শৈল্পিক স্থাপত্য হিসেবে বিশ্বের অনেক মসজিদের খ্যাতি আছে। এ শৈল্পিক সৌন্দর্য শুধু বর্তমানের আধুনিক সময়ের জন্যই নয়, আদি যুগ থেকে চলে আসছে। নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে বিশ্বে শত শত বছরের পুরনো মসজিদ রয়েছে। এগুলো এখনও মানুষকে মুগ্ধ করে। এমন অনেক মসজিদের মধ্যে অন্যতম বিস্ময় হচ্ছে পৃথিবীর বুকে মাটি দিয়ে তৈরি মসজিদ।
মাটির তৈরি বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদটির অবস্থান আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলের ডিজেনি শহরে। মসজিদটির নাম ‘গ্র্যান্ড মস্ক অব জেনি’।
কাদামাটির তৈরি এই বিশাল আকৃতির মসজিদটি হাজার বছরের পুরনো, মালির অন্তর্র্বতী ছোট একটি গ্রাম জেনিতে এটি অবস্থিত। সবার কাছে ‘গ্রেট মস্ক অব জেনি’ নামেই এটি অধিক পরিচিত।
পশ্চিম আফ্রিকার একটি অনুন্নত কৃষিভিত্তিক দেশ মালি। খরা, মহামারি, অনাহার লেগেই আছে দেশটিতে। উল্লেখ করার মতো তেমন বিশেষ কিছু নেই এ দেশটিতে। তবে বিশেষ এই স্থাপনার কারণে দেশটি পুরো বিশ্বে পরিচিত।
১২০০ শতাব্দী থেকে ১৩০০ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মসজিদটি নির্মাণের পক্ষে অধিকাংশ মতের সমর্থন পাওয়া যায়। জানা যায়, সুলতান কুনবুরু ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তার প্রাসাদটি ভেঙে সেখানে এই মসজিদটি তৈরি করেন।
বানি নদীর তীরে অবস্থিত মসজিদটি ২৪৫ ফুট আয়তনবিশিষ্ট ৩ ফুট উঁচু কাঠামোর ওপর নির্মিত। তখন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী কোরআন শিক্ষার জন্য এই মসজিদে আসতেন।
মধ্যযুগে আফ্রিকার এই অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এই মসজিদ। প্রতি বছর স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্যোগে মসজিদটির সংস্কার কাজ চলে।
২০০৬ সালের ২০ জানুয়ারি মসজিদের ছাদের একটি অংশ এবং ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর এর দক্ষিণ দিকের মিনারের একটি অংশ ধসে পড়লে ‘দি আগা খান ট্রাস্ট কালচার’ নিজস্ব খরচে এটির সংস্কার করে। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো এই মসজিদটিসহ এর চারপাশের ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
মসজিদটি কবে, কখন এবং কীভাবে নির্মিত হয়েছিল সে সম্পর্ক ভিন্ন মত রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে ৮০০-১৩০০ শতাব্দীর মধ্যে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। জেনির ২৬তম শাসক কুনবুরুর হাতে এই মসজিদের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়।
কুনবুরুর যখন রাজা হন তখন ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। জেনির মানুষরা তখন ব্যাপক উৎসাহে গ্রহণ করে নেন তাদের প্রথম মুসলমান শাসককে।
তখন নতুন রাজা চিন্তা করেন তার প্রজাদের প্রার্থনার জন্যে একটি উপযুক্ত স্থান দরকার। যেখানে সৃষ্টিকর্তার জন্যে স্থান নেই সেখানে তিনি কী করে প্রাসাদে বাস করবেন? তিনি ঠিক করলেন তার প্রাসাদ ভেঙে সেই স্থানে মসজিদ নির্মাণ করবেন।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। গ্রামের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীকে ডেকে আনা হয়। সিদ্ধান্ত হয় মসজিদ তৈরিতে গতানুগতিক কাদামাটি এবং গ্রামের কাঁচামাল ব্যবহার করার।
মসজিদের দেয়াল অনেক উঁচু হবে বলে সেখানে তালগাছের কাঠ দিয়ে নকশা করা হয়; যা স্থানীয়ভাবে ‘টরল’ নামে পরিচিত। মাটির দেয়াল সহজে ধ্বসে না পড়ে সেজন্যই এ কাঠ ব্যবহৃত হয়।
মসজিদের পূর্ব দিকে রাজার জন্যে নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। এটি ছিল মসজিদের তুলনায় আকারে ছোট। পরবর্তীতে রাজার উত্তরাধিকারীরা এই মসজিদের সঙ্গে আরো দুটি মিনার নির্মাণ করেন এবং মসজিদের চারপাশে উঁচু করে দেয়াল তোলেন।
১৮২৭ সাল পর্যন্ত এই মসজিদ সম্পর্কে কোনো প্রকার লিখিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফরাসি পর্যটক রেনে কেইলি ১৮২৭ সালে মালি ভ্রমণের সময় এই মসজিদটি আবিষ্কার করেন।
তিনি মসজিদটির বিস্তারিত বর্ণনা ‘জার্নাল অব দ্য ভয়েজ টু টিম্বাকটু এন্ড জেনি’তে উল্লেখ করেন। তিনিই প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি মসজিদটি ধ্বংস হওয়া দেখেছিলেন।
প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, মসজিদের অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে নিয়মিত কাদা মাটির প্রলেপ দেয়ার প্রয়োজন হতো। তিনি ধারণা করেন, অনেক বছর অবহেলায় পড়ে থেকে মসজিদটির স্থায়ীত্ব কমে এসেছিল।
গবেষকদের মতে, ১৮৩৪-১৮৩৬ সালের দিকে প্রথম মসজিদের ভগ্নাবশেষের উপর দ্বিতীয় মসজিদটি তৈরি করা হয়। এর প্রমাণ হিসেবে ১৮৯৬ সালে ফরাসি সাংবাদিক ফেলিক্স ডুবইস মসজিদটির ভগ্নাবশেষের উপর একটি হাতে আঁকা ছবি প্রকাশ করেন।
সেখানে দেখানো হয় আকার ও আকৃতিতে দ্বিতীয় মসজিদের স্থাপনা প্রথম মসজিদের চাইতে অনেক বড়। পাশাপাশি দ্বিতীয় বার নির্মিত মসজিদটির মিনারের পাশাপাশি স্তম্ভের ব্যবহার করা হয়েছিল।
বর্তমানে মসজিদটির যে রূপ দেখা যায় তা মূলত এর তৃতীয় সংস্করণ। ১৯০৭ সালের দিকে এর কাজ সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মালি যখন ফরাসি উপনিবেশের অধীনে ছিল তখন ফরাসিরা এই মসজিদ পুনরায় নির্মাণ করেন। তবে এর পক্ষে কোনো যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, স্থানীয় রাজমিস্ত্রীরা সংগঠিত হয়ে গ্রামবাসীর সাহায্যে মসজিদটি পুনরায় নির্মাণ করতে সক্ষম হন।
বর্তমানে যে মসজিদটি দেখতে পাওয়া যায় তার মাঝে বেশ পরিকল্পিত স্থাপত্যশৈলীর ছাপ রয়েছে। মসজিদটির চারপাশ উঁচু মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মসজিদটির মাঝখানের চূড়াটি একটি উঁচু স্তম্ভের মতো দেখা যায়।
এর দেয়াল ও ছাদে অনেকগুলো ছিদ্র রাখা হয়েছে; যেন গ্রীষ্মকালে যথেষ্ট আলো-বাতাস পাওয়া যায়। এর বাইরের অংশের ৩টি উঁচু মিনার মসজিদটিকে অসম্ভব সুন্দর ছন্দময় দৃশ্য উপহার দিয়েছে। এতে মুসল্লিদের কথা চিন্তা করে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়।
বর্তমানে মসজিদটির সঙ্গে একটি শৌচাগার সংযুক্ত আছে। আরো আছে মহিলাদের জন্য নামাজের আলাদা স্থান। এছাড়াও মসজিদের বাইরের অংশে দুই জন ধর্মীয় নেতার সমাধি আছে।
মসজিদটিকে ঘিরে জেনি গ্রামের সচেয়ে বড় উৎসব ‘ক্রেপিসেজ দি লা গ্র্যান্ড মস্ক’ পালন করা হয়। বার্ষিক এই অনুষ্ঠানের জন্যে গ্রামের মানুষ অধির আগ্রহে অপেক্ষা করেন।
গ্রামের সবাই এতে আনন্দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে। তখন রাজমিস্ত্রী সংগঠন গ্রামের মানুষদের একত্রিত করে নাইজার এবং বানি নদী থেকে মাটি আহরণ করা শুরু করেন।
গ্রামবাসীরা গভীর আগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটি সংগ্রহের কাজে। এদিকে গান বাজনার দল গান গেয়ে সবাইকে বিনোদন দিতে থাকেন। আর গৃহস্থ মেয়েরা মাটির মিশ্রণ তৈরিতে পানি সরবরাহ করেন। এইভাবে কাদামাটির মিশ্রণ তৈরি করার পর মসজিদের দেয়াল জুড়ে প্রলেপ লাগানোর কাজ শুরু হয়।
গ্রামের বাসিন্দারা তাদের এই ব্যতিক্রমধর্মী মাটির মসজিদকে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করেন। উৎসবের সময়ে পর্যটকরা সবসময় চেয়েছে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাইরের সংস্কৃতির প্রভাব খাটাতে।
আবার অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী মসজিদটিকে কংক্রিটের মসজিদ করে দেয়ারও প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু জেনি সম্প্রদায় তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও এর ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসী।
তারা কোনোপ্রকার প্রলোভনের কাছে মাথা নত না করে এখনো সমুন্নত রেখেছেন বিশ্বের বৃহত্তম মাটির মসজিদটিকে। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো এই মসজিদ এবং মসজিদের চারপাশের গ্রামটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তভুক্ত করে।
মধ্যযুগে আফ্রিকার এই অঞ্চলটি বাণিজ্যিক পথ এবং এর বিস্তৃত সংস্কৃতির জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমানে গ্রামটিতে দেড় লাখের মতো মানুষ বাস করে, যার অধিকাংশই মুসলমান। অনেক কাল আগে থেকেই এ অঞ্চলটি ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল যার প্রধান কেন্দ্র ছিল এই মসজিদটি। অসংখ্য শিক্ষার্থী কুরআন শেখার জন্যে এই মসজিদে ভিড় করতেন। এখনো এই মসজিদে নিয়মিত কুরআন পাঠদান হয়।
কাদামাটির এ মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ মোটেও সহজসাধ্য নয়। জেনি গ্রামে রাজমিস্ত্রীদের সংগঠনটি পুরো গ্রামের মাটির ঘরবাড়ি তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকে।
এই সংগঠনের সদস্যরাই মূলত মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন। কিন্তু খুব বড় আকৃতির স্থাপনা হওয়ায় প্রায় সময় কিছু না কিছু মেরামত করতেই হয়। উপযুক্ত লোক এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাবে এই কাজ দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছে জেনিদের জন্য।
স্বাভাবিকভাবে এর সঙ্গে খরচের ব্যাপারটিও জড়িত। কিন্তু গ্রামবাসীর অদম্য ভালোবাসা এবং ধর্মীয় অনুভব মসজিদটিকে এখনো বিশ্বদরবারে সমুজ্জ্বল করে রেখেছেন।
তথ্য ইন্টারনেট