ইসলাম

শবে বরাতের রাতেও যারা ক্ষমা পাবে না

শবে বরাতের রাতেও যারা- ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে আজ মঙ্গলবার রাতে সারা দেশে পবিত্র শবে বরাত পালিত হবে। হিজরি বর্ষপঞ্জির শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতটি শবে বরাত হিসেবে পালিত হয়।

ইসলাম ধর্মে এই রাতটি অত্যন্ত বরকতময়। এই রাতেই পরবর্তী এক বছরের জন্য মহান আল্লাহ তাআলা বান্দাদের রিজিক ও হায়াত নির্ধারণ করেন, রোগ থেকে মুক্তি দেন ও দোয়া কবুল করেন। এই রাতকে বলা হয় ‘সৌভাগ্যের রজনী’।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ রাতটিকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (অর্ধশাবান রাত) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে এই রাতটি শবে বরাত তথা মুক্তি, নিষ্কৃতি, পাপ মোচনের রাত নামেই সমধিক খ্যাত।

মাহে শাবানের সূচনা থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ব্যক্তি ও সমাজজীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। কিন্তু সমাজের প্রবল প্রথাগত, আড়ম্বরপূর্ণ উদযাপন ও রেওয়াজি সংস্কৃতিতে শবে বরাতের প্রকৃত মাহাত্ম্য, মর্যাদা ও পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না এ নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। আর এ জন্য শবে বরাতের প্রকৃত গুরুত্ব ও তাৎপর্য, ফজিলত, মাহাত্ম্য ও করণীয় এবং বর্জনীয় সম্পর্কে সবার সম্যক জানা থাকা একান্ত আবশ্যক।

যদিও এ রাত সাধারণ ক্ষমার রাত। এ রাতের ক্ষমা ও মুক্তি অনেক ব্যাপক এবং বিস্তৃত। এর পরও বিশেষ দু’শ্রেণির মানুষ এ রাতেও সাধারণ ক্ষমা ও মুক্তি পাবেন না- বলে ইরশাদ হয়েছে।

তাই শবে বরাতের ফজিলত লাভের পূর্বশর্ত হলো- এ রাত আসার আগেই নিজেকে বিশেষ দু’টি গুনাহ থেকে নিজেকে পবিত্র করা। একটি হলো- শিরক। অপরটি হলো- বিদ্বেষ।

আজকের সূর্যাস্তের আগেই নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন, আপনি কোনো ধরণের শিরকে লিপ্ত আছেন কিনা? কোনো মুসলমানের প্রতি আপনার অন্তরে বিদ্বেষ আছে কিনা? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়ে থাকে, তবে নিজের অন্তরকে শিরক ও বিদ্বেষ থেকে নির্মল করুন, এর পর শবে বরাতের ইবাদত শুরু করুন।

এ রাতে করনীয়ঃ এ পুরো রজনী হল ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এক উত্তম রাত্রী, যার ফজীলত হাজার রাতের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ রাতে বান্ধা তার সকল পাপ কাজের ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য আল্লাহর আরশ উন্মুক্ত পাবে আর মহান আল্লাহ ও নিজেই ঘোষনা করে দিয়েছেন যে তিনি চাইতে থাকেন খুজতে থাকেন কে তাহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা চাচ্ছে।

তাই আমাদের উচিত এই রাতে বেশী বেশী ইবাদত করা, নফল নামাজ পড়া, জিকির করা, কুরআন পাঠ করা। এই দিনে সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহ পাকের নূর সর্বনিম্ন আকাশে অবতীর্ণ হয় এবং বলা হয়- কে আছ গুনাহ মাফ করাতে চাও? কে আছ তার মনের আকাংখা পূরণ করাতে চাও? কে আছ তার রুজী বৃদ্ধি করাতে চাও? কে আছ তার রোগ, শোক, দুঃখ কষ্ট দূর করাতে চাও? এরূপ ঘোষণার সময় যদি কোন বান্দা হাত তুলে মুনাজাত করে, তবে আল্লাহ আয যাওযাল তার মুনাজাত কবুল করে নেন।

মধ্য শাবানের নফল রোজা: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত কর ও দিনে রোজা পালন কর। (সুনানে ইবনে মাজাহ)। এ ছাড়া প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিজের নফল রোজা তো রয়েছেই, যা আদি পিতা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদও (সা.) পালন করতেন, যা মূলত সুন্নত।

সুতরাং তিনটি রোজা রাখলেও শবে বরাতের রোজা এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। তা ছাড়া, মাসের প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ; শবে কদরের রোজা এর আওতায়ও পড়ে। সওমে দাউদি বা হজরত দাউদ (আ.)-এর পদ্ধতিতে এক দিন পর এক দিন রোজা পালন করলেও সর্বোপরি প্রতিটি বিজোড় তারিখ রোজা হয়; এবং শবে কদরের রোজার শামিল হয়ে যায়।

সর্বোপরি রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসের পর রজব ও শাবান মাসে বেশি নফল ইবাদত তথা নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন; শাবান মাসে কখনো ১০টি নফল রোজা, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো আরও বেশি রাখতেন। রজব ও শাবান মাসের নফল রোজা রমজান মাসের রোজার প্রস্তুতি।

রোজার মাসআলা: হাদিস শরিফে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা শরিফে হিজরতের পরে দেখতে পেলেন মদিনার ইহুদিরাও আশুরার একটি রোজা পালন করেন। তখন তিনি সাহাবিদের বললেন, আগামী বছর থেকে আমরা আশুরার আগে বা পরে আরও একটি রোজা রাখব, ইনশা আল্লাহ! যাতে তাদের সঙ্গে মিল না হয়।

তাই আশুরার রোজা অর্থাৎ মহররম মাসের দশম তারিখের রোজার সঙ্গে তার আগে বা পরে আরও একটি রোজা রাখা মোস্তাহাব। শবে বরাতসহ বছরের অন্য নফল রোজাগুলো একটি রাখতে বাধা নেই; বরং এক দিন পর এক দিন রোজা রাখা হজরত দাউদ (আ.)-এর সুন্নত বা তরিকা; যা নফল রোজার ক্ষেত্রে উত্তম বলে বিবেচিত এবং সওমে দাউদি নামে পরিচিত। অনুরূপভাবে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজাও আলাদা আলাদা বা একত্রেও রাখা যায়।

শবে বরাতের নামায এবং নিয়ম কানুনঃ প্রকৃত অর্থে শবে বরাতের নামাজ বলে আলাদা কিছু নেই, যেহেতু এই রাতটি ইবাদত বন্দেগী করে কাটাতে হবে তাই হাদিসেই এই সমাধান দেয়া হয়েছে। আর বিশ্ব মুসলিম এই বিশেষ কিছু ইবাদত পালন করে থাকেন। হাদিসের আলোকে আমী সেগুলোর কথাই নিন্মে উল্লেখ করছিঃ

সন্ধ্যায়ঃ এই রাতে মাগরিব নামাজের পর হায়াতের বরকত, ঈমানের হেফাযত এবং অন্যের মুখাপেক্ষী না হওয়ার জন্য দু রকাত করে মোট ৬ রকাত নফল নামায পড়া উত্তম।

এই ৬ রাকাত নফল নামাযের নিয়মঃ প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা এরপর যে কোন একটি সূরা পড়তে হবে। দু রকাত নামায শেষে করে সূরা ইয়াছিন বা সূরা ইফলাছ শরীফ ২১ বার তিলায়াত করতে হবে।

শব-ই বরাত এর নফল নামাযঃ ১। দুই রকাত তহিয়াতুল অযুর নামায। নিয়মঃ প্রতি রকাতে আল হামদুলিল্লাহ ( সূরা ফাতিহা) পড়ার পর , ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং তিন বার ক্বুলহু আল্লাহ শরীফ ( সূরা এখলাছ) । ফযীলতঃ প্রতি ফোটা পানির বদলে সাতশত নেকী লিখা হবে।

২। দুই রকাত নফল নামায। নিয়মঃ ১নং নামাযের মত, প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর, ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং ১৫ বার করে সূরা এখলাছ শরীফ, অতপর সালাম ফিরানোর পর ১২ বার দুরূদ শরীফ। ফযীলতঃ রুজিতে রবকত, দুঃখ-কষ্ট হতে মুক্তি লাভ করবে, গুনাহ হতে মাগফিরাতের বখসিস পাওয়া যাবে।

৩। ৮ রকাত নফল নামায , দু রকাত করে পড়তে হবে।

নিয়মঃপ্রতি রকাতে সূরা ফাতিহার পর , সূরা এখলাছ ৫ বার করে। একই নিয়মে বাকি সব। ফযীলতঃ গুনাহ থেকে পাক হবে , দু’আ কবুল হবে এবং বেশী বেশী নেকী পাওয়া যাবে।

৪। ১২ রকাত নফল নামায , দু রকাত করে। নিয়মঃ প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহার পর, ১০ বার সূরা এখলাছ এবং এই নিয়মে বাকি নামায শেষ করে , ১০ বার কলমা তওহীদ, ১০ বার কলমা তামজীদ এবং ১০ বার দুরূদ শরীফ।

৫। ১৪ রকাত নফল নামায, দু রকাত করে। নিয়মঃপ্রতি রকাত সূরা ফাতিহার পর যে কোন একটি সূরা পড়ুন। ফযীলতঃ যে কোন দু’আ চাইলে তা কবুল হবে।

৬। চার রকাত নফল নামায, ১ সালামে পড়তে হবে। নিয়মঃ প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহা পর ৫০ বার সূরা এখলাছ শরীফ। ফযীলতঃ গুনাহ থেকে এমনভাবে পাক হবে যে সদ্য মায়ের গর্ভ হতে ভুমিষ্ঠ হয়েছে। ৭। ৮ রকাত নফল নামায, ১ সালামে। নিয়মঃ প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহার পর ১১ বার সূরা এখলাছ শরীফ।

ফযীলতঃ এর ফজিলতে সর্ম্পকে বর্ণিত আছে যে, হযরতে সৈয়্যদাতুনা ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহুমা এরশাদ করেছেন, “ আমি ঐ নামাজ আদায় কারীর সাফা’য়াত করা ব্যাতিত জান্নাতে কদম রাখবো না।

রোযার ফযীলত হুজুর সালল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে শাবানে ১ দিন রোযা রেখেছে, তাকে আমার সাফা’য়াত হবে। আরো একটি হাদীস শরীফে আছে যে, হুজুর সালল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যাক্তি শাবানের ১৫ তারিখে রোযা রাখবে, তাকে জাহান্নামের আগুন ছোঁবে না। এছাড়াও পড়তে পারেন ‘সালাতুল তাসবীহ এর নামাজ। এই নামাজের অনেক অনেক ফযীলত রয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সালল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় চাচা হযরত আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুকে এই নামায শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, এই নামায পড়লে আল্লাহ আয-যাওযাল আপনার আউয়াল আখেরের সগীরা কবীরা জানা অজানা সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন।

“হে চাচা জান ! আপনি যদি পারেন, তবে দৈনিক একবার করে এই নামায পড়বেন। যদি দৈনিক না পারেন, তবে সপ্তাহে একবার পড়বেন। যদি সপ্তাহে না পারেন, তবে মাসে একবার পড়বেন। যদি মাসে না পারেন, তবে বছরে একবার পড়বেন। যদি এটাও না পারেন, তবে সারা জীবনে একবার হলেও এই নামায পড়বেন ( তবুও ছাড়বেন না)”।

শেয়ার করুন: