ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার কারণে কারো মৃত্যু ঘটলে, সাধারণ জনগণ প্রতিবাদ করতেই পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা তা ভালোভাবে নেন না! প্রতিবাদকারীদের ‘মুর্খ’ বলে অপমান করেন অনেক চিকিৎসক। মেনে নিলাম আমরা ‘মুর্খ’ মানুষ। আমাদের জ্ঞানের অভাব। তাই আমরা আপনাদের মতো ‘ডাক্তারি’ পড়ে ‘জ্ঞানী’ হতে পারিনি।
বিশ্বাস করি দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের একাংশই চিকিৎসাবিদ্যা অর্জনের সুযোগ পান। তাইতো আমরা সাধারণ জনগণ মহান আল্লাহর পর রোগীর সংকটময় মুহূর্তে এই ‘দ্বিতীয় ঈশ্বর’ এর দিকেই করুণভাবে তাকিয়ে থাকি পরম বিশ্বাসে। সেই মুহূর্তে তো আর করার কিছুই থাকে না। তাঁদের একটু সহানুভূতি, সহমর্মিতা, একটু ভালো ব্যবহার পেলে রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যান। বাকি অর্ধেক সুস্থতা নিয়মমাফিক সঠিকভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু কিছু চিকিৎসক দায়িত্বে অবহেলা করে ভুল চিকিৎসা করেন। তাঁদের অবহেলার কারণে স্বজন হারিয়ে আমরা যখন প্রতিবাদ করি তখন তা চিকিৎসকেরা ভালো চোখে দেখেন না।
তাঁদের চোখে আমরা ‘মুর্খ’ হয়ে যাই। আর কতিপয় চিকিৎসক তাঁদের ‘হয়রানি করা হচ্ছে’ বলে উল্টো অভিযোগ করেন। এর প্রতিবাদে পালন করেন কর্মবিরতি। বন্ধ করে দেওয়া হয় চিকিৎসাসেবা। জিম্মি করা হয় আমাদের মতো অসহায় মানুষদের। সভ্য সমাজে রোগী জিম্মি করে দাবি আদায় করা কখনো চিকিৎসকদের কাজ হতে পারে না। নিজের চরম সংকটের মুহূর্তেও আগে রোগীর সেবাপ্রদান করাই ডাক্তারের ধর্ম হওয়া উচিৎ। এমনকি তাঁর চরম শত্রুকেও।
অথচ ঘটছে ঠিক এর উল্টো। আজকাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কম সময়ের মধ্যে বেশি রোগী দেখার কারণে তাড়াহুড়ো করে ট্রিটমেন্ট দিচ্ছেন অনেকে। মন দিয়ে রোগীর কথা শুনছেন না বা রোগীর কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ হয়ে যায়! একই সময়ে একসাথে তিন-চারজন রোগীকে এককক্ষে ঢুকিয়ে একজনের সামনে অপরজনদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
যেখানে রোগীর প্রাইভেসির কোনো মূল্য দেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করেন না চিকিৎসকেরা। একজন মানুষ তাঁর সমস্যার সকল সিক্রেট বিষয় ডাক্তারের সাথে শেয়ার করতে চান। কিন্তু বড় বড় ডাক্তাররা যদি এভাবে চিকিৎসা করেন তবে মূল্যবোধসম্পন্ন রোগী দ্বিতীয়বার সেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করতে বাধ্য।
তাছাড়া অপারেশন কন্ডিশনের রোগীদের পেলে তো কোনো কোনো চিকিৎসক মহাখুশি! তাঁরা এমনভাবে ভড়কে দেন, বলেন দ্রুত অপারেশন না করালে রোগীর খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করিয়েই দ্রুত অপারেশনটা করাতে পারলে কামাইটা ঝামেলাহীনভাবে করা যায়! রোগী বাঁচলো না মরলো সেটা মুখ্য নয় অনেকের কাছে। অনেক ডাক্তার প্রতিদিন গড়ে ৯০ থেকে ১০০ জন রোগী দেখে থাকেন।
শুধু তাই নয়, পুনরায় সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও কেউ কেউ যথেষ্ট পরিমাণ ফি আদায় করেন। পাশাপাশি রোগীদের সাথে কোনো ডাক্তারের দুর্ব্যবহার এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, এটা তাঁদের একটা বদভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এভাবে রোগীদের অবহেলা করে তাঁরা শুধু চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন না, এতে ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে প্রচণ্ড আস্থার সংকট তৈরি করছেন। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে কিছু ডাক্তারের গ্রহণযোগ্যতা।
যুক্তরাজ্যের ১৭০ বছরের পুরনো মেডিক্যাল জার্নাল ‘বিএমজে’ গত বছর শেষ নাগাদ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে একজন ডাক্তার গড়ে ৪৮ সেকেন্ড রোগীর জন্য সময় দেন। যেখানে উন্নত বিশ্ব সুইডেন, নরওয়ে, আমেরিকার ডাক্তাররা গড়ে প্রায় ২০ মিনিট করে সময় দিচ্ছেন। রোগের চিকিৎসাক্ষেত্রে, ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থাটাই সবচেয়ে বেশি থাকা প্রয়োজন।
আমাদের বিশ্বাস, কোনো ডাক্তারই চাইবেন না তাঁর রোগী মারা যাক, রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করবেন। তাই একজন ডাক্তার কোনো ইনজেকশন পুশ করার আগে এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে রোগী বা স্বজনদের অবহিত করবেন। রোগীর সাথে বোঝাপড়াটা এ ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। কেননা একই ইনজেকশনে রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে আবার মারাও যেতে পারে।
কারণ এ ধরনের জটিল চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের দায় রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বললে হবে অপারেশনের সময় রোগীর বা স্বজনের কাছে থেকে স্বাক্ষর নিতে হয়। এ সময় রোগী মারা গেলে চিকিৎসক দায়ী থাকবেন না-মর্মে মুচলেকা নেওয়া হয়। তাই একজন ভালো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সেবা হওয়া উচিৎ সেরকমই।
এদিকে চিকিৎসা বা চিকিৎসকের ভুল ছাড়াও অনেকসময় দেখা যায়, ভেজাল ওষুধের কারণেও রোগী মারা যান। আরেকটি জরুরি বিষয়, আইনে ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসার জন্য কোনো ‘শাস্তি’ নেই। কিন্তু অবহেলার জন্য শাস্তি আছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক বর্তমান সময়ে। যেকোনো ভুল চিকিৎসা প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
চোর-ডাকাত-অপরাধীরা যেভাবে শাস্তি পায়, ভুল চিকিৎসার জন্য দায়ী ডাক্তারকেও সমানভাবে শাস্তি পেতে হবে। পাশাপাশি লাইসেন্সহীন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোর বিষয়ে সোচ্চার থাকতে হবে। এ মৃত্যুকূপগুলোর বিষয়ে সচেতন না হলে সেখানে শুধু ডাক্তারদের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।
ভুল-ভ্রান্তিগুলো সংশোধন করলে এদেশের মানুষদের আবারও চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা ফিরে আসবে এবং রোগীদের দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যেতে হবে না। আর দেশের রাজস্বও হারাতে হবে না। রাইফা মামণি, সোনামণি আমার, তুমি মরে গিয়ে বেঁচে গেছো মা। আর আমরা বেঁচেই মরে আছি। আমাদের হাত-পা বাঁধা। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে তামাশা দেখছি। তবে সুখবর হলো, মৃত্যুকূপগুলোতে অভিযান চালিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
কিন্তু এ অভিযানের প্রতিবাদে বৃহত্তর চট্টগ্রামে সব বেসরকারি হাসপাতালে অনির্দিষ্টকালের জন্য চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন মালিকরা। অনেক ভালো ডাক্তার যাঁরা সত্যিকার অর্থে সেবক তাঁরা ভেতরে ভেতরে এ অরাজকতার বিরুদ্ধে। কিন্তু নিরুপায় তাই ওই ভালো ডাক্তারও বাধ্য হয়ে ওই দলে শামিল হয়েছেন। ডাক্তারদের মতো উঁচু মানের পেশার ব্যক্তিরা এত অসহনশীল আচরণ করলে মানুষ কোথায় যাবে!
রাইফা, তুমি কি ওপারে কাঁদছো মা! তোমার মতো এক রাইফাকে মেরেও ক্ষান্ত হচ্ছে না ওঁরা। মনে হয় পুরো দেশের মানুষকে মেরে ফেলতে পারলে ওরা বেশি খুশি হবে। আর সহ্য হয় না। হৃদয়টা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ভুল মানুষেরই হয়। ডাক্তারও মানুষ। কিন্তু কিছু ডাক্তার ‘দানব’ এর ভূমিকা পালন করছেন। ভুল স্বীকার করে ক্ষমা না চেয়ে উল্টো সাধারণ মানুষদের ‘মুর্খ’ বলছে। তাঁরা সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে অরাজকতা সৃষ্টি করছেন। মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের কোনো কর্মসূচি চিকিৎসকদের কাছ থেকে কাম্য নয়। এটা সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
রাইফা, খুব কষ্ট হয় তোমার মৃত্যুর পর কোনো ডাক্তার বলেননি, ‘আমরাও তো মানুষ, আমাদেরও তো ভুল হতে পারে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যাঁরা অপরাধী তাঁদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।’ ওঁরা কি ভুলে গেছে, ওঁদের শপথ বাক্য...! চিকিৎসা পাওয়া সংবিধানের মৌলিক অধিকার। এটা ব্যাহত হলে আইন অনুযায়ী আরো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটা কি তাঁরা ভুলে গেছেন।
মা, মানুষ মাত্র ভুল করে। তোমার চিকিৎসকরাও মানুষ। তাই ওঁদেরও ভুল হয়েছে। পারলে তুমি তাঁদের ক্ষমা করে দিও। কিন্তু ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার কারণে এই সুন্দর পৃথিবীতে তোমাকে যাঁরা থাকতে দিলেন না তাঁদের কৃতকর্মের দায়ভার বা অভিশাপ অন্য ভালো চিকিৎসকদের ওপর যেন না বর্তায়। শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে গিয়ে কোনো অসহায় যেন বলির পাঁঠা না হয়! আমরা চাই ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুবরণকারী শিশু রাইফার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আর কোনো নিরপরাধ যেন এতে বলির পাঁঠা না হয়। এতে রাইফার আত্মা কষ্ট পাবে।