কোরআন

পবিত্র কুরআন কীভাবে ছাপা হয়?

সৌদি আরবের মদীনা শহর। এই মদীনা শহরে আছে কিং ফাহদ কমপ্লেক্স (King Fahd Complex)। এই কমপ্লেক্স থেকে পৃথিবীর ৭০ টি ভাষায় কোটি কোটি কপি কুরআন শরীফ ছাপা হয়েছে।

এই অত্যাধুনিক কমপ্লেক্স তথা প্রিন্টিং প্রেসে বছরে ১২ মিলিয়নের অধিক সংখ্যক পবিত্র কুরআন শরীফ ছাপা হয়। অতি বিজ্ঞ কুরআনের হাফেজ, আলেম, বুজুর্গসহ বিভিন্ন পদে এখানে প্রায় ১৭০০ লোক কাজ করে। কীভাবে ছাপা হয় পবিত্র কুরআন? প্রায় ৮-১০ টি ধাপে এক খণ্ড কুরআন ছাপা হয় যার প্রতিটি স্তর হতে হয় একেবারে নিখুঁত।

১। সর্বপ্রথম একজন ক্যালিগ্রাফার নিজ হাতে একপাতা এক পাতা করে কোরআন লিখে যান যেখানে শুধুই অক্ষরগুলো থাকে, সেখানে কোন নোক্তা, জের, জবর এগুলো থাকে না। লেখার জন্য তিনি বড় একটা লেমিনেটিং শীট ব্যবহার করেন।

এরপর ৯ জন আলেম আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিটি পাতা পরীক্ষা করেন এবং প্রতি পাতায়নিজ নিজ স্বাক্ষর প্রদান করেন।এই শীট থেকে অফসেট পদ্ধতির মত ছাপার জন্য পজিটিভ প্লেট তৈরী করা হয়। ছাপার মেশিনটি প্রথম স্তরে শুধুই এই অক্ষরগুলো ছাপে। অনেকটা কাগজের নোট ছাপানোর মত প্রথমে একটা নির্দিষ্ট রং ব্যবহার করা হয়। একটা বড় কাগজে অনেকগুলো পৃষ্ঠা থাকে যেগুলো পরে একটা নির্দিষ্ট নিয়মে ভাজ করা হয়।

২। এই পর্বে আরেকটা লেমিনেটিং শীটে ক্যালিগ্রাফার নোক্তাগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় বসান বা লিখেন। এটা করার সময় প্রথম স্তরের লেমিনেটিং শীট নীচে ধরে রাখতে হয় যেন এই নোক্তাগুলো নীচের অক্ষর বরাবর নির্দিষ্ট জায়গায় বসে। শুধুমাত্র নোক্তা বসানো এই লেমিনেটিং শীটের মাধ্যমে পজিটিভ তৈরী করে কাগজের পাতায় ২য় স্তরের ছাপা হয়। এবারেও ৯ জন আলেম এটাকে আলাদা আলাদা ভাবে পরীক্ষা করে নিজেদের স্বাক্ষর সংযুক্ত করেন।

৩। তৃতীয় পর্বে আবার একটা লেমিনেটিং শীট ব্যবহার করা হয়। এবার জের-জবর (অর্থাৎ বাংলায় যাকে আমরা আকার, ই কার বলি সেরকম) যোগ করা হয় এবং ৯ জন আলেম দ্বারা পরীক্ষা করে পজিটিভ তৈরী করে কাগজে তৃতীয় ধাপের ছাপ নেয়া হয়। খেয়াল করুন, এই পর্যন্ত একটি কাগজ তিনবার মেশিনে ঢুকেছে আর বেরিয়েছে।

৪। চতুর্থ হতে ৬ষ্ঠ পর্বে সাকিন, রুকু-সেজদা এবং আয়াত চিহ্নিত করা হয় এবং প্রতিবারই ৯ জন আলেম সেগুলোকে পরীক্ষা করেন, তারপর পজিটিভ প্লেট এবং সবশেষে কাগজে ছাপা। দেখা যাচ্ছে একটি কাগজ মোট ৬ বার মেশিনে ঢুকানো হচ্ছে ৬ টি স্তরের ছাপা সম্পন্ন করছে।

৫। এরপর প্রতিটি কাগজ ভাঁজ করা হয় (যেভাবে বই ছাপার পর ফর্মা হিসেবে ভাঁজ হয় ঠিক সেরকম)। প্রতিটি ফর্মার জন্য একটি বার কোড এবং কালিতে ছাপা সাধারণ কোড ব্যবহার করা হয়।

কম্পিউটার এবং সর্টিং মেশিন এই বার কোড মিলিয়ে কাগজগুলো ফর্মা আকারে ভাজ করার কাজটা করে থাকে। তবে মেশিনের কাজ ঠিক আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্য কালিতে ছাপা সাধারণ কোড মিলিয়ে দেখা হয়। সেটা এমন সাধারণ কাজ যা সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে যে কেউ করতে পারবে।

৬। সবগুলো ফর্মা একত্রে সাজানো হয়ে গেলে একটি লটের মধ্যে যত কপি কোরআন শরীফ ছাপানো হচ্ছে সেখান থেকে কয়েকটি কপি পুনরায় ১০-২০ জন আলেম মিলে প্রতিটি লাইন এমনকি প্রতিটি অক্ষর ধরে পরীক্ষা করেন। যদি পরীক্ষায় এগুলো ঠিক পাওয়া যায় তবে সেগুলোকে বাঁধাইয়ের অনুমতি দেয়া হয়।

যদি এমন ভুল ধরা পড়ে যা হাতে সংশোধন করা সম্ভব তাহলে একটি একটি করে হাতে ধরে ধরে সেগুলি সংশোধন করা হয় এবং পুনরায় পরীক্ষা করে আলেমদের স্বাক্ষর নেয়া হয়।

ভুল যদি এমন হয় যা সংশোধনের অযোগ্য তাহলে পুরো লটে যত কোরআন শরীফ ছাপা হয়েছে সেগুলোকে সব পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়।

এই কমপ্লেক্সের সাথে রয়েছে অত্যাধুনিক ফার্নেস যেখানে পোড়ানোর কাজটি করা হয়। ভাবতে অবাক লাগে যে, এই পোড়ানোর কাজটিও অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে করা হয় যেন কোন মতেই ভুল কোন কপি বাইরে যেতে না পারে।

৭। ফর্মা বাঁধাই চূড়ান্ত হয়ে গেলে, সর্বশেষ বারের মত আলেমগণ পরীক্ষা করেন এবং সার্টিফিকেট দেন। বাঁধাই সম্পন্ন হবার পর এগুলো জেদ্দা পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে নির্দিষ্ট মন্ত্রনালয়ের তত্বাবধানে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এভাবে ছাপা, বাঁধাই থেকে শুরু করে কাংখিত গন্তব্যে প্রেরণের যাবতীয় খরচ সৌদি সরকার বহন করে থাকে।

৮। মূল আরবী ভাষার সাথে অন্য কোন ভাষায় অনুবাদ এবং তাফসির সহ অথবা অনুবাদ ও তাফসির ছাড়া নতুন একটি লট ছাপানোর পরিকল্পনা শুরু করার পর ছাপা – বাঁধাই শেষ হয়ে জেদ্দার গুদামে যেতে দুই বছর সময় লাগে। দুই বছর!

একদিকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি হাফেজ এবং অন্যদিকে এত নিখুঁত ভাবে ছাপানোর ব্যবস্থা থাকার কারনেই পবিত্র কুরআন শরীফ অবিকৃত অবস্থায় আছে- কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। আল্লাহ সুবহানুতায়ালা নিজেই তার পবিত্র গ্রন্থ হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন।

শেয়ার করুন: