ফরমালিনের ব্যবহার চিকিৎসাবিজ্ঞানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে ফরমালিন এখন ভীতির প্রতিশব্দ। মাছ, ফল ও সবজি সংরক্ষণে এর অপব্যবহার ভোক্তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। জীবনরক্ষাকারী উপাদান আজ তাই জীবননাশকারী।
ফরমালিনের উপাদানঃ ৩০-৫০ শতাংশ ফরমাল ডিহাইড, ১০-২০ শতাংশ মিথাইল অ্যালকোহল (মিথানল) আর পানি- এই তিনের মিশ্রণে তৈরি হয় ফরমালিন।ফরমালডিহাইডের (রাসায়নিক সংকেত HCHO)। যা মর্গে মৃতদের সংরক্ষণে এটি ব্যবহৃত হয়।
এ ছাড়া ফরমালিন- * জীবাণুনাশক * ধোঁয়া দিয়ে অপারেশন থিয়েটার শোধন করা * পচনশীল দ্রব্য (ল্যাবরেটরির প্রাণীদেহ) দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। ফরমালিন যেভাবে মানবশরীরকে আক্রান্ত করে ফরমালিন ঝাঁজাল গন্ধযুক্ত তরল পদার্থ, এটি পরিপাকতন্ত্র, লিভার, কিডনি, হৃদযন্ত্র এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি সাধন করে। ফরমালিন বাষ্প নাকে গেলে অথবা ফরমালিনযুক্ত দ্রব্য হাত দিয়ে ধরলে সহজেই চোখ, নাক, ত্বক ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে।
চোখ, নাক, শ্বাসতন্ত্র: প্রতি মিলিয়ন অংশ বাতাসে মাত্র ০.৩ অংশ ফরমাল ডিহাইড থাকলেই চোখ, নাক ও শ্বাসতন্ত্র আক্রান্ত হতে পারে। এতে চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া, চোখ জ্বালাপোড়া করা, হাঁচি-কাশি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ফরমালিন চোখে লাগলে কর্নিয়া নষ্ট হয়ে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
পরিপাকতন্ত্র: ফরমালিনযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে পরিপাকতন্ত্রের দেয়ালে প্রদাহ হয়। রক্তবমি, পাতলা পায়খানা, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি ফরমালিন বিষক্রিয়ার উপসর্গ। ফরমালিনের বিষক্রিয়ার বিপরীতে কাজ করতে সক্ষম কোনো ওষুধ বা অ্যান্টিডট এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
রেচনতন্ত্র: ফরমালিন মানুষের কিডনি নষ্ট করে দেয়। ফুসফুস: দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রার ফরমালিন শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা তৈরি করে।
ত্বক: ফরমালিন ত্বকের তৈলাক্ততা নষ্ট করে দেয়। ফলে চামড়া শুকিয়ে যাওয়া, চামড়া ফেটে যাওয়া, চামড়ার প্রদাহ ইত্যাদি দেখা দেয়। ফরমালিন চামড়ার অ্যালার্জি তৈরি করে। এতে চামড়া লাল হয়ে যায়, চামড়ায় চুলকানি ও ফোসকা পড়ে।
জননতন্ত্র: মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর জননতন্ত্র এবং গর্ভধারণের ওপর ফরমালিনের কুপ্রভাব পরীক্ষিত হয়েছে। ফরমালিন বন্ধ্যাত্ব তৈরি করে। এটি অনৈচ্ছিক গর্ভপাত ঘটায়। এর প্রভাবে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ হতে পারে।
ক্যান্সার: ফরমাল ডিহাইড লিউকেমিয়া, লিম্ফোয়া এবং নাসারন্ধ্রের ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফরমাল ডিহাইডের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। ২০১১ সালের ১০ জুন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় টেক্সিকালজি প্রোগ্রাম ফরমাল ডিহাইডকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে বর্ণনা করে।
শিশুদের ক্ষেত্রে: ফরমাল ডিহাইড শিশুদের ক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্রের নিচের দিকে প্রদাহ এবং ইনফেকশন তৈরি করে।
ফরমালিনের গ্রহণযোগ্য মাত্রা: যুক্তরাষ্ট্রের অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড ফরমালিনের গ্রহণযোগ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছে ০.৭৫ পিপিএম (পার্ট পার মিলিয়ন) অর্থাৎ প্রতি মিলিয়ন অংশে ০.৭৫ অংশ এবং পনেরো মিনিট সময়কালের মধ্যে যা কোনোভাবেই ২ পিপিএম-এর বেশি গ্রহণযোগ্য নয়। ফরমালিনের কার্যকরী মাত্রা ০.৫ পিপিএম। মাত্র ৩০ মিলি ফরমালিন গ্রহণ করলে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
মাছে কেন ফরমালিন দেওয়া হয়: এক গ্লাস ফরমালিন এক বালতি পানিতে মিশিয়ে প্রায় ২৫০ কেজি মাছ কমপক্ষে চার দিন পচনের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। পক্ষান্তরে বরফ ওজনে ভারী, দামে বেশি। তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা পচনশীল দ্রব্য রক্ষার জন্য বরফের পরিবর্তে ফরমালিনকে বেশি পছন্দ করে থাকেন। আবার ফরমালিন মেশানো পানি দিয়ে বরফ তৈরি করা হয়। প্রকারান্তরে ফরমালিনের সংস্পর্শে যাদের দীর্ঘক্ষণ থাকতে হয়, তাদের এই বিষক্রিয়া বেশি হয়।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ফরমালিন দেওয়া এই মাছ বরফে রাখলে ২৮ থেকে ৩২ দিন একই রকম থাকে। অন্যদিকে হিমঘরে রুই মাছ ২০ থেকে ২৩ দিন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য অবস্থায় থাকে। ফরমালিন দেওয়া মাছে ১৬ দিন পরও তেমন ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় না। অন্যদিকে বরফ দেওয়া মাছে একই সময়ে প্রচুর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মাছে ফরমালিন দেওয়া হলে মাছ ধুয়ে, রান্না করে বা ভাজার পরও এর বিষক্রিয়ার তেমন কোনো তারতম্য ঘটে না। শরীরের কোষের ক্ষতির জন্য সামান্য পরিমাণ ফরমালিনই যথেষ্ট।
ফল, দুধ ও সবজির মধ্যে ফরমালিন: বিদেশি ফল যেমন আপেল, আঙুর, খেজুর, কমলা ও মাল্টা এবং দেশি ফল যেমন আম, জাম, কলা, লিচু, টমেটো ইত্যাদি সহজে পচে যায়। এসব ফলে ফরমালিন মেশানোর হার বেশি। তবে কিছু দেশি ফল (অবশ্যই ভিটামিনসমৃদ্ধ) যেমন সফেদা, আমলকী, আমড়া, বাতাবিলেবু, আখ ইত্যাদিতে বিষাক্তদ্রব্য মেশানোর হার এখন পর্যন্ত তুলনামূলক কম।
ফরমালিনযুক্ত ফল ও মাছ চেনার উপায়: প্রতিটি ফল প্রকৃতিগতভাবে সজীব, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর সজীবতা হ্রাস পায়। কিন্তু ফরমালিনযুক্ত ফল কিছুটা শক্ত, অনুজ্জ্বল এবং সময়ের ব্যবধানে এটি একই রকম থাকে। ফলের বর্ণে ও সুগন্ধে অনেক পোকা আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ফরমালিনযুক্ত ফলে মাছি, মৌমাছি, পিঁপড়া বসে না।
স্বাভাবিকভাবে মাছ সতেজ, চকচকে ও পিচ্ছিল হয়, ফরমালিনযুক্ত মাছে সজীবতা ও পিচ্ছিলতা কমে যায় এবং এটি শুষ্ক আকার ধারণ করে, স্বাভাবিক মাছে চোখ জ্বলজ্বলে হয়, কানকো লাল থাকে, ফরমালিনযুক্ত মাছে চোখ নির্জীব এবং কানকো কালচে বর্ণের হয়। একইভাবে ফরমালিনযুক্ত মাছে মাছি বসে না।
খাদ্যে ফরমালিন মেশানোবিষয়ক বড় ধরনের কোনো সমীক্ষা বাংলাদেশে নেই। তবে মনে করা হয় বিদেশ থেকে আমদানি করা ফল এবং বিদেশি রুই মাছে ফরমালিনের পরিমাণ বেশি।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন নামের একটি সংস্থার হিসাবে মতে, শতভাগ সেমাই ও টক ফল, ৯৫ ভাগ আঙুর, ৯১ ভাগ কলা, ৯০ ভাগ নুডলস, ৮২ ভাগ আম, ৭৭ ভাগ খেজুর, ৭৫ ভাগ টমেটো, ৬০ ভাগ বেগুন, ৫৯ ভাগ আপেল, ২০ ভাগ শসা ফরমালিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা বিষাক্ত।
বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপে বেশির ভাগ রুই মাছ এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মৃগেল, কাতলা ও ইলিশ মাছ ফরমালিনযুক্ত বলে দেখানো হয়েছে। সুপারশপে এবং ‘ফরমালিনমুক্ত’ ব্যানারেও বিক্রি হচ্ছে ফরমালিনযুক্ত মাছ, ফল ও খাদ্য। বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ রয়েছে। তার পরও খাদ্যে ফরমালিন মেশানো থেমে নেই। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত হচ্ছে বৃদ্ধ ও শিশুরা।
চিকিৎসা খাতে রাষ্ট্রের খরচ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, অথচ ফরমালিন আমদানি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যেত। আশার কথা, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ বিল ২০১৩ অগ্রগতির পথে। গণমাধ্যমে আলোচনা ও জনসচেতনতার পরিপ্রেক্ষিতে গত পাঁচ বছরে ফরমালিন আমদানিও অনেক কমেছে।
পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম। লিখেছেন ডা. মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ।