আমাদের শরীরের সবকিছু সম্পর্কে আমরা স্পষ্টভাবে জানি না, কারণ বিজ্ঞানীরা মানব শরীরের কিছু বিষয়ে এখনো সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। এ প্রতিবেদনে মানব শরীরের ৯টি অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে আলোচনা করা হলো।
কেন আমাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে? আমরা সবাই জানি, আমাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট এমনই অনন্য যে দুজনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট একই হয় না, এমনকি অভিন্ন চেহারার জমজদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু মানুষের আঙুলে এরকম আবর্তিত প্যাটার্ন থাকে কেন?
অনেক বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ধারণা করে এসেছেন যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট কোনোকিছু আঁকড়ে ধরতে সাহায্য করে, কিন্তু পরবর্তীতে এটা প্রমাণ হয় যে ফিঙ্গারপ্রিন্টের কারণে ত্বকের অনেক অংশ অবজেক্টের সংস্পর্শে আসতে পারে না, এর তুলনায় মসৃণ ফিঙ্গারটিপ কোনো অবজেক্টকে পুরোপুরি আঁকড়ে ধরতে পারে। তাই আঁকড়ে ধরার সঙ্গে ফিঙ্গারপ্রিন্টের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব অনন্য প্যাটার্নের ক্রমবিকাশীয় তাৎপর্য সম্পর্কে কিছু থিওরি প্রচলিত আছে, যেমন- তারা আমাদের আঙুলকে রক্ষা করে অথবা স্পর্শ সংবেদনশীলতার যোগান দেয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো এ সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
কেন আমাদের অ্যাপেনডিক্স আছে? অ্যাপেনডিক্স হচ্ছে এমন একটি অর্গান যা অনেক মানুষকে প্রচুর ব্যথা দেয় এবং এটি অপসারণ করলে আমাদের শরীরে কোনো প্রভাবই পড়ে না। অ্যাপেনডিক্স তার গুরুত্বের তুলনায় অধিক সমস্যার কারণ হতে পারে। অনেক বছর ধরে বিজ্ঞানীরা একমত ছিলেন যে, মানুষের উদ্ভিদ-খাদক পূর্বপুরুষদের হজমের জন্য অ্যাপেনডিক্সের প্রয়োজন থাকলেও আধুনিক মানুষদের ক্ষেত্রে এটির প্রকৃত কোনো কাজ নেই।
সম্প্রতি অন্য একটি থিওরি বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তারা দাবি করছেন যে টিউব-সদৃশ এ অর্গানটি অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে আশ্রয় দেয় ও রক্ষা করে। অ্যাপেনডিক্স সম্পর্কে অনিশ্চিত ধারণাকে বিতাড়িত করার জন্য এ থিওরি প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
কেন আমাদের একটি প্রধান হাত থাকে? আমরা একটি ডমিন্যান্ট হ্যান্ড বা প্রধান হাতে অভ্যস্ত এবং এর ওপর ভিত্তি করে ডানহাতি বা বামহাতি নির্ধারিত হয়। কিন্তু কেন একটি হাত অন্য হাতের চেয়ে ভালোভাবে কাজ করে বা অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে? কেন আমাদের দুহাতই সমানভাবে দক্ষ হতে পারে না? এটি এখনো পর্যন্ত মানব শরীরের সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত রহস্যসমূহের একটি। যদিও কিছু লোক উভয় হাতেই সমান দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে।
কেন আমরা হাই তুলি? আমরা মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থা থেকে হাই তুলে আসছি এবং বিজ্ঞানীরা কেন আমরা হাই তুলি তা জানার জন্য এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। হাই তোলার বিষয়ে থিওরির অভাব না থাকলেও এর প্রকৃত কারণ এখনো পর্যন্ত রহস্যাবৃত।
একটি থিওরি বলছে যে আমাদের মস্তিষ্কের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা হাই তুলি, কারণ ঘুমের ঘাটতি অথবা ক্লান্তি মস্তিষ্কের তাপমাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। অন্য একটি থিওরি হচ্ছে, আমরা আমাদের শরীরকে চাঙ্গা করতে হাই তুলি, কারণ হাই তোলার পর হৃদকম্পন বাড়ে এবং চোখের পেশী প্রসারিত হয়। উভয় থিওরি সত্য হতে পারে।
কেন আমাদের বিভিন্ন রক্তের গ্রুপ থাকে? অ্যাপেনডিক্সের মতো মানুষের বিভিন্ন রক্তের গ্রুপও আমাদের বিবর্তন ইতিহাসের ক্লু সরবরাহ করছে। বিভিন্ন রক্তের গ্রুপের বিভিন্ন ইনফেকশনকে হটিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে এবং বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করে যে প্রায় ২০ মিলিয়ন বছর পূর্বে মানুষের পূর্বপুরুষ এবং অন্যান্য বনমানুষদের মধ্যে রক্তের গ্রুপ উদ্ভূত হয়।
প্রোমেডিকো হেমাটোলজি/অনকোলজি অ্যাসোসিয়েটসের ডাক্তার মুহাম্মদ মোবায়েদ বলেন, ‘কিছু ইনফেকশনের বিরুদ্ধে কয়েক ধরনের রক্ত এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের সমন্বয় মানুষের মধ্যে বিস্ময়কর বৈচিত্র্যের রক্তের গ্রুপ সৃষ্টি করেছে যা আমরা এ যুগে দেখছি।’ কিন্তু রক্তের গ্রুপের বিভিন্নতার সঠিক কারণ বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত জানতে পারেননি। ডা. মোবায়েদ বলেন, ‘কেন মানুষের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রক্তের গ্রুপ থাকে তার সম্পর্কে কোনো প্রমাণিত থিওরি নেই।’
কেন আমরা স্বপ্ন দেখি? ম্যাপল হলিস্টিক্সের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা বিশেষজ্ঞ ক্যালেব ব্যাকি বলেন, ‘মানুষেরা তাদের জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘুমে কাটায় এবং আমরা কিভাবে ও কেন স্বপ্ন দেখি তার সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত খুব সামান্যই জানেন।’
আমরা অবগত যে র্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপের সময় আমরা স্বপ্ন দেখি এবং স্বপ্ন দেখার সময় হৃদকম্পন বেড়ে যায়, কিন্তু আমরা জানি না যে, কোন উদ্দেশ্যে স্বপ্ন আবির্ভাব হয়। একটি জনপ্রিয় থিওরি হচ্ছে, ঘুমের সময় মস্তিষ্ক কর্তৃক দিনের স্মৃতিসমূহের মধ্যে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনটি অবান্তর তা বাছাইকরণ প্রক্রিয়াই হলো স্বপ্ন দেখা। অন্য একটি থিওরি হচ্ছে, স্বপ্ন দেখা প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজ নয়, এটি ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের অচেতন মনের ক্রিয়া।
কেন আমাদের শরীরের ভেতরে ভাইরাস থাকে? আমাদের শরীরে অনেক মাইক্রোব বা জীবাণু রয়েছে যা আমাদের শরীরের ওজনের কয়েক পাউন্ড। তাদের মধ্যে প্রচুর মাইক্রোব আমাদের শরীরের উপকার করে- তারা হজমে সাহায্য করে, ক্ষত সারিয়ে তোলে অথবা রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু অধিকাংশ মাইক্রোবই হচ্ছে ভাইরাস এবং এসব ভাইরাসের উদ্দেশ্য বা কাজ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো জ্ঞাত হতে পারেননি।
কেন অন্য প্রাইমেটরা আমাদের চেয়ে শক্তিশালী? শিম্পাঞ্জির মতো অন্যান্য প্রাইমেটের সঙ্গে মানুষের অনেকক্ষেত্রে মিল রয়েছে, যেমন- মানুষ ও অন্যান্য প্রাইমেটের পেশীর গঠনের মধ্যে খুব সাদৃশ্যতা রয়েছে।
তা সত্ত্বেও আমাদের নিকটস্থ প্রাইমেটরা আমাদের তুলনায় ১.৩৫ গুণ শক্তিশালী। আমাদের রয়েছে স্লো-টুইচ মাসল ফাইবার যা অন্য প্রাইমেটদের চেয়ে কম শক্তিশালী মাসল ফাইবার। আমাদের এসব মাসল ফাইবার অন্যান্য প্রাইমেটের তুলনায় খুব বেশি সহনশীল, যে কারণে একজন মানুষ ম্যারাথন দৌঁড় দিতে পারলেও একটা বানর তা পারে না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত মানুষ ও প্রাইমেটের মধ্যে শক্তির অসমতার কারণ নির্ণয় করতে পারেননি।
কেন হাসি ছোঁয়াচে? হ্যাঁ, হাসি সংক্রামক এবং তা কেবলমাত্র রূপকার্থেই নয়। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, প্রবল আবেগ বিভিন্ন ব্যক্তির মস্তিষ্ককে একই সময়ে সংক্রামক হতে সক্রিয় করে।
ব্যাকি বলেন, ‘গবেষণায় পাওয়া যায় যে, হাসির সঙ্গে সামাজিক জীব সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে, সাইকোলজিস্টরা আবিষ্কার করেছেন যে, সামাজিক পরিস্থিতিতে মানুষেরা প্রায় ৩০ গুণ বেশি হাসে।’ তিনি যোগ করেন, ‘প্রচলিত থিওরি হচ্ছে, মানুষ সহানুভূতিশীল প্রাণী হওয়ার কারণে হাসি সংক্রামক।’ যখন আমরা হাসি, আমাদের মস্তিষ্ক এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে এবং এ কেমিক্যাল আমাদেরকে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে সাহায্য করে। হাসি কেন ছোঁয়াচে তার প্রকৃত কারণ এখনো উদঘাটিত হয়নি।