১৭ দিন পর রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবন্ত উদ্ধার হয়েছিলেন রেশমা বেগম। খাবার ও পানি ছাড়াই ১৭ দিন বেঁচে থাকা ‘অলৌকিক কন্যা’ রেশমা এখন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিনে কাজে ব্যস্ত থাকে। এতদিন তিনি বেশ উপভোগ করছেন ওয়েস্টিনের চাকরি। প্রথমে হোটেলের মধ্যেই একটি রুমে থাকতেন রেশমা। বিনামূল্যে থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
২০১৪ সালের জুন মাসে রুম ছেড়ে দিয়ে গুলশানের পাশে নর্দায় বাসাভাড়া নেন। একটি ভবনের ষষ্ঠ তলার দু’কক্ষের বাসায় থাকেন। ভাড়া ১১ হাজার টাকা। রেশমাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘রানা প্লাজা’ নামের চলচ্চিত্র।
তিনি যখন মা হয়েছেন তখনো বিয়ের কথা জানতেন না পরিবার। মেয়ে জন্মের পর বিয়ের খবর জানতে পারেন মা জোবেদা খাতুন। রেশমার স্বামী আতাউর রহমান রাব্বি একটি প্রাইভেট রিয়েল স্টেট কোম্পানিতে চাকরি করেন।
শ্বশুর বাড়ি বরিশালে। সবাই এখন ঢাকাতেই থাকেন। ২০১৬ সালের ১০ই মার্চ মগবাজারের আদ্-দ্বীন হাসপাতালে জন্ম নেয় কন্যা রেদওয়ানা ইসলাম রেবা। রেশমার ছোট ভাই সাদেক ঢাকায় চাকরি করেন।
বড় ভাই জাহিদুল ঘোড়াঘাটে ব্যবসা করেন। বড় বোন আসমা ঢাকায় থাকেন। একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। বোন ফাতেমাও থাকেন ঘোড়াঘাটে। তার স্বামী কৃষি শ্রমিক। তারা মাঝে মাঝে রেশমা ও রেবাকে দেখতে গুলশানের বাসায় আসেন। রেশমার দ্বিতীয় বিয়ে হয় ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে।
প্রথম স্বামী আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর সাভারের রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন রেশমা। তার মাত্র ২২ দিনের মাথায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর অনেকটাই ধার্মিক জীবনযাপন করেছেন রেশমা। প্রাত্যহিক নামাজ শেষে তিনি পোশাক খাতে কর্মরত মানুষ এবং তার নিহত সহকর্মীদের জন্য নিয়মিত প্রার্থনা করতেন।
ছোট থেকেই শান্ত রেশমা। বরাবরই চুপচাপ থাকতে পছন্দ করতেন। এখনো কাজের বাইরে তেমন কোনো আড্ডা ভালো লাগে না। সময় পেলে টিভি দেখেন। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর চুপচাপ থাকাটা অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তার। কাছের বা দূরের কারো সঙ্গে দেখা হলে সব সময় রানা প্লাজার কথা জানতে চায়। বারবার দুঃসহ সেই স্মৃতি মনে করলে নিজের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। তাই চুপচাপ থাকেন।
এসব কথা বলতে এখন আর ভালো লাগে না তার। সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসলীলার জীবন্ত সাক্ষী রেশমার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের কোশিগাড়ী। ভাটা থেকে টুকরো ইট কিনে এনে তা ভেঙে খোয়া বানিয়ে বিক্রি করেন রেশমার মা। রেশমাও প্রতি মাসে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠান মাকে। তিনটি পাকা ঘর তুলেছেন রেশমার মা। আরো দুটি ঘর তোলার প্রস্তুতি চলছে।
রেশমার বাড়ির সামনের মহাসড়কের ধারে স্থান পেয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী রেশমার ছবিসংবলিত বিশাল সাইনবোর্ড। ঘোড়াঘাট উপজেলার ৩ নম্বর সিংড়া ইউনিয়নের কোশিগাড়ী গ্রামের কৃষক মৃত আনসার আলী ও গৃহিণী জোবেদা খাতুনের দুই ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে সবার ছোট রেশমা (২০)।
আনসার আলীর মৃত্যুর পর জোবেদা খাতুনের বিয়ে হয় আরজন আলীর সঙ্গে। তিনি খাবার হোটেলে কাজ করেন। রেশমাদের মূল বাড়ি চিল সিংড়া ইউনিয়নের মগলিশপুর গ্রামে। তার দাদা ইজ্জত আলি সরকার ছিলেন একজন জোদ্দার। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তার পিতা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে সহায়-সম্বল বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যান। এর পরেই তাদের নেমে আসে দুঃখের জীবন।