়াও গরম পানি ব্যবহার করতে পারেন। একটি ঝাঁঝরি বোলে নিন মাংসের কিমাটুকু রাখুন। এরপর প্রায় ফুটন্ত গরম পানি ঢালতে থাকুন এর ওপরে। পানির সাথে চর্বিটুকু গলে চলে যাবে। পানি ঢেলে দেবার পর পাঁচ মিনিট ধরে পানিটা ঝরিয়ে নিন।
অতিরিক্ত মাংস খাবেন না: দৈনিক কিছু পরিমাণ প্রোটিন খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্যই জরুরি। কিন্তু অতিরিক্তও খাওয়া যাবে না। অনেকে মনে করেন কোরবানির সময়টাতেই বেশি করে খেয়ে নেবেন। কিন্তু তা না করাই ভালো। দৈনিক ৯০ গ্রামের বেশি মাংস না খাওয়ার চেষ্টা করুন। তবে হ্যাঁ, প্রতিদিন মাংস খাওয়ায় আপনার ওজন বাড়াবে, পেটের মেদ বাড়াবে বটে। কিন্তু এছাড়াও অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে। চলুন জেনে নিই সেই দিকগুলো....
ডিহাইড্রেশন: অতিরিক্ত প্রোটিন খাওয়ার ফলে ডিহাইড্রেশন বা জলশূন্যতা দেখা দিতে পারে। জলশূন্যতার কারণে আপনার বেশি ক্লান্তি লাগতে পারে, ত্বক খারাপ হয়ে যেতে পারে এমনকি পেশী ব্যথা হতে পারে।
শরীরে দুর্গন্ধ: শরীর ঘেমে গেলে যদি দুর্গন্ধ বেশি হয়, তাহলে হয়তো আপনার মাংস খাওয়াটা অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে।
কোষ্ঠকাঠিন্য: শর্করার বদলে বেশি আমিষ খাওয়া গলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। মাংসের পরিমাণ কমিয়ে এর পাশাপাশি ফল ও সবজি বেশি খাওয়া হলে কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি কমানো যায়।
মাথাব্যথা: মাংস বেশি খাওয়ার ফলে ডিহাইড্রেশন হয়, এরই কারণে দেখা দেয় মাথাব্যথা। শুধু তাই নয়, মাংস বেশি এবং শর্করা কম খাওয়া হলে মস্তিষ্ক যথেষ্ট জ্বালানী পায় না, ফলে মাথাব্যথা এবং চিন্তায় ধীরতা চলে আসে।
চোখের সমস্যা: বেশি মাংস খাওয়া হলো দৃষ্টিশক্তি কমে যাবার ঝুঁকি বাড়ে। এর কারণ হলো, মাংসে থাকা স্যাচুরেটেড ফ্যাট চোখের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তনালীকার জন্য ক্ষতিকর।
হাড়ের দুর্বলতা: খুব বেশি প্রোটিন খাওয়া হলে শরীর থেকে ক্যালসিয়াম বের হয়ে যায় বেশি পরিমাণে। মাংসের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম খাওয়ার পরিমাণ বাড়ালে এ সমস্যাটি কমে বটে। কিন্তু মাংস খাওয়া কম রাখাই আসলে ভালো।
ক্লান্তি: সবসময়েই যদি আপনি ক্লান্তি বোধ করতে থাকেন তাহলে হয়তো আপনার খাদ্যাভ্যাস এর জন্য দায়ী। অনেক সময়ে মাংস বেশি খাওয়ায় তা হজম হয় না। এর কারণে ক্লান্তি দেখা যায়।
নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ: শরীরে দুর্গন্ধের পাশাপাশি নিঃশ্বাসেও দুর্গন্ধ হতে পারে বেশি মাংস খাওয়ার কারণে। বেশি প্রোটিন এবং চর্বি খাওয়ার কারণে শরীর কিটোন নামের এক ধরণের রাসায়নিক উত্পাদন করে। কিটোন নিঃশ্বাসের সাথে শরীর থেকে বের হয় এবং নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ তৈরি করে।
পেটের সমস্যা: আমাদের পেটে এমন অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে যারা আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার ফলে এসব ব্যাকটেরিয়ার ক্ষতি হয়। ফলস্বরূপ স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
লাল মাংসে স্বাস্থ্যঝুঁকি: ১। অতিরিক্ত লাল মাংস গ্রহণ করলে খাদ্যনালি, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, পাকস্থলী, স্তন এবং মলাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
২। রেড মিটে প্রচুর পরিমাণে সম্পৃক্ত ফ্যাট থাকায় এটি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়, রেড মিট উচ্চ রক্তচাপের জন্য অনেকাংশে দায়ী, তাছাড়া শরীরের কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যায় এবং এ থেকে স্থূলতা জন্ম দেয়। ৩। রেড মিট ব্রেইনের ক্ষতি সাধন করে স্মৃতি শক্তি ও চিন্তা শক্তি কমিয়ে দেয়। ৪। এটি আমাদের পরিপাক বা হজম ক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটব্যথা ও ডায়রিয়া, গ্যাস্ট্রিক এনমকি আলসারও হতে পারে।
৫। লাল মাংসে টিনিয়া সেলিনাস নামক একধরনের প্যারাসাইট থাকে যা অন্ত্র, পাকস্থলী, যকৃত প্রভৃতি জায়গায় প্রবেশ করে আমাদের অসুস্থ করে দেয়। ৬। অতিরিক্ত লাল মাংস রক্তনালির ঘনত্ব বাড়ায় যার ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ৭। লাল মাংসে থাকে অধিক ট্রাইসেরাইড,কোলেস্টেরল ও পিউরিন তাই হৃদরোগ, বাত, উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের লাল মাংস কম খাওয়া উচিত।
৮। ডায়বেটিক পেশেন্ট দের জন্য অর্থাৎ যারা ইনসুলিন নিয়ে থাকেন, তাদের জন্য লাল মাংস ক্ষতির কারণ হতে পারে। মাংস রাসায়নিকভাবে প্রোটিন, চর্বি, বিপুল পরিমাণ পানি নিয়ে গঠিত। প্রাপ্তবয়স্ক কোনো স্তন্যপায়ী জীবের মাংসে সাধারণত ৭৫ শতাংশ পানি, ১৯ শতাংশ প্রোটিন, ২.৫ শতাংশ চর্বি, ১.২ শতাংশ শর্করা এবং ২.৩ শতাংশ এমিনো অ্যাসিডসহ অন্যান্য নাইট্রোজেনঘটিত পদার্থ থাকে। মাংসে বিদ্যমান প্রধান দুটি পেশী প্রোটিন হচ্ছে- এক্টিন ও মায়োসিন। এছাড়া আছে কোলাজেন এবং ইলাস্টিন নামক প্রোটিন।
যেকোনো খাবারের ভালো-খারাপ দুটো দিকই থাকে। অতিরিক্ত খেলে অতিরিক্ত পুষ্টি পাওয়া যায়, আবার কম খেলে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি থাকে। তাই সুস্থ থাকার লক্ষ্যে সবাইকে সুষম খাবারের পরামর্শ দেওয়া হয়। সব রকম খাদ্যই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে রান্না করে পরিমাণ বজায় রেখে খেলে যেকোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে সুস্থ থাকা সম্ভব।