গাজীপুর

কার্ড ছাপিয়ে এ কী হচ্ছে গাজীপুরে!

হোটেল ব্যবসার আড়ালে অসামাজিক কার্যকলাপ হয়, এমন ঘটনা রাজধানীতে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার সেই আড়ালের ব্যাপারটিকে শুধু প্রকাশ্যে আনা হয়েছে তাই নয়, রীতিমতো কার্ড ছাপিয়ে বিলি করা হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায়। এমন ঘটনা ঘটিয়েছে রাজধানীর অদূরে টঙ্গীবাজারে অবস্থিত ‘হোটেল স্বাগতম’।

‘আলাল ভাই। বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করুন- ০১৭৬……৩১। হোটেল স্বাগতম (আবাসিক)। টঙ্গীবাজার, মিতালী পাম্পের সঙ্গে।’ এটুকু লেখা কার্ড দেখে আপনি বিভ্রান্ত হতেই পারেন, তবে মুহূর্ত পরেই আপনার বিভ্রান্তি ঘুচে যাবে যখন দেখবেন লেখার পাশেই ছোট এবং অস্পষ্ট করে নারীর মুখয়াবব দেওয়া আছে।

কার্ডে উল্লিখিত নম্বরে এ প্রতিবেদক ফোন দিলে আলাল ভাই ফোন ধরলেন। খদ্দের ভেবে নিঃশ্বঙ্কোচে বিভিন্ন ‘রেট’ জানানো শুরু করলেন- সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ২৫০০ টাকা। প্রতিবেদকের কথা শুনে আলাল ভাই বলছেন, আপনার কথা শুনে আপনাকে শিক্ষিত মনে হচ্ছে, সমস্যা নেই, আমাদের কাছে স্কুল-কলেজের অল্প বয়সী মেয়েও আছে।

নিরাপত্তা কেমন, জিজ্ঞাসা করলে আলাল ভাই বললেন, এমন একটা কাজ করি, সবাইকে ম্যানেজ না করে কি করা যায়? থানার পুলিশকেও হাতে রাখতে হয়, এছাড়া আরও অনেককেই টাকা দিতে হয়। আপনার লাভ কি, এমন প্রশ্নে আলাল ভাই বলেন, আমিও একটা অংশ পাই, প্রত্যেক কাস্টমারে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা। আরও বেশিও পাই, সেটা রেট অনুযায়ী। আমার কাজ কাস্টমার জোগাড় করে দেওয়া।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শুধু হোটেল স্বাগতম নয়, টঙ্গীবাজারের মিতালী পাম্প লাগোয়া ওই স্থানে আরও প্রায় ৮-১০টি হোটেল। স্থানীয়দের মতে, শুধু স্বাগতম নয়, সব হোটেলেই নারীদের দিয়ে এভাবে দেহ ব্যবসা করানো হয়। তিনতলা বিল্ডিংয়ের নিচতলায় কাপড়ের দোকান, ওপরের দুইতলার এক পার্শজুড়ে হোটেল স্বাগতম। নিচতলার এক কোণায় সংকীর্ণ একটা গেটে লেখা, ‘হোটেল স্বাগতম, প্রো. আব্দুর রহিম, এসি নন এসি রুম ভাড়া দেওয়া হয়।’

গেট দিয়ে ওঠানামা করছে উঠতি বয়সের ছেলেরা, এ নিয়ে আশপাশের দোকানিদের মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। এক দোকানির সঙ্গে কথা বলতে গেলে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘এ নিয়ে কথা বলে লাভ নাই, ভালো চাইলে আপনি বরং যেদিক থেকে আসছেন সেদিকে চলে যান।’
স্থানীয়রা এ নিয়ে কথা বলতে চান না। তবে যেটুকু বলেন, তার সারমর্ম হলো, শুধু হোটেল স্বাগতম কিংবা শুধু এ এলাকাই নয়, এ সমস্যা টঙ্গী থেকে শুরু করে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত। এর পেছনে জড়িত একজন প্রভাবশালী। তবে তার নাম উচ্চারণ করা যাবে না।

টঙ্গীবাজারের সামনের রাস্তার ফুটপাতে ১৭ বছর ধরে কাপড় বিক্রি করছেন এক বিক্রেতা। এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বলেন, পুরো গাজীপুরজুড়ে বিভিন্ন হোটেল ভাড়া নিয়ে এ ব্যবসা চালাচ্ছেন একজনই। তিনি ক্ষমতাসীন দলের ‘প্রভাবশালী’ এক নেতা। এ গাজীপুরের সবাই তাকে চেনে কিন্তু কেউ আপনাকে তার নাম বলতে চাইবে না।

স্বাগতম হোটেলের সামনে দিয়ে স্কুল থেকে সন্তানকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন একজন নারী। এ নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে চাপা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘কী আর বলব, আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যায়, তারা আবার এদের প্ররোচনায় পড়ে কিনা, এ চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না!’

টঙ্গীবাজার যে ওয়ার্ডের মধ্যে সেই ৫৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. গিয়াস উদ্দিন সরকার এ বিষয়ে খোলা কাগজকে বলেন, আমরা স্থানীয় এমপিকে নিয়ে এটার বিরুদ্ধে মিটিং করেছি, মিছিল করেছি, অভিযান পরিচালনা করেছি। পুলিশও কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেছে। তখন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার শুরু হয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় কার্ড বিলি করে এভাবে প্রচারণা চালানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, এ তথ্যটা আমি এইমাত্র জানলাম। তবে হোটেলে আড়ালে অসামাজিক কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ আগে থেকেই আছে। আমরা এর আগে এমপিকে নিয়ে অনেক হোটেলে তালাও মেরেছি।
কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন সরকার আরও বলেন, ‘কিছু কথা আছে তা ফোনে বলা যায় না।

আপনি যদি আমার সঙ্গে দেখা করেন তাহলে আমি আপনাকে বিস্তারিত বলতে পারব। তবে আপনাকে হিন্টস দিতে পারি, ওপরের একজন ব্যক্তির নির্দেশে এ কাজটা হচ্ছে, যাকে নিয়ন্ত্রণ করা গাজীপুরের কারও পক্ষে সম্ভব না। এমনকি এমপির পক্ষেও না। এরপর আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না প্লিজ, আমি আর কিছু বলতে পারব না।’ গাজীপুরের ব্যাপারে এ অভিযোগটা পুরনো, এমন কথা স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, ভালোমন্দ মিলিয়েই সমাজ। তবে বর্তমানে বিষয়টি মহামারি আকার ধারণ করেছে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামাল হোসেন খোলা কাগজকে বলেন, ‘কার্ড ছাপিয়ে এভাবে অসামাজিক কার্যক্রম চালানোটা আসলেই অভিনব। তবে আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমি টঙ্গী থানায় নতুন এসেছি। আমার থানার এলাকায় হোটেল ব্যবসার নাম করে যদি এসব কিছু হয়ে থাকে তাহলে খোঁজ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ খোলা কাগজ

শেয়ার করুন: