মেসি-ম্যারাডোনার দেশে কেমন আছে মুসলমানরা

আটলান্টিকের পাড়ে অবস্থিত ফুটবলের দেশ আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র। উত্তরের নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে দক্ষিণের মেরু উপদেশীয় অঞ্চল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার বিস্তার। এর মোট আয়তন ২৭ লাখ ৮০ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এর আশপাশজুড়েই রয়েছে রুক্ষ আন্দেস পর্বতমালা ও তার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আকোনকাগুয়া।

আর্জেন্টিনায় মুসলমানদের আগমন লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের মতোই। একসময় স্প্যানিশ উপনিবেশ ছিল আর্জেন্টিনা। তখন বহুসংখ্যক কালো আফ্রিকানদের দাস হিসেবে আনা হয় আর্জেন্টিনায়। এর মধ্যে ছিল আফ্রিকার দেশ মরক্কোর বহু মুসলিম বাসিন্দা। তাদের হাত ধরেই ইসলামের আগমন ঘটে এই দেশে। এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সময় আরব দেশ তথা বর্তমান লেবানন ও সিরিয়া থেকে অনেকে অভিবাসী পাড়ি জমান লাতিন আমেরিকার এই দেশটিতে।

মূলত ওসমানি খেলাফতের পতনের পর প্রায় সাড়ে ৩ লাখ আরব অভিবাসী আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে অধিকাংশ ছিল আরব-খ্রিস্টান। এছাড়া কিছু মিজরাহি গোত্রীয় ইহুদি ও সংশয়বাদী ইহুদিও ছিল। পাশাপাশি অনেক মুসলিম আরবও তখন আর্জেন্টিনায় আশ্রয় গ্রহণ করে। আনুমানিক প্রায় ১ লাখ মুসলিম তখন আর্জেন্টিনায় অভিবাসী হয়।

বর্তমানে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করে আর্জেন্টিনায়। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এই দেশটির দ্বিতীয় প্রধান ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। পর্যায়ক্রমে দেশটির ধর্মীয় হার-রোমান ক্যাথলিক : ৯২ শতাংশ, মুসলমান ২ শতাংশ, ইহুদি ২ শতাংশ ও ৬ শতাংশ অন্যান্য মতবাদ।

আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। তবে মুসলমানদের সঠিক পরিসংখ্যান বের করা বেশ কঠিন। কারণ দেশটির আদমশুমারিতে ধর্মভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান করা হয় না। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ এর ২০১০ সালের রিপোর্ট অনুসারে আর্জেন্টিনার মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ।

অন্যদিকে ‘দ্য পিউ রিসার্চ সেন্টার’ এর ২০১০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী আর্জেন্টিনার মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। অ্যাসোসিয়েশন অব রিলিজিয়াস ডাটা আর্কাইভ (এআরডিএ) এর তথ্যমতে, আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ মুসলমান।

আর্জেন্টিনার প্রথম মুসলিম ও আবর বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট ছিলেন কার্লোস মেনেম। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। অবশ্য ক্ষমতার জন্য তিনি খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তার সাবেক স্ত্রী জুলিমা ইয়মা বলেন, ‘মেনেম ১৯৬৬ সালে ইসলামধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। এর একমাত্র কারণ ছিল তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছেন।’ তবে তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে মুসলমানদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন। বিশেষ করে সৌদি সরকারের সহায়তায় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার নির্মাণ উল্লেখযোগ্য।

দেশটির রাজধানী বুয়েন্স আয়ারসে নির্মিত হয়েছে বেশ কটি বড় বড় মসজিদ এবং ইসলামিক সেন্টার। আর্জেন্টাইন মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘দ্য ইসলামিক সেন্টার অব আর্জেন্টিনা’।

এটি নির্মাণে সৌদির সহায়তার জন্য প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেনেম ১৯৯২ সালে এক রাষ্ট্রীয় সফরে সৌদি আরবে যান। তখন তিনি এক রাষ্ট্রীয় চুক্তির মাধ্যমে ৩৪০০ বর্গমিটার পরিমাণ জমি সৌদি সরকারকে প্রদান করেন। পরবর্তীতে সৌদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে একটি বৃহৎ আয়তনের মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার গড়ে তোলা হয়।

২০০০ সালে এই মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। প্রখ্যাত সৌদি স্থপতি জুহায়ের ফাওয়াজের ডিজাইন করেন।
রাজধানী বুয়েন্স আয়ারসে স্থাপিত প্রথম মসজিদ হচ্ছে আত-তাওহিদ মসজিদ। আর্জেন্টিনায় অবস্থিত ইরান দূতাবাসের সহায়তায় ১৯৮৩ সালে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। এটি মূলত শিয়াদের জন্য নির্মিত হয়েছিল।

১৯৮৫ সালে সুন্নি মুসলমানদের জন্য আল আহমাদ মসজিদ নির্মিত হয়। আর্জেন্টিনার মুসলিম স্থপতি আহমাদের ডিজাইন করেন। তার নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়। এছাড়াও দেশটির বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো মসজিদ নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে কর্ডোভায় ২টি, মার দেল পাতায় ২টি এবং এল বলসনের সুফি মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

লাতিন আমেরিকান মুসলমানদের সংগঠন ‘ইসলামিক অর্গানাইজেশন অব লাতিন আমেরিকার (আইওএলএ)’ সদর দপ্তর আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ারসে অবস্থিত। এই সংগঠনটি লাতিন অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে সক্রিয় সংগঠন। সংগঠনটি এখানকার মুসলমানদের জন্য শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক আন্দোলন ও দাওয়াতি কর্মকা- করে থাকে। স্বভাবতই আর্জেন্টিনায় এই সংগঠনটির বিশেষ অবদান ও প্রভাব রয়েছে।

আর্জেন্টিনার স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে ‘ইসলামিক সেন্টার অব দি আর্জেন্টাইন রিপাবলিক (সিআইআরএ) সবচেয়ে প্রভাবশালী। ১৯৩১ সালে আর্জেন্টিনায় বসবাসকারী আরব মুসলিমদের দ্বারা এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত আল আহমাদ মসজিদটিও এই সংগঠনের অবদানে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেখনকার মুসলমানরা এখন কেমন আছেন এ প্রশ্নের অনুসন্ধানে ‘দি আর্জেন্টাইন ইনডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘আর্জেন্টাইন মুসলিমরা কোন ধরনের বৈষম্যের শিকার হন না।’ সেখানে আরও বলা হয়, ‘একজন আর্জেন্টাইন মুসলিম কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই তার ধর্মবিশ্বাস পালন ও অনুশীলন করতে পারেন।’ পত্রিকার সঙ্গে ‘সিআইআরএ’র প্রতিনিধি আলেক্সিস আই সায়ের বলেন, ‘সারাবিশ্বের মুসলমানরা যখন বৈষম্যের শিকার, তখন আর্জেন্টিনার মুসলমানরা বেশ ভালো আছেন। তবে এখানকার মুসলমানদের ইসলামি জ্ঞানের অভাব রয়েছে।’

আলেক্সিস বলেন, ‘নাইন-ইলেভেনের বিপর্যয়ের পর আর্জেন্টিনার মুসলমানরা কিছুটা আতঙ্কে থাকলেও তেমন কোনো সমস্যা তাদের হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তখন অনেক মুসলিম নিজেদের মুসলিম হিসেবে পরিচয়ই দিত না।’

আর্জেন্টাইন মুসলিমদের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে আলেক্সিস বলেন, ‘মুসলমানরা কর্মক্ষেত্রে থাকার কারণে সবসময় ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের সুযোগ পান না। রমজান মাসে সবাই রোজা রাখার সুযোগ পান না। তবুও আমরা ভালো আছি।’

সারাবিশ্বে চলমান হিজাব বিতর্কে আর্জেন্টিনার আদালত মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধানের অনুমতি দিয়েছে। ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি আদালতের এক রায়ে বলা হয়, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রেও মুসলিম নারীরা হিজাব পরিহিত অবস্থায় ছবি দিতে পারবেন।’ আদালত এটাকে ধর্মীয় স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেছে।

আর্জেন্টিনায় মুসলিমরা বেশকিছু ধর্মীয় সমস্যায় ভোগেন। এর মধ্যে মধ্যে অন্যতম হলো, মুসলিমবিশ্বের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের অভাব, ধর্মীয় সচেতনতা হ্রাস, দাওয়াত ও তাবলিগের সংকট ও ভালো হাফেজের অভাব।

বর্তমানে আর্জেন্টাইন মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, স্প্যানিশ ভাষায় ইসলামি উপকরণের অভাব। স্থানীয় মুসলিম আলেমরা স্প্যানিশ ভাষায় ইসলামি বইপত্র অনুবাদ করাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। জ্ঞানের অভাবে অনেক মুসলিম তাদের আত্মপরিচয় ভুলে যাচ্ছেন। এমনকি তারা ‘নিধর্মী’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন।

‘কাউন্সিল অন হেমসিগ্রিক অ্যাফেয়ার্স’ এর সহযোগী ভিনসেন্ট লোফাসোর মতে, আর্জেন্টাইন মুসলিমদের সমস্যা হচ্ছে, ‘প্রথমত তারা তাদের অনেক ইবাদত ভুলে গেছে। তারা তাদের ধর্ম সম্পর্কে জানে না।

অনেকে আরবি ভাষায় সূরা-কেরাতও জানে না। এমন অনেক মুসলিম পরিবার আছে, যেখানে একজন মাত্র আরবি পারেন, বাকিরা কেবল স্প্যানিশ পারেন।’ দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষা স্প্যানিশে খুব কম ইসলামি বইপত্র পাওয়া যায়, বিশেষ করে কোরআন পাওয়া যায় না (কোরআনের স্প্যানিশ অনুবাদ হলেও তা সহজলভ্য নয়)’।

তৃতীয় ও শেষ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সেখানে মাদ্রাসা বা ইসলামিক স্কুল ও ইসলাম প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অভাব রয়েছে। ফলে অনেক মুসলিম স্থানীয় খ্রিষ্টধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। এমনকি অনেকে তার মূল ধর্ম (ইসলাম) ভুলে যাচ্ছেন!’

এজন্য আর্জেন্টিনায় দাওয়াত ও তবলিগের কার্যক্রম বৃদ্ধি করা ও মসজিদ-মাদ্রাসা আবাদ করা অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি ভালো থাকুক মেসি ও ম্যারাডোনার দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকরাÑ এটাই কামনা করি।

শেয়ার করুন: