হামিংবার্ড

পৃথিবীর একমাত্র পাখি যেটি প্রতি সেকেন্ডে রং বদলায়

ঊনিশ শতাব্দীতে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতে মহিলাদের মধ্যে হঠাৎ এক ফ্যাসনের প্রচলন হলো জামার উপরো ছোট সুন্দর, ঝলমলে, এক রকম পালক সমেত ট্যান করা পাখি রোচের মত এঁটে রাখা। এই ফ্যাসনটা ছিল রুচি, বিত্ত ও ঐশ্বর্যের পরিচায়ক। এতে এই গোষ্ঠীর হাজার হাজার পাখি নিধন হতে লাগল। যেমন ‘ফ্যাসন’ অনেকটা হুজুগা আশ্রয়ী এবং কোন ফ্যাসনই বেশি দিন স্থায়ী হয় না, সাজ পোশাকের অন্য ফ্যাসন আসার সঙ্গে সঙ্গে এই হুজুগও চলে গেল।

সেটা খুবই সৌভাগ্যের কথা তা না হলে অন্যান্য অনেক বন্যপ্রাণীর মত এই গোষ্ঠীর পাখিও পৃথিবী থেকে আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। এই পাখির বৈশিষ্ট্য হলো যে, এদের কোন কোন প্রজাতি আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট পাখি এবং এতো ঝলমলে রং যে হঠাৎ দেখলে গহনা বলে মনে হবে।

হামিংবার্ডের কথা বলছিলাম। পাখিগুলো আয়তনে ছোট হলে হবে কি এদের প্রজাতির কিন্তু অন্ত নেই দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণাঞ্চলে ও অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে আছে এদের ৩১৯টি প্রজাতি। এদের মধ্যে আয়তনে যে প্রজাতি সবচেয়ে ছোট, কিউবার ‘মক্ষিকা হামিংবার্ড’ আয়তনে মাত্র এক ইঞ্চির মত। অর্থাৎ একটি গুবরে পোকা বা ফড়িং-এর আয়তনের চেয়েও ছোট। আর এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে অ্যান্ডেস অঞ্চলে ‘পাটাগোনা জিগস’। এদের আয়তন প্রায় আট ইঞ্চি। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকটাই হচ্ছে ‘ল্যাজ’। সব প্রজাতির হামিংবার্ডই শুধু পিয়াসী। ঘুরে ঘুরে ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়।

ফুলের মধুই এদের প্রধান খাদ্য। তবে অনেক সময় ফুলের পাপড়িতে ছোট পোকা বসে থাকলে তাও খায়। অনেকের ধারণা আমাদের দেশের মধুপায়ী বংশের মৌচুসি বা মৌটুসি। কোথাও বা একে বলে টুনটুনী), ইংরেজীতে এই বংশের সব প্রজাতিকেই বলে ‘সানবার্ড’, এরাও বুঝি হামিংবার্ড-এর সমগোত্রীয় কারণ, এরাও ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়। এই ধারণাটা ভ্রান্ত। হামিংবার্ড একেবারেই ভিন্ন বংশীয় পাখি। বরং এদের খুব ঘনিষ্ঠ সমগোত্রীয় পাকি ‘সুইফটস। এর খানিকটা সাদৃশ্য মেলে আমাদের দেশের অপাদ বংশের মাছ রাঙা পাখির সঙ্গে এসব বংশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পা দুটি নিতান্তই অপ্রয়োজন কাজেই লুপ্ত প্রায়।

হামিংবার্ডের শরীর ও ডানা প্রায় ‘সুইফটের’ মতই হ্রম্ব, অপরদিকে সমস্ত শরীর উড়াবার পক্ষে অনুকূল, লম্বা লম্বা, পালকে আবৃত তাই এই বংশের পাখি বলতে গেলে মুখ্যত গগনবিহারী। আকারে আয়তনে ছোট হলেও এরা অত্যন্ত প্রাণচঞ্চল। দেহের গড়ন এমন যে সব কিছুই ফুলের মধু খাবার পক্ষে সহায়ক। কি করে যে ফুল থেকে মধু খায় সে এক বিস্ময়। এরা অনেক রকম ফুল থেকে মধু চুষে খায়। আর এইভাবে ফুলে ফুলে মধু খেতে খেতে পরাগ সংযোগ করে।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক প্রজাতির ফুলকে এভাবে পরাগ সংযোজনের জন্য নিজেদের চটকদার রঙে সেজে হামিংবার্ডকে আকর্ষণ করবার উপযোগী করে তুলতে হয়েছে। এসব দেখে আশ্চর্য হতে হয় প্রকৃতিতে কিভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণী জগত নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখবার জন্য একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। এরকম “মিথোজীবিতা” বা “সিমরায়োসিস” যদি মানুষের মধ্যে থাকতো তবে আজ জীবন অনেক সহজ ও সুন্দর হতো।

নিখুঁতভাবে ফুল থেকে মধু খাবার পক্ষে এদের লম্বা চুঞ্চু বা ঠোট বিশেষভাবে বিরর্তিত, আর তেমনি সহায়ক এদের লম্বা জিহ্বা। কোন কোন প্রজাতির জিহ্বা সরু এবং নলাকার যাতে ফুলের ওপর না বসে উড়ন্ত অবস্থাতেই জিব প্রসারিত করে মধু চুষে খেতে পারে। আবার কোন কোন প্রজাতির জিবের ডগা ব্রাশের মতো খরখরে এতে ফুলের মধু, পরাগ ও ফুলের ওপর ছোট ছোট কীট প্রতঙ্গ থাকলে সহজেই তুলে ’নিতে পারে।

আগেই বলা হয়েছে এদের পায়ের গড়ন শাখাশ্রয়ী পাখির মতো নয়, বরং পা দুটি লুপ্ত প্রায়। মধু খাবার সময় কখনও ফুলের ওপর বসে না। ফুলের কাছে এসে এত দ্রুত পাখনা ঝাপটাতে থাকে যে, তা প্রায় মানুষের দৃষ্টি শক্তির অগোচরেই হয়ে যায়।

ছোট প্রজাতির হামিংবার্ড সেকেন্ডে অন্তত ৭০ বার ডানা ঝাপটায় আর অপেক্ষাকৃত বড় প্রজাতির পাখি সেকেন্ডে ২০ থেকে ২৫ হাজার। মধু খাবার সময় ডানার দ্রুত উপরে নীচে ঝাপটানিতে এরা শূন্যে ভারসাম্য রক্ষা করে নির্বিঘেœ মধু আহরণ করে চলে।

উড়বার সময় অবশ্যি ডানার ঝাপটানির কৌশল পরিবর্তন করে। এমন সমান্তরালভাবে ঝাপটায়, এতে গতি সঞ্চয় করতে পারে। কোথাও না বসে ক্রমাগত ডানা ঝাপটাতে এদের প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয় তাই প্রতি পনের থেকে কুড়ি মিনিট পরই এদের খাবার প্রয়োজন হয়।

এই ক্রমাগত দ্রুত ডানার ঝাপটানিতে ভোমরার মতো একটা অস্পষ্ট বোঁ বোঁ শব্দ হতে থাকে তবে কোন কোন প্রজাতির উন্মুক্ত অঞ্চলেও থাকতে অভ্যস্ত। আবার কোন কোন প্রজাতি থাকে খুব উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে। এদের মধ্যে অনেক প্রাজতিই পরিযায়ী। এরা পরিযায়ী হয়ে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ কানাডা ও আলাস্কা প্রভৃতি অঞ্চলে যায়। লালগলা (রুবি থ্রোটেড) হামিংবার্ড বোধহয় সবচেয়ে পরিযায়ী দক্ষ।

আয়তনে ছোট হলে হবে কি মেক্সিকো উপসাগর ধরে কোথাও না থেমে পূর্ব উত্তর আমেরিকাতে প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার দূরে পাড়ি জমায়। এ আর এক বিস্ময়, যে পাখির ১৫/২০ মিনিট পরপর খাবার প্রয়োজন হয় সেই পাখি কি করে না খেয়ে এক নাগাড়ে ৯৫০ কিঃ মিঃ দূরে পাড়ি জমায়। দেখা গিয়েছে যে এই বংশের “রুফাস হামিংবার্ড” প্রজাতি উত্তর পশ্চিম আলাস্কা থেকে শীতের সময় প্রশান্ত মহাসাগরের কোলঘেঁষে রকিমাউন্টেন পর্বতশ্রেণী ১২,০০০ ফুট উঁচু দিয়ে মেক্সিকোতে পাড়ি জমায়। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমার আগে এরা শরীরের ওজনের দ্বিগুণ চর্বি জমিয়ে নেয়।

কারণ উড়বার সময় তো আর কোথাও নামবে না বিশ্রাম নেবে না বা খাবার খাবে না যাকে বলে “ননস্টপ ফ্লাইট” একমাত্র বৃষ্টির সময়ে এরা প্রায় নির্জীব ও প্রাণহীন হয়ে পড়ে।

অনেকটা সরীসৃপের হিমশয়ানের মতো। দীর্ঘ বর্ষার সময় এইভাবে নির্জীব থেকে ভালো দিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে। প্রায় সব পাখিই গোসল করতে ভালবাসে। এরা কিন্তু বলতে গেলে গোসল এড়িয়েই চলে শুধু মাঝে মাঝে গাছের পাতাতে যে পানি ফোঁটা লেগে থাকে তা দিয়ে ডানা ঘষে পরিষ্কার করে নেয়। এই হলো এদের গোসল। এরা দর বেঁধে থাকা পছন্দ করে না। স্বভাবতই এলাকা উড়ে।

খাদ্যের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে খুব ঝগড়া বিবাদ করে। এদের পুরুষ শরিকগুলো সবসময় স্বল্প কয়েক বর্গমিটার জায়গা ঝগড়াঝাঁটি করে নিজের দখলে রাখতে চেষ্টা করে। কেবলমাত্র নিজ প্রজাতি নয়, এমনকি অন্য প্রজাতি বা গণের পাখিদেরও এই অধিকৃত সা¤্রাজ্যে আসা পছন্দ করে না। এলে তেড়ে গিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে দূর করে দেয়।

হামিংবার্ড যদিও আকারে আয়তনে খুব ছোট, দেখতে সুন্দর, সুদক্ষ শিল্পীর তুলির বর্ণসম্ভারে সমৃদ্ধ কিন্তু এদের প্রণয় অভিসার নিতান্ত আনাড়ির মতো ও অপরিচ্ছন্ন। পুরুষ পাখি হঠাৎ কোথা থেকে এসে ঝুপ করে স্ত্রী পাখির সামনে বারবার ঘুরতে আরম্ভ করে। যতক্ষণ না দয়িতার মনোরঞ্জন হয়। দেখা যায় অনেক প্রজাতির পাখি দয়িতার মনোরঞ্জন করবার জন্য পাখা মেলে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে। কোন কোন পাখি আবার সুন্দর শিস দিয়ে অথবা ডাক দিয়ে দয়িতাকে জিতে নিতে চেষ্টা করে।

আবার কোন কোন প্রজাতির মিলন প্রয়াসী পুরুষ পাখি অনেকটা সুন্দর সুন্দর বাসা বানায় যদি স্ত্রী পাখির সেই বাসা পছন্দ হয় তবে সেটাতে ঢুকবে মিলনের জন্য। আবার কোন কোন গোষ্ঠীর স্ত্রী এবং পুরুষ পাখির যুগ্ম প্রচেষ্টায় বাসা বাঁধা হয়। কিন্তু এই গোষ্ঠীর পুরুষ পাখি সে রকম কিছুই করে না। কেবলমাত্র সুন্দর, চকচকে রঙের বিচ্ছুরণ আর সুন্দর পালকের বর্ণ সম্ভার দিয়ে দয়িতার মনোহরণ করে।

কোন কোন প্রজাতির পুরুষ পাখি নিজের ঝটির বাহার বা জুলফি, দাড়ি বা লেজের পালকের রঙের চাকচিক্য দিয়ে যদি দয়িতার মন জয় করতে পারে তবে নিঃসীম নীল গগনে উড়ন্ত অবস্থাতে মিলন হতে বাধা নেই।

কিন্তু আশ্চর্য এমন অকৃতজ্ঞ সঙ্গী কিন্তু বড় একটা দেখা যায় না। মিলনের পরে পুরুষ পাখি আর কোন দায়িত্বই পালন করে না। এবার বাসা বাঁধা, ডিমে তা দেয়া, বাচ্চার জন্য খাবার যোগাড় করা ইত্যাদি সবই স্ত্রী পাখির দায়িত্ব।

এসব ব্যাপারে আর কোন যৌথ ভূমিকা নেই। স্ত্রী পাখিটি এবার নিজের পছন্দ মতো ছোট চায়ের পেয়ালার আকারের অথবা গম্বুজ আকৃতির গাছের দুই ডালের মাঝে বা ঝুলে পড়া ডালে বা লতাগুল্মের সাথে আটকে ঝোলান বাসা বাঁধে গাছের আঁশ, শুকনো সরু লতাগুল্ম, শ্যাওলা, শুকনো পুষ্পল ছত্রাক, মাকড়সার জাল ইত্যাদি দিয়ে খুব শক্ত করে।

দেখা গিয়েছে এই সব অতিসামান্য মাল মসলা দিয়ে খুব দক্ষ শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মতো নানাভাবে বাসা বেঁধেছে। আয়তনের তুলনায় বেশ বড় আকারের একবারে দুটি করে সাদা রঙের ডিম দেয়।

প্রায় চৌদ্দ দিন ডিমে তা দেয়। ডিম থেকে বাচ্চা বেরোবার পরও অন্তত দুই থেকে চার সপ্তাহ মায়ের তত্ত্বাবধানেই থাকে। এই সময়টাতে মা বাইরে থেকে বেশ পেট ভরে মধু ও কীট পতঙ্গ খেয়ে এসে নিজের পাকস্থলীতে চালান করে দেয় যতদিন না বাচ্চা নিজে ফুলে ফুলে মধু আহরণ করতে শেখে। এই সময়টা এদের পক্ষে খুবই সংকটজনক ও সমস্যাপূর্ণ।

যদি কোন কারণে মা প্রচুর পরিমাণে খাবার সংগ্রহ করতে না পারে তবে নিজেই বা খাবে কি আর বচ্চাকেই বা খাওয়াবে কি! প্রকৃতি বড় নির্দয়। তার কাছে দুর্বলের স্থান নেই।

হামিংবার্ডের যদিও ৩১৯টি প্রজাতি আছে তবুও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এদের খুব বেশি তফাত নেই। কতগুলো প্রজাতি যা সাধারণত দেখা যায় তার মধ্যে সোর্ড বিলড, ইউটোনেরা অ্যাকুইলা-এদের ঠোঁট বেশ লম্বা এবং নীচৈর দিকে বাঁকানো। তাছাড়া স্টেফেনপিকিসস লম্বা, সরু, সবুজ বা বেগুনি ঝুটির জন্য প্রসিদ্ধ।

হেলিয়াকটেন করনুটা প্রজাতির সবজে লাল ঝুঁটি সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আসিস গোপন গুয়েরিনাইর সাদা কালো ঝুঁকি, লোফরনিসের গলার দু’পাশে খাড়া পাখার মতো বিস্তৃত জুলফি স্ব স্ব প্রজাতির স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করে।

শেয়ার করুন: