এই মহাজ্ঞানী ডাক্তার বাবুদের লইয়া কী করিবে জাতি?

আমাদের দেশে এখনো মানুষ চিকিৎসককে ‘ডাক্তারবাবু’, ‘ডাক্তারসাব’, ‘ডাক্তারসাহেব’ বলেই ডাকে। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণেই তাদেরকেই সর্বোচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র ও মার্জিত শ্রেণির পেশাজীবী হিসেবে দেখা হয়। হয়তো পেশাটি জন্মমৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত বিধায় জনমনে তা ঈশ্বরতুল্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই চিকিৎসকরা এখন নিজেরাই নিজেদের ঈশ্বর ভাবতে শিখে গেছেন।

একটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠায় গোটা চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে অনির্দিষ্টকালের জন্য সেবা বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক দেশে চিকিৎসকদের মাঝেই এমন স্বৈরাচারী মানসিকতার একটি গোষ্ঠী বেড়ে উঠছে আমরা কেউই তা খেয়ালই করেনি।

চট্টগ্রামে সাংবাদিক কন্যা রাইফার মৃত্যুতে সিভিল সার্জন গঠিত তদন্ত কমিটি হাসপাতাল ও চিকিৎসকের অবহেলায় শিশু রাইফার মৃত্যু হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে। বিধি অনুযায়ী হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এই তদন্ত কিন্তু কয়েকজন চিকিৎসকই করেছেন কোনো সাংবাদিক নয়। গতকাল র‌্যাব অভিযান চালিয়ে হাসপাতালটিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে, সেখানেও কিন্তু ১১টি ত্রুটি খুঁজে বের করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিনিধিদল সাংবাদিক কিন্তু না।

কিন্তু এর প্রতিবাদে পুরো একটি দিন অভিযুক্ত হাসপাতালটির মালিক প্রাইভেট হসপিটাল অ্যান্ড ল্যাব ওনারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে চট্টগ্রামে সব বেসরকারি হাসপাতালে সেবা বন্ধ রাখলেন। বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার এই তত্ত্বে বিশ্বাসীদের রোগী জিম্মি করে ক্ষমতা দেখানোর এই পুরনো স্টাইল আরও কত দিন চলবে তা জানি না। তবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণে চিকিৎসাসেবা অধিকার হরণ করা গুটিকয়েক ব্যক্তির চরম ধৃষ্টতা দেখার সৌভাগ্য হলো।

এর প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন, ‘কতিপয় দুর্বৃত্তের কর্মকাণ্ডের কারণে দেশে ডাক্তারি পেশা দুর্বৃত্তের পেশায় পরিণত হয়েছে, নিজেদের ভুল ঢাকতে ধর্মঘট ডাকা আরও বেশি অন্যায়’ তাই আদালত এ ধরনের পরিস্থিতি কমিয়ে আনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদকে নির্দেশনা দেন। কিন্তু মানবতার এই মহান সেবকরা কি আইন আদালতের আদৌ তোয়াক্কা করেন? প্রশ্ন কিন্তু থেকে যাচ্ছে। অদ্ভুত একটি সিস্টেমের মাঝে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। ভুল চিকিৎসা হলে কোনো মামলা করা যাবে না। এ পর্যন্ত পর্যন্ত মাত্র একটি মামলা হয়েছে, যা এখনো পর্যন্ত ঝুলে আছে। তাহলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে নালিশ জানাবে কোথায়?

এমন প্রশ্নের উত্তরে গতকাল একাত্তর টিভির লাইভে স্বাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান জানালেন, তাদের সংগঠন বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি রয়েছে সকল অভিযোগ শোনার জন্য। কিন্তু পরে জানলাম বিএমডিসিতে ২০১০ সালের পর এ পর্যন্ত মাত্র ৪৩টি অভিযোগ এসেছে। আর স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থা এখন পর্যন্ত মাত্র একজন চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডাক্তার দায়মুক্তি পেয়েছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে তিরস্কার বা সতর্ক করা হয়েছে।

দারুণ একটি বিচারালয়। মূলত দেশে রোগীর স্বার্থ সংরক্ষণের আইনি ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। কোর্টে গেলে হয়তো প্রচলিত আইনে কিছু ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু এটা খুবই দীর্ঘসূত্রতা এবং প্রমাণ করা খুবই কঠিন কারণ চিকিৎসকের ভুল একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই ধরতে পারেন। আর ওনাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হোক এটা চিকিৎসক সমাজও চান না। তাহলে প্রতিকার কী?

কেউ কেউ মুখস্ত বলেন ‘রোগীর তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা ভয়াবহ রকমের কম, এত রোগীর ভার বইতে গিয়ে চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয় এক্ষেত্রে কিছু ভুল হতেই পারে, তারা যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারাও তো মানুষ’। আমিও তাই ভাবতাম কিন্তু দেশে চিকিৎসকের চাহিদা ও জোগান নিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) শেষ জরিপ দেখে সেই ভুল অনেকটাই ভেঙেছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এবং চিকিৎসক ও জনসংখ্যা অনুপাতের ভিত্তিতে সরকারি সংস্থাটি দেখিয়েছে, এখনই চাহিদার অতিরিক্ত চিকিৎসক রয়েছে দেশে। আগামীতে এ উদ্বৃত্ত আরও বাড়বে। গবেষণাটি তৈরিতে দেশে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে বিশ্বব্যাংক নিরূপিত ১ দশমিক শূন্য ১১ শতাংশ। প্রতি ২৬২২ জন মানুষের জন্য চিকিৎসক ধরা হয়েছে একজন।

গবেষণা বলছে, ২০১৬ সালে ১৬ কোটি মানুষের জন্য দেশে চিকিৎসকের চাহিদা ছিল ৬৩ হাজার ৩৯৫ জন। এর বিপরীতে জোগান ছিল ৭৪, ৯২৪ জন চিকিৎসকের। এ হিসাবে ২০২১ সালেই চাহিদার অতিরিক্ত চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৩, ৪০২ জন। এছাড়াও বর্তমানে চিকিৎসকদের দেশের বাহিরে যাওয়ারও প্রবণতা কমে গেছে। বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৬ সালে ৬৮ জন চিকিৎসক দেশের বাইরে গেলেও ২০১৭ সালে সে সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে ২৩ জনে। বাইরে যাওয়ার সুযোগ কমে আসার ফলে দেশের মধ্যে অতিরিক্ত চিকিৎসকের চাপ আরও বাড়বে।

অবশ্য খুশি হওয়ার খুব একটা কারণ নেই, নতুন চিকিৎসকদের বেশির ভাগই মানহীন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে বের হওয়া, যাদের চিকিৎসা দানের যোগ্যতা ও মান নিয়ে খোদ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরাই বেশ চিন্তায় আছেন। এই বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সার্টিফিকেটধারীদের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও চাকরি পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, বা নিজস্ব চেম্বার দিয়ে বসলেও রোগী আসছে না।

এই পেশায় এমন অনেক জটিলতা আছে, চিকিৎসক নেতাদের উচিত ব্যবসা এবং সাংবাদিক হটাও আন্দোলন থেকে সরে এসে এই জটিলতাগুলোর সমাধানে সরকারের সঙ্গে দেনদরবারে বসা। কিন্তু নেতারা আছেন ডাক্তার থেকে রাজনৈতিক রূপধারণে ব্যস্ত। কয়েক দিন আগে অভিযুক্ত ডাক্তারদের থানায় নিয়ে আসার কারণে চট্টগ্রাম ডাক্তারদের একজন নেতা রাজনীতিবিদ স্টাইলে থানায় বসে হুমকি-ধামকি দিলেন,

সাংবাদিকদের সন্তানদের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করার ঘোষণা দিলেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কথায় কথায় চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেয়ার এই লাইসেন্স চিকিৎসকদের কে দিয়েছে? স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি নাকি ভ্লাদিমির পুতিন। স্পষ্টত আইনে বলা আছে, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার আছে, এ অধিকারের ব্যতয় ঘটলে উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কিন্তু কে শুনে কার কথা। এই তোলপাড়ের মাঝে কিছু কাঁচা চুলের চিকিৎসক সোশ্যাল মিডিয়ায় মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় বিভিন্ন লজিক দিয়ে বিষয়টি জাস্টিফাই করার চেষ্টা করলেন। মাছি মারা কেরানী টাইপ বিদ্যা জাহির করে সাংবাদিকদের ঢালাওভাবে অশিক্ষিত মূর্খ বলে গালাগালি করলেন। আমি বুঝি না এই তরুণ ডাক্তারদের পাঠ্যসূচিতে কী ‘সাংবাদিক ঠেকাও’ বিষয়ক কোনো কোর্স আছে?

তাহলে তারা এ বিষয়ে এত এক্সপার্ট কীভাবে। ওরা তো ডাক্তারি বিদ্যার থেকেও বেশি মুখস্থ করে ‘হলুদ সাংবাদিক’ ‘হলুদ সাংবাদিক’… তাদের কথা শুনলে মনে হয় চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসার অধিকার দিতে হবে, প্যাথলজি টেস্টের নামে যাচ্ছেতাই করার অধিকার দিতে হবে, চিকিৎসকদের ফেরেস্তাসম ভাবতে হবে যাদের কোনো দোষই দোষ বলে বিবেচ্য হবে না।

অন্যথায় চিকিৎসকরা মানুষের চিকিৎসা করা বন্ধ করে দেবেন। শুধু বইয়ের মুখস্থ পড়া প্রেসক্রিপশনে উগরে দেয়া মানেই চিকিৎসা নয়, কাঁচা চুলের ডাক্তারদের রোগীর মনস্তত্ত্ব বোঝারও জ্ঞান থাকতে হবে। মেডিকেল শিক্ষা কারিকুলামে বিহেভিরিয়াল সায়েন্স এবং সোশ্যাল সায়েন্স বিষয়াবলি কি অন্তর্ভুক্ত করা আছে? বা বিচ্ছিন্নভাবে থাকলেও তা কি পর্যাপ্ত? বা বর্তমান দেশের মেডিকেল শিক্ষা এই হবু ডাক্তারদের সামাজিকীকরণে কতটা ভূমিকা রাখছে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি হয়ে পড়েছে।

নচিকেতা নিশ্চয়ই এমন কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়ে রাগ করে লিখে ফেলেছিলেন ‘কসাই জবাই করে প্রকাশ্য দিবালোকে ওদের আছে ক্লিনিক আর চেম্বার, ও ডাক্তার’। প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই উপমা নিয়ে আমার আগেও আপত্তি ছিল এখনো আছে। বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বা গুটি কয়েকের জন্য গোটা একটি পেশাকে বাজেভাবে উপস্থাপন অনুচিত। কারণ এই পেশাতে দেবতুল্য মানুষেরও অভাব নেই। কিছু ব্যবসায়িক, রাজনীতিবাজ চিকিৎসকদের জন্য গোটা পেশাটিই জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে। প্রতিটি পেশায় ভুল হতে পারে।

তবে যদি কোনো চিকিত্সক ভুল করেন তাহলে ভুলের পরিমাণটি জনগণের টলারেন্স সীমা অতিক্রম করে, কারন বিষয়টি মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। হাসপাতাল বন্ধ করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। রোগীকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্ন ঘটনায় চিকিৎসকরা হয়তো লাঞ্ছিত হন কিন্তু সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা তো খুনই হয়ে যান কই এর প্রতিবাদে একদিনও তো দেশের সংবাদমাধ্যম বন্ধ থাকেনি।

চিকিত্সক নেতাদের উচিত এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতাল বন্ধ করার পুরনো স্টাইল থেকে বেরিয়ে এসে অন্য কোনো প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে বের করা বা জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা। অন্যথায় তারা জনসম্পৃক্ততা হারাবেন, জনগণের বিরুদ্ধেই দাঁড়াবেন আর জনগণের বিরুদ্ধে যেই হোক না কেনো তার বিরুদ্ধে অবশ্যই অবিচল দাঁড়িয়ে থাকবে সাংবাদিক সমাজ।

শেয়ার করুন: