শরীরে ঘামের দুর্গন্ধ মানুষকে অস্বস্তি এবং বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। আমাদের শরীরে দুই ধরনের ঘাম নিঃসরণকারী গ্রন্থি থাকে, ‘এক্রিন’ এবং ‘অ্যাপোক্রিন’। ‘এক্রিন’ গ্রন্থি আমাদের পুরো শরীরে ছড়িয়ে আছে যা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত ঘাম লবণ আর পানির মিশ্রণ, যার কোনো গন্ধ নেই। অপরদিকে ‘অ্যাপোক্রিন’ গ্রন্থি থাকে চুলের গোড়া, বগল এবং মাথার ত্বকে। এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত ঘন ঘাম হলো প্রোটিন এবং লিপিডের মিশ্রণ। ব্যাকটেরিয়া এই গ্রন্থির সংস্পর্শে এলে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায়। এই বিক্রিয়ার বাজে গন্ধ থেকেই শরীরের দুর্গন্ধ হয়। আজ শরীরে দুর্গন্ধ হওয়ার বিভিন্ন কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো-
ঘামে দুর্গন্ধ হওয়ার কারণ: ওজন: স্থূলকায় মানুষের শরীরে দুর্গন্ধ হতে দেখা যায় তুলনামূলক বেশি। এর কারণ হলো মোটা মানুষের সব কাজেই পরিশ্রম বেশি হয়। আবার পুরু চামড়ার স্তরে অনেক সময় ঘাম আটকে থাকে, যা ব্যাকটেরিয়া বিস্তারে সহায়তা করে।
মানসিক চাপ: অবাক লাগলেও সত্যি কথা হচ্ছে, মানসিক চাপে থাকলে ঘাম বেশি হয়। আর মানসিক চাপগ্রস্ত অবস্থায় ‘অ্যাপোক্রিন’ গ্রন্থি থেকে ঘাম নির্গত হয়, ফলে শরীরে দুর্গন্ধ হয়।
ফিশ ওডোর সিনড্রোম: দুর্লভ একটি রোগ এই ‘ফিশ ওডোর সিনড্রোম’, যেখানে মানুষের শরীর থেকে মাছের গন্ধ বের হয়। ধারণা করা হয়, জিনগত সমস্যা এই রোগের কারণ। এই দুর্গন্ধ রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস, মূত্র এবং ঘামকেও প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, সুগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরের দুর্গন্ধ কমানো সম্ভব।
রোগ ও ওষুধ: বিভিন্ন শারীরিক রোগ এবং কিছু ওষুধের কারণেও শরীরে দুর্গন্ধ হতে পারে। যেমন- হতাশা নিয়ন্ত্রক ওষুধ সেবনের কারণে শরীরে অদ্ভুদ গন্ধ হতে পারে। আবার পাকস্থলী ও যকৃতের সমস্যা, ডায়াবেটিস থেকে ত্বকে অতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়ার বিক্রিয়া থেকে শরীরে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ত্বক পরিষ্কার রাখা এবং ঘাম এড়ানোর জন্য ত্বকে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে এমন পোশাক পরা জরুরি।
খাবার: পেঁয়াজ, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদিতে থাকা ‘সালফার’ উপাদান ‘এক্রিন’ গ্রন্থির ওপর বাজে প্রভাব ফেলে। ফলে এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত ঘামেও গন্ধ হয়। তবে এই গন্ধ বেশিক্ষণ থাকে না।
শরীরে ঘামের দুর্গন্ধ প্রতিরোধে করণীয়: * আর্ম পিট পরিষ্কার রাখুন – প্রতিদিন anti-bacterial সাবান দিয়ে পরিষ্কার করুন। এতে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ কম হবে আর ঘামও কম হবে। ফাইনাল ফলাফল শরীরে ঘামের দুর্গন্ধ কম হবে। * আর্ম পিটের লোম পরিষ্কার রাখুন, বগলের লোম জমে থাকা ঘামকে বাস্পীভূত হতে দেয় না, ব্যাকটেরিয়া অনেক সময় ধরে দুর্গন্ধ তৈরি করে। তাই নিয়মিত আর্ম পিট ওয়াক্স করুন।
* diodarent ত্বককে আরও বেশি এসিডিক করে তোলে, যা ব্যাকটেরিয়ার জন্য অগ্রহণযোগ্য অবস্থা। Antiperspirant গ্লান্ডের sweating কার্যকারিতাকে বন্ধ করে দেয় ফলে শরীরে কম ঘাম হয়। * প্রতিদিন অন্তত একবার গোসল করুন। মনে রাখবেন, গরম পানি শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে আর যদি আবহাওয়া গরম থাকে তাহলে চেষ্টা করবেন কয়েকবার গোসল করে নিতে।
* ন্যাচারাল ফাইবার যুক্ত কাপড় পরিধান করুন – সিল্ক, সুতি জাতীয় কাপড় ত্বককে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে দেয়। ফলে ঘাম সহজে বাস্পায়িত হতে পারে। * পায়ে ঘামের দুর্গন্ধ থাকলে জুতা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সবার সামনে নিজেকে কী বিব্রতকর অবস্থাতেই না পড়তে হয়। তাই প্রতিদিন অন্তত একবার হালকা গরম পানি দিয়ে পা ধুয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন। আগেই বলেছি, গরম পানি ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে।
* চামড়ার জুতা পায়ের ঘাম বাস্পীভূত হতে সাহায্য করে। পর পর দুইদিন একই জুতা পরবেন না, কারণ জুতার ভেতরের ঘাম শুকানোর জন্য এক রাত যথেষ্ট না। * লেবুর সাথে মধুর সংমিশ্রণ ঘামের দুর্গন্ধ প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান ঘরোয়া উপায়। খুবই সিম্পল, একটি বাটিতে হালকা গরম পানি নিন, তাতে ২ টেবিল চামচ মধু আর ৩ টেবিল চামচ লেবুর রস নিন। তারপর আপনার যেসব স্থান ঘামে সে সব জায়গায় এই সলিউশন দিয়ে রিন্স করে নিন। তারপর শুকনো তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেলুন। লেবু শরীরে ঘামের পরিমাণ কমিয়ে আনে।
* আপনি শুনে হয়তো অবাক হবেন যে, ভিনেগার অতিরিক্ত ঘামের পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনে। রাতে ঘুমানোর আগে ভিনেগার আপনার আর্ম পিটে লাগিয়ে ঘুমান আর সকালে উঠে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে নিয়মিত করতে থাকলে আস্তে আস্তে আপনি ঘামের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন।
* গরম পানির সাথে নিম এক্সট্রাকট ব্যবহার করুন। নিম এক্সট্রাকট একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী। যা শরীরের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। একটি বাটিতে ফুটন্ত গরম পানি নিয়ে তাতে কিছু নিমের পাতা ছেড়ে দিন। তারপর অপেক্ষা করুন ২০ মিনিট। এই কয় মিনিটে নিম পাতা থেকে সমস্ত নির্যাস বের হয়ে যাবে আর পানিও একটু ঠাণ্ডা হয়ে আসবে। এবার শুকনো তোয়ালে এই পানিতে ডুবিয়ে আপনার যেসব স্থান ঘামে সেসব স্থান মুছে নিন।
* গোসল করার আগে বালতিতে কিছু পুদিনা পাতা বা কয়েক ফোঁটা গোলাপ পানি দিন। তারপর ওই পানি দিয়ে গোসল করুন। এতে তাৎক্ষণিকভাবে আপনার শরীর dioderize হবে। * সব সময় নিজেকে শুকনো রাখার চেষ্টা করুন। গোসল করার পর ভালোভাবে শরীর শুকিয়ে ভালো মানের diodarent ব্যবহার করুন। * ডায়টেশিয়ানের মতে সালফিউরিক সম্মৃধ খাবার যেমন ব্রকলি, বাধাকপি, ফুলকপি পরিমাণে কম খেতে হবে। কারণ এগুলোতে মিনারেল সালফার থাকে যা গন্ধযুক্ত গ্যাস আমাদের ত্বকের সাহায্যে নির্গত করে।
ওপরের সাধারণ প্রাকৃতিক উপায় আর টিপস আপনাকে মুক্তি দিবে সকল বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে আর আপনিও থাকবেন প্রতিনিয়ত ক্লিন, ফ্রেশ। তাহলে কীভাবে শরীরে ঘামের দুর্গন্ধ দূর করবেন এই ব্যাপারে আর কোনো সংশয় থাকার কথা না।