বৃষ্টিভেজা বর্ষায় কিছু মৌসুমি ফলের দেখা মেলে। স্বাদ আর পুষ্টিগুণে এসব ফল বেশ সমাদৃত। এর মধ্যে লটকন, আমড়া আর পেয়ারা ছোট-বড় সবারই মন কেড়ে নেয়। জেনে নিন এই তিন ফলের গুণাগুণ:
লটকন: নানান ফলের ভিড়ে লটকনের গুণের কথা আজও অনেকের অজানা। লটকন একটি পুষ্টিকর ফল। এতে ভিটামিন ও খাদ্যশক্তিসহ নানারকম খনিজ উপাদান রয়েছে। বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ফারাহ মাসুদা বলেন, “লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। দিনে দুতিনটি লটকন খেলে শরীরের ভিটামিন সি’র চাহিদা পূরণ হয়।”
এছাড়াও রয়েছে নানা রকম পুষ্টি উপাদান যা শরীরকে সুস্থ রাখে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। রুচি বাড়াতে লটকন বেশ উপকারী। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে খাদ্যশক্তি আছে ৯২ কিলোক্যালরি। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে ভিটামিন সি আছে ১৭৮ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৬৯ মিলিগ্রাম, শর্করা ১৩৭ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১৭৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-১ ১৪.০৪ মিলিগ্রাম,
ভিটামিন বি-২ শূন্য দশমিক ২০ মিলিগ্রাম; আমিষ আছে ১ দশমিক ৪২ গ্রাম, লৌহ ১০০ মিলিগ্রাম, চর্বি শূন্য দশমিক ৪৫ গ্রাম আর খনিজ পদার্থ ৯ গ্রাম। এতে আছে ভিটামিন সি, থায়ামিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। ফলে লটকন খেলে মুখে ঘা হবে না। শরীর সুস্থ রাখতেও ফলটি বিশেষ কাজের। এর জলীয় অংশ রক্তশূন্যতা কমায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে।
এটি ত্বকের রুক্ষতা কমায়, শরীরে পানির সমতা ঠিক রাখে। লটকন খেলে বমির ভাব কমে, খাওয়ায় রুচি বাড়ে। মানসিক চাপ কমাতেও ফলটি বিশেষ কার্যকর। তৃষ্ণা নিবারণে লটকন অতুলনীয়। লটকনের নানারকম গুণ থাকার পরও একবারে বেশি লটকন না খাওয়ার পরামর্শ দেন ফারাহ মাসুদা। কারণ এতে করে অনেক সময় ক্ষুধা মন্দা দেখা দেয়।
আমড়া: অন্যান্য ফলের মধ্যে সুস্বাদু একটি হলো আমড়া। বাংলাদেশে পুষ্টিকর এই ফলটির দু’টি প্রজাতির চাষ হয়। দেশি আমড়া ও বিলাতি আমড়া। বিলাতি আমড়া দেশি আমড়ার মতো টক নয়। এটি খেতে টক-মিষ্টি স্বাদের। এতে শাঁস বেশি, আকারেও বড়। বিলাতি আমড়া কাঁচা খাওয়া হয়। বিলাতি ও দেশি দই’ধরনের আমড়া থেকেই সুস্বাদু আচার, চাটনি এবং জেলি তৈরি করা যায়।
তরকারি হিসেবে রান্না করেও আমড়া খাওয়া যায়। মুখে রুচি বৃদ্ধিসহ অসংখ্য গুণাগুণ রয়েছে আমড়া। গোল্ডেন আপেলখ্যাত আমড়ার বৈজ্ঞানিক নাম Stondia Dulcis। এটি Anacardiaceae পরিবারভুক্ত। প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী আমড়ায় যেসব পুষ্টি উপাদান রয়েছে, তা হলো শর্করা ১৫ গ্রাম, আমিষ ১ দশমিক ১ গ্রাম, চর্বি শূন্য দশমিক ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৫৫ মিলিগ্রাম, আয়রন ৩ দশমিক ৯ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৮০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি ১০ দশমিক ২৮ মিলিগ্রাম,
ভিটামিন বি-২ শূন্য দশমিক শূন্য ৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৯২ মিলিগ্রাম, অন্য খনিজ পদার্থ শূন্য দশমিক ৬ গ্রাম ও খাদ্যশক্তি ৬৬ কিলোক্যালরি। আমড়ায় প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি, আয়রন, ক্যালসিয়াম আর আঁঁশ আছে, যেগুলো শরীরের জন্য খুব দরকারি। হজমেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই তেল ও চর্বিযুক্ত খাদ্য খাওয়ার পর আমড়া খেয়ে নিতে পারেন; হজমে সহায়ক হবে। আমড়ায় প্রচুর ভিটামিন সি থাকায় এটি খেলে স্কার্ভি রোগ এড়ানো যায়। বিভিন্ন প্রকার ভাইরাল ইনফেকশনের বিরুদ্ধেও লড়তে পারে আমড়া। অসুস্থ ব্যক্তিদের মুখের স্বাদ ফিরিয়ে দেয়।
সর্দি-কাশি-জ্বরের উপশমেও আমড়া অত্যন্ত উপকারী। শিশুর দৈহিক গঠনে ক্যালসিয়াম খুব দরকারি। ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস এই আমড়া। শিশুদের এই ফল খেতে উৎসাহিত করতে পারেন। এছাড়া এটি রক্তস্বল্পতাও দূর করে। কিছু ভেষজ গুণ আছে আমড়ায়। এটি পিত্তনাশক ও কফনাশক। আমড়া খেলে মুখে রুচি ফেরে, ক্ষুধা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।
আমড়ায় থাকা ভিটামিন সি রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। খাদ্যে থাকা ভিটামিন এ এবং ই এটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে দেহকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত থেকে রক্ষা করে। দাঁতের মাড়ি শক্ত করে, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত, পুঁজ, রক্তরস বের হওয়া প্রতিরোধ করে আমড়া। এর ভেতরের অংশের চেয়ে বাইরের খোসাতে রয়েছে বেশি ভিটামিন সি আর ফাইবার বা আঁশ, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে করে দ্বিগুণ শক্তিশালী। আর আঁশজাতীয় খাবার পাকস্থলী (স্টমাক), ক্ষুদ্রান্ত, গাছহদন্ত্রের (পেটের ভেতরের অংশবিশেষ) জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।
পেয়ারা: স্থানীয় জনপ্রিয় ফল পেয়ারার এখন ভরা মৌসুম। যত্রতত্রই এখন সবুজ এই ফলটি পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানী শহরে দাম একটু বেশি হলেও গ্রামে গঞ্জে অনেক কম দামেই্ এটি কিনা যায়। পেয়ারা শুধু সুস্বাদু একটি ফলই নয়, পুষ্টিগুণেও ভরপুর এটি। পেয়ারা যে শুধু বাংলাদেশে জন্মায় তা বললে ভুল হবে। ১০০টিরও বেশি প্রজাতির এই ফলটি মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রভৃতি দেশে সবচেয়ে বেশি জন্মে।
দেশের বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, চট্রগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, রাঙ্গামাটি, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায় বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন জাতের পেয়ারার চাষ হচ্ছে। সবুজ এই ফলটিতে আঁশ, পানি, কার্বহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি খাদ্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে।
এছাড়া রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি ও খনিজ পদার্থ। তাহলে ইতোমধ্যে কিছুটা হলেও অাঁচ করতে পেরেছেন এই ফলটি খেলে নিশ্চয়ই লোকসান নয়, বরং লাভ-ই বেশি। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেয়ারা বেশ কার্যকর। রক্তসঞ্চালন ভালো রাখে। ফলে হার্টের রোগীরা এটি নিয়মিত খেতে পারেন। এতে ইনফেকশনরোধী উপাদান রয়েছে যা হজমক্রিয়া শক্তিশালী করে। অ্যাজমা, ঠাণ্ডা-কাশিতে কাঁচা পেয়ারার জুস বেশ উপকারী।
এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সময়ে সময়ে পেয়ারা খেতে পারেন। তাহলে দ্রুত মুক্তি মিলবে। ওজন কমাতে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এবং মুখের রুচি বাড়াতেও জুড়ি নেই পেয়ারার। তাই যারা পেটের সমস্যায় ভুগছেন তারা নির্দ্বিধায় এটি খেতে পারেন। ত্বক, চুল ও চোখের পুষ্টিও জোগায় পেয়ারা। পেয়ারাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ময়েশ্চার যা তারুণ্য বজায় রাখে র্দীঘদিন।
ত্বকের রুক্ষ ভাব দূর করে ও শীতে পা ফাটা রোধ করে। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সারের মতো কঠিন ও জটিল রোগ প্রতিরোধেও সহায়ক পেয়ারা। সবশেষে, বিশেষজ্ঞদের মত, একটি পেয়ারায় ৪টি কমলালেবুর সমান পুষ্টিগুণ বিশেষ করে ভিটামিন সি রয়েছে। তাই সম্ভব হলে প্রতিদিন ১টি করে আর না হলে সপ্তাহে অন্তত একটি করে হলেও প্রতিটি মানুষের পেয়ারা খাওয়া উচিত।