যা ঘটেছে খুলনা সিটি নির্বাচন ভোটে

খুলনা সিটি নির্বাচন – খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ হলেও ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির ঘটনা ঘটেছে বলে আভিযোগ করেছে বিএনপি। নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কমপক্ষে ৯৫টি কেন্দ্রে নানা ধরনের অনিয়ম-জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে বলে তারা জানান। এর মধ্যে ধানের শীষের প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেয়া হয়েছে অনেক কেন্দ্র থেকে।

কিছু কেন্দ্রে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারা হয়েছে। ব্যাপকতা ছিল জাল ভোটের। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া হয়েছে। ব্যালটে সিল মারার অভিযোগে দুইটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। সাময়িক স্থগিত রাখা হয় আরও দুই কেন্দ্র।

অন্যদিকে ভোট কেন্দ্রে ব্যাপক ভোটারের উপস্থিতি দেখা গিয়েছে। সাধারণ ভোটার বলেন, কোন ভয় ছাড়ায় তারা নিরাপদে ভোট দিতে পেরেছেন। বাধা দেওয়া হয়নি। এছাড়া কারচুপির অভিযোগ থাকলেও এদিন সিটি করপোরেশন কোন সহিংশতার খবর পাওয়া যায়নি।

ভোটগ্রহণ শেষে মেয়র পদে নৌকার প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক জয়ের আশা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু ভোটে নানা ধরনের অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন। ভোটগ্রহণ সুষ্ঠ হয়েছে বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন।

ইসির নিজস্ব পর্যবেক্ষক লাঞ্চিত! ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণে গেলে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর সমর্থকরা নির্বাচন কমিশনের একজন পর্যবেক্ষককে লাঞ্ছিত করেছেন। ভোটগ্রহণ শুরুর কিছুক্ষণ পরেই তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। ভোট পর্যবেক্ষণে ইসি’র ওই কর্মকর্তা ঢাকা থেকে খুলনায় গিয়েছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, নুরানী বহুমুখী মাদরাসা বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। এই ঘটনার পর তিনি সেখান থেকে বের হয়ে যান।

নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া প্রতিবেদকদের তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের ওই সমর্থকরা নির্বাচন কমিশনের একটি গাড়ি ভাঙচুরেরও চেষ্টা চালায়। ওই ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারকে হুমকি! একটি কেন্দ্রে জাল ভোট দিতে বাধা দেওয়ায় সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার উজ্জল কুমার পালকে হুমকি দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা। এ ঘটনার পর ভোট শেষে বাড়ি ফেরার পর নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ওই কর্মকর্তা জানান, বেলা ১১টার সময় ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের সময় রূপসা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫ নম্বর বুথে হঠাৎ কয়েকজন লোক এসে ব্যালট পেপার কেড়ে নেয়।

পরে তারা নৌকায় সিল মারতে গেলে আমি তাতে বাধা দিয়েছি। এমনকি আমি সিল মারা ব্যালট পেপারগুলো বক্সে ভরতে দেইনি। তারা আমার নাম পরিচয় জেনে গেছে। ভোট শেষ হলে দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়েছে।

তিনি বলেন, আমার কাছে থাকা একশ ব্যালট পেপার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। যার সিরিয়াল নম্বর ০০৪৫৮৪০১ থেকে ০০৪৫৮৫০১ পর্যন্ত। সেগুলো সিল মেরে বাক্সে দিতে দেইনি।

এই ঘটনার পর কেন্দ্রটিতে ভোট সাময়িক স্থগিত হয়ে যায়। পাশেই আরও একটি কেন্দ্রে জালভোট দেয়ার প্রমাণ পাওয়ার পর সেটিতেও ভোট স্থগিত করা হয়।

পোলিং এজেন্টকে জিম্মি! আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন সেই পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল কেন্দ্রে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের জিম্মি করে নৌকার সমর্থকরা।

এ সময় তাদের মোবাইল, মানিব্যাগও জব্দ করে তারা। পরে দুপুর আড়াইটায় সেখানকার ধানের শীষের একজন পোলিং এজেন্ট জানান, সাড়ে বারোটার দিকে তাদের কেন্দ্রে সবগুলো বুথ দখল করে নৌকার লোকজন। আমি সেখান থেকে কিছুক্ষণ আগে ছাড়া পেয়েছি।

একই অবস্থা দেখা গেছে নগরীর সোহরাওয়াদী কলেজ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের আহসান উল্লাহ কলেজ কেন্দ্রে। সেখানে ব্যালট পেপার বাইরে এনে সিল মেরে নিজস্ব ভোটার দিয়ে আবারও তা ভেতরে পাঠিয়ে ব্যালট বাক্সে রাখা হচ্ছে। তবে দায়িত্বরত কোনো নির্বাচনী কর্মকর্তাই বিষয়টি স্বীকার করেননি।

বিএনপির পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে সেখানে প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা।

২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী শমসের আলী মিন্টু অভিযোগ করেন তার প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মীরা ভোট ডাকাতি করেছে। তার এজেন্টদের বের করে দিয়ে তারা সিল মারে।

খুলনা আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রের বাইরে একায় ঘুরছিলেন ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির সভাপতি বদরুল আনাম। তিনি জানান, গত রাতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছে তালুকদার আব্দুল খালেকের কর্মীরা। ফলে সকালে তিনি ভোটারদের স্লিপ দেওয়ার মত কোন কর্মী পাচ্ছিলেন না।

২৫ নম্বর ওয়ার্ডের নূরানী বহুমুখী মাদ্রাসা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকরা সকাল থেকেই ব্যালট পেপার নিয়ে সিল মারতে থাকে। এক তরুণের জাল ভোটের দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করা হলে সেটি মুছে ফেলা পর্যন্ত গণমাধ্যমকর্মীদের সেখান থেকে আসতে দেওয়া হয়নি।

একই ওয়ার্ডের সোহরাওয়াদী কলেজ কেন্দ্রে একদল যুবক প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারতে থাকে। সাংবাদিকরা সেখানে পৌঁছালে তারা সেখান থেকে বের হয়ে আসে। তারা দীর্ঘ সময় সাংবাদিকদের ঘিরে রাখে। পরে সাংবাদিকরা সেখান থেকে চলে আসলে আবারও সিল মারতে থাকে।

‘ডিস্টার্ব’ করবেন না! শিপইয়ার্ড কেন্দ্রে পৌঁছার আগেই একজন বৃদ্ধ ভোটার জানান, শিপইয়ার্ড সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে একদল যুবক নৌকা প্রতীকে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ঢুকাচ্ছে। পরে কেন্দ্রে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া যায়।

একটু সামনে গিয়ে মতিয়াখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে দাঁড়ানোর পরে একজন কিশোর এসে বলেন, ‘রাসেল ভাই সালাম দিয়েছেন, আপনারা এখানে থাকলে আমাদের কাজে ‘ডিস্টার্ব’ হবে, আপনারা চলে যান।’

রুপসা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে খানিকটা দূরে কয়েকজন কর্মী নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমীর এজাজ খান। তিনি জানান, এই কেন্দ্র তাদের পোলিং এজেন্ট ছিলেন সেলিম কাজী।

সকাল পৌনে ৯টায় নৌকার সমর্থকরা তাকে পিটিয়ে আহত করে। পরে তাকে খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার পর ঐ কেন্দ্রে আর কোন পোলিং এজেন্ট দেওয়া সম্ভব হয়নি।

প্রিসাইডিং অফিসার তালাবদ্ধ! সরকারী ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকাল পৌনে ১১টার দিকে একদল যুবক প্রবেশ করে দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত সাত নম্বর বুথের সমস্ত ব্যালট পেপার নিয়ে নৌকায় সিল মারে।

প্রিসাইডিং অফিসার খলিলুর রহমান বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে এক কক্ষে নিয়ে আটকে রাখে। পরে ভোট নেওয়ার মত ব্যালট পেপার না থাকায় সেই বুথের ভোটারদেরকে ফেরত দেওয়া হয়।

একপর্যায়ে গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে উপস্থিত হলে সহকারী রির্টানিং অফিসার আনিসুর রহমান প্রিসাইডং অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করে কেন্দ্রের ভোট স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন।

নৌকায় সিল মারা ব্যালট সরবরাহ! আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের বাসভবনের পাশে ফাতেমা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের একটি বুথে ভোট শুরুর আগেই তার কর্মীরা ব্যালটের একটি বইয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে রাখে। পরে ভোটাররা ভোট দিতে এলে তাদেরকে সিল মারা ব্যালট দেওয়া হয়। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে সেই বুথের ভোট স্থগিত করা হয়।

দুপুর ২টার পরে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বাসভবনের পাশের রহিমা খাতুন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে তার পোলিং এজেন্টদের পিটিয়ে বের করে দেয় তালুকদার আব্দুল খালেকের সমর্থকরা।

ছোরাব শেখের ভোট কে দিলো? এ নির্বাচনে নিজের ভোট দিতে পারেননি এক ভোটার। মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টায় নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শেরে বাংলা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।

ছোরাব শেখ নামে ওই ভোটার কেন্দ্রে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিতে গেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচনী কর্মকর্তা তাকে জানান, তার ভোট আগেই দেয়া হয়ে গেছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রশ্ন রাখেন- ‘তাহলে আমার ভোট কে দিলো ?’ এ অভিযোগের ব্যাপারে প্রিসাইডিং অফিসার পরিতোষ কুমার বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। ভোটারকে ডেকেছি, উনি এলে এ বিষয়টার সুরাহা করা হবে।

শেয়ার করুন: